রবিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৬

ফুকেট ও ব্যাংকক ভ্রমণ - ৪

(আগের পর্বগুলো:
ফুকেট ও ব্যাংকক ভ্রমণ - ১
ফুকেট ও ব্যাংকক ভ্রমণ - ২
ফুকেট ও ব্যাংকক ভ্রমণ - ৩)

৩৩।
এই ফাঁকে একটা বিষয় জানিয়ে রাখা ভাল। আমার মোবাইলের সিম কার্ডের স্লটটা ট্রে টাইপের। ফোনের সাথে একটা পিনের মত জিনিষ দিয়েছে, যেটা দিয়ে একটা ছিদ্রে গুতা দিলে ট্রে টা আনলক হয়ে বের হয়ে আসে। বিদেশ বিভূঁইয়ে যে সেই পিনটার দরকার হয়ে যাবে সেটা আগে কখনো চিন্তায় আসেনি; তাই এখানকার সিম কার্ড খুব সহজে পাসপোর্ট দেখিয়েই কিনে ফেলতে পারলেও সেই সিম কার্ড ফোনে লাগানোর ব্যাপারটা বেশ অসম্ভব/জটিল মনে হতে থাকলো। তবে একটু ম্যাকগাইভারি করে সেই সমস্যার চমৎকার সমাধান হয়েছে। গিন্নির কানের ফুলের পেছনের দন্ডটা যেটা কিনা কানের লতির ফুটা দিয়ে পাস করে – সেটা অনায়েসে এখানে ব্যবহার করতে পেরেছিলাম। বলে রাখা ভাল, এ ধরণের অ্যাডভেঞ্চারাস কাজ চুপচাপ করে ফেলতে হয়: গিন্নিগন সাধারণত এ্যাত টেনশন নিতে পারেন না। ;)

৩৪।
ফুকেটের শেষ দিন। গতকাল বেশ ভালই ঘোরাঘুরি হয়েছে। তাই আজ সকালে গতকালের তুলনায় একটু দেরী করে ঘুম থেকে উঠলাম। নিচের রেস্টুরেন্টের ব্রেকফাস্ট সেরে প্রথম কাজ হল বীচে গ‌োসল করা। কারণ এসেছি পাতং সি বীচে আর সেই বীচে কিনা শুধু সন্ধ্যার অন্ধকারে ঘোরাঘুরি করে পোষাবে? নাকি ফেসবুকে ইজ্জত থাকবে! সুতরাং তিনজনে রওনা দিলাম বীচে; আরেব্বাহ! রাতের দেখা বাংলা রোড দেখি সকালে একেবারে নরমাল। সেটা রাতে শুধু হাঁটা পথ হলেও দিনে সেখান দিয়ে গাড়িও চলে! (২য় পর্বে সেটার ছবিও দিয়েছিলাম) বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ, চারিদিক বেশ শুনশান - কেমন যেন মফস্বল মফস্বল ভাব। আবহাওয়া মেঘলা, তাই কোনো রোদ নাই; কিন্তু বেশ বাতাস আছে - আগের দুই দিনের তুলনায় একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। যা হোক, আমরা বীচে পৌঁছিয়ে দেখি কিছু জায়গায় লাল পতাকা আর ডানে কিছু জায়গায় সবুজ পতাকা লাগিয়ে রেখেছে। লাল পতাকার জায়গায় ‘নো সুইমিং’ সাইনও লাগানো। কেন পাশাপাশি জায়গায় এরকম সাইন বুঝতে পারলাম না – আগের দুই রাতে পা ভিজিয়ে হাঁটার সময় এ ধরণের কিছু পার্থক্য বোঝা যায় নি।

যা হোক আমি আর কন্যা পানিতে নামলাম। বাংলা রোড বরাবর বীচের যে অংশটুকু সেখানে নো-সুইমিং ছিল। প্রথমে এ্যাতসব খেয়াল না করে সেখান দিয়েই পানিতে নেমে পরে ফ্ল্যাগের ব্যাপারটা খেয়াল করেছিলাম। বাংলাদেশের খবরাখবর জানি, কাজেই ডুবন্ত চোরাবালি বা এই ধরণের কিছু সমস্যা থাকতেই পারে ভেবে তখন আস্তে আস্তে সবুজ পতাকাওয়ালা জোনে চলে আসলাম। চলে আসার পর বুঝতে পারলাম, এদিকে পানির গভীরতা একটু কম। ওপাশে যে দুরত্বে গেলে কোমর পানি হওয়ার মত অবস্থা হত, এদিকে সেখানেও হাঁটু পানি। অর্থাৎ বহুদুর পর্যন্ত পানিতে ডুবানো চওড়া প্রায় সমতল জায়গা। কোমর পানিতে যেতে হলে তিন-চারশ ফুট ভেতরে যেতে হয় – আমরা অতদুর নামিনি, কিন্তু ওখানেও দুয়েকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি।

৩৫।
মেয়ের এটা প্রথম সমুদ্রে নামা। ভীষন উপভোগ করলো। এক জায়গায় পা ছড়িয়ে পানির দিকে পিঠ দিয়ে বসলে ঢেউয়ের ধাক্কায় প্রায় ৪-৫ ফুট সামনে চলে যাচ্ছে, আবার নেমে যাওয়া পানির টানে এর চেয়ে বেশি দুরে টেনে নিতে চাচ্ছে। আমার ভূমিকা সেখানে বেড়ার মত – যেন টেনে ওর নিয়ন্ত্রনের বাইরে না নিয়ে যায়। গিন্নি বহুক্ষণ একটু দুরে শুকনা বালুর উপরে বসে ছিল – কারণ পানিতে ওনার ঠান্ডা লাগছে। কিন্তু পরে আর আসা হবে না - এরকম কিছু ভেবে কিংবা আমাদের ফূর্তি দেখে, একটু একটু করে গোড়ালি পানিতে নামলো। তীরের কাছে পা ছড়িয়ে বসে ঢেউয়ের ধাক্কা খাওয়ার একমাত্র সমস্যা হল পানির সাথে প্রচুর বালু কাপড়ের মধ্যে ঢুকে পরে। পানি এমনিতে পরিষ্কার, তবে মাঝে মাঝে দুয়েকটা প্লাস্টিকের ছোট টুকরা যে পাইনি সেটা বলা যাবে না।

আরেকটু ওপাশেই প্যারাশুট পরে দড়ি দিয়ে বেঁধে ব‌োট দিয়ে টেনে ঘুড়ির মত উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থায় কিছু মানুষ উড়া-উড়ি করছিল। বিষয়টা বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছিলো, কিন্তু মেয়ে তো পানি থেকে আর বের হতে চায়না - বরং আরো গভীরে যেতে চায়। আমাদের দুপুর ১২টায় চেক-আউটের সময়। তাই মোটামুটি ঘন্টাখানেক বা তার চেয়ে একটু কম সময় বীচের পানিতে দাপাদাপি করে আবার হোটেলে ফিরে আসলাম।





৩৬।
হোটেলে ফিরে ফ্রেস হয়ে প্যাকিং শেষ করা হল। ভেজা কাপড়গুলো একটা পলিথিনে ভরে সেগুলোও স্যূটকেস ভারী করলো। নিচের লবিতে এসে চেকআউট করে সেখানেই সামনে আমাদের লাগেজগুলো কিছুক্ষণের জন্য রেখে বাইরে সুভ্যেনির শপিং-এ বের হলাম। বাংলা রোডের মোড়ের আগেই একটা সুভ্যেনির শপ ছিল জিনিষপাতি দিয়ে এক্কেবারে ঠাসা - আগের দিন সেটা রেকি করে এসেছিলাম। কাজেই আজকে সেখানে গিয়ে বেশ কিছু সুভ্যেনির কেনা হল।

ঠিক দুপুর ১টায় আমাদের নিতে গাড়ি আসার কথা। কিন্তু প্লেন সেই রাত ৭টায়। কাজেই গাড়ি আমাদেরকে এয়ারপোর্ট ড্রপসহ মোটামুটি ৪ঘন্টা সার্ভিস দিবে - এরকম কথা হয়েছিল ফোনে। এতে গাড়ির খরচ হল আড়াইহাজার বাথ – ঘোরাঘুরির জন্য দেড়, আর এয়ারপোর্ট ড্রপ এক – এই হল আড়াইয়ের হিসাব। আগের দিন ওয়াইফাইয়ের কল্যানে একটু সার্চ করে দেখেছিলাম ফুকেটে দেখার মত কি কি জিনিষ আছে। ফেসবুকের স্ট্যাটাসের পরিস্থিতি, দূরত্ব, সময় - সব বিবেচনায় মনে হয়েছিলো যে একটা বড় বৌদ্ধ মূর্তি আছে - সেটা দেখে যাব। এছাড়া গিন্নির দাবী হল – যাওয়ার পথে পাথুরে বীচ দেখবে - নাহ্ বীচে নামবে না, শুধু একটু উঁচু জায়গা থেকে দেখবে!

৩৭।
এয়ারপোর্ট পাতং থেকে উত্তর দিকে, আর এই বৌদ্ধ হল দক্ষিন-পূ্র্বদিকে একটা পাহাড়ের উপরে। প্লেন নিয়ে একটু অন্যরকম অভিজ্ঞতা হলেও গাড়ি নিয়ে এখন পর্যন্ত কোন কমপ্লেন করার সুযোগ হয় নাই। এবারেরটা একটা টয়োটা করোলা Altis 1.8l – আর ওখানে আমাদের মত সিএনজিতে চলার কারবার নাই জন্য গাড়ির পেছনে মালপত্র রাখার বুট স্বাভাবিক সাইজের। গাড়ির ড্রাইভার বয়সে যুবক, হাসিখুশি ভোলাভালা চেহারার। পথে একটা জায়গায় দুই-মিনিটের জন্য গাড়ি থামিয়ে ওর বাসা থেকে জ্যাকেট পরে আর জুতা পাল্টিয়ে আসলো। জানালো এয়ারপোর্টের পথে কোনো বীচ-টিচ নাই বরং এখন বৌদ্ধ মূর্তিতে যাওয়ার পথে একটু সৈকত পেতে পারি।

পথে পাতংএর মত আরেকটা বীচ পড়েছিলো, সেখানে গাড়ি থেকে নেমে দুই মিনিটের মধ্যে উত্তাল বাতাসে বীচ/সমূদ্র ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে দুটা ফটো খিচে চলে এসেছিলাম। শহর, চড়াই-উৎরাই আর পাহাড় চড়তে চড়তে গাড়িতে বসেই আমরা হালকা খাওয়া দাওয়া করে নিলাম (7-ইলেভেন জিন্দাবাদ)। প্রায় ৫০ মিনিট লাগলো সেই বৌদ্ধ মন্দিরে পৌঁছাতে।

পথে যেতে যেতে আমাদের ড্রাইভার এই পথেই পরে এমন কয়েকটা টুরিস্ট স্পটে যেতে চাই কি না সেটা খোঁজ নিল। একবার তো একটা হাতির রাইডে প্রায় ঢুকেই পড়েছিল। বৌদ্ধ মন্দির (বিগ বুদ্ধা) যাওয়ার ১০-১৫ মিনিট আগে পাহাড়ের উপরেই একটা জায়গায়, কাঠের সিড়ি আর ফ্রেম বানানো হাতিতে চড়ার জন্য। বেশ কিছু টুরিস্ট সেই হাতিতে চড়ে পাহাড়ি পথে ঘুরতেও যাচ্ছে দেখলাম। কাছেই আরেক জায়গা থেকে দেখি চার-চাকার মটর-বাইকে চড়ে ১৩-১৪ জনের একটা গ্রুপ রাস্তার পাশ দিয়ে আস্তে আস্তে এক লাইনে উপরের দিকে যাচ্ছে; সকলের সামনের বাইকে সম্ভবত ওদের গাইড। গাড়িতে বসে এই রাইডটাকে খুব বেশি আকর্ষনীয় কিছু মনে হল না - ওদের গন্তব্য জানা গেলে হয়তো অন্যরকম মনে হত। (এখন নেটে quad bike tour Phuket লিখে খুঁজে ছবিটবি দেখে অবশ্য বেশ এক্সাইটিংই মনে হচ্ছে)। এর আগে একটা জায়গায় নাকি সাপ, বান্দর আর পাখির তিনটা আলাদা শো আছে বলেছিল।

৩৮।
বিগবুদ্ধা জায়গাটা একটা পাহাড়ের উপরে। ওয়েবসাইটে যেমন বলেছিল, তেমনই এখান থেকে পুরা ফুকেটের ৩৬০ডিগ্রি ভিউ পাওয়া যায়। জায়গাটা অবশ্য এখনও আন্ডার কনস্ট্রাকশন। এখানে ঘুরাঘুরি করতে কোন পয়সা লাগে নাই – ভবিষ্যতে লাগবে কি না কে জানে। এই বিরাট সাদা রঙের ধ্যানেমগ্ন বৌদ্ধ মূর্তিটি নাকি ৪৫ মিটার উঁচু! এর নিচে প্রায় চারতলার সমান ভবনের মত স্পেস আছে (সম্ভবত এই নিচের পুরা স্ট্রাকচার সহ ৪৫ মিটার)। সামনের দিক থেকে উপরে মন্দিরে পৌঁছানোর জন্য বিরাট চওড়া সিঁড়ি। সিঁড়ির পাশে বিরাট আঁকাবাঁকা পাইপ/সাপের মত রেলিং - সেটার কাজ তখনও চলছিল। আসলে এই সিড়ি বেয়ে প্রায় চারতলার সমান উচ্চতায় উঠতে হয়। দুরের পথ থেকে যেমন দেখাচ্ছিল, সিঁড়ির নিচ থেকে তার চেয়ে অনেক সুন্দর সম্পুর্ন আবয়বটা দেখা যায়। আর সিঁড়ি বেয়ে উঠার সাথে সাথে চারপাশে পুরা ফুকেট আরও চমৎকারভাবে দৃশ্যমান হতে থাকে।









একেবারে উপরের চত্বরে একতলার সমান উঁচু গোলাকার ভবনের ছাদে বিরাটাকার বৌদ্ধ মূর্তি। নিচের ভবনটা ফাঁকা, এখনও ভেতরে কিছু নাই। চারপাশে বারান্দায় বিভিন্ন রকম মূর্তি রাখা। এই চত্বরটায় বাতাস বেশ ঠান্ডা - ব্যাপারটা হয়ত ভৌগলিক কারণে; কিন্তু আসলেই এখানে উঠলে অসম্ভব একটা শীতল প্রশান্তি কাজ করে মনে। এই বিরাট চত্বরটার নিচে আরও তিন তলা আছে, যা ঐ সিঁড়ি বেয়ে উঠার সময় খেয়াল করা যায় না – কারণ ভবনের আরেকপাশে পাহাড়ের একটা অংশ আর গাছপালা এই চত্বরের সাথে সমান সমান হয়ে এমনভাবে মিশে আছে, মনে হয় যে এই পুরা চত্বরটাই একটা পাহাড়ের মাথা।



৩৯।
এখানেও দেখলাম কিছু জায়গায় পানপাতার মত আকারের চকচকে কাগজ বা কোন একটা টুকরায় শিরি+ফরহাদ, লাইলি+মজনু টাইপের লেখা লিখে একটা উইশট্রিতে ঝুলিয়ে রেখেছে মজনুগণ। আরেকটা মজার বিষয় খেয়াল করলেন গিন্নি, সেটা হল এখানে আগত অনেক বিদেশিনীর পরনেই একই রকম ডিজাইনের কাপড়। আসল ঘটনা হল এঁরা নিচ থেকে আসার আগেই ডেকে নিয়ে এই কাপড় জড়িয়ে দিয়ে ধ্যান-ভঙ্গকারী উন্মুক্ত উত্তেজক অংশ ঢেকে দিয়েছে এখানকার সেবক-সেবিকাগণ। কারও কারও উপরের দিকেও কাপড় জড়িয়ে দিয়েছে! ফিরে যাওয়ার সময় নিচে সেগুলো আবার ফেরত নিতেও দেখেছিলাম।





বিগবুদ্ধা ছাড়াও এর পেছন দিকে দুটো প্রায় ৩ তলার সমান বিশেষ ভঙ্গিতে দাঁড়ানো মূর্তি ছিল। আর বামদিকে পেছনে আরেকটা প্রায় দোতলার সমান উঁচু সোনালী রঙের বৌদ্ধ মূর্তি ছিল। অবস্থা দেখে মনে হল, এই সোনালী মূর্তিটি অনেক আগের তবে ধর্ম-ব্যবসা বা ট্যূরিজম আরও বাড়ানোর জন্য এই নতুন বিশালাকৃতি বিগবুদ্ধার সংযুক্তি।

বারান্দার মূর্তিগুলো আরও ইন্টারেস্টিং। এক জায়গায় শোয়া-বসা-দাঁড়ানো বিভিন্ন ভঙ্গিতে দেড় মানুষ সমান কিছু সোনালী মূর্তি। সেগুলোর প্রতিটার সামনে সপ্তাহের বিভিন্ন দিন (রবি-সোম ….) লেখা। সাথে কারে সুন্দর পাত্র আছে – চাইলে সেখানে দান করা যাবে!





৪০।
‘বুদ্ধের পায়ের ছাপ’ লেখা সাইনবোর্ডটা দেখে ভেতরটা বেশ নড়েচড়ে উঠল। ওয়েল ওয়েল ওয়েল … সব ধর্মেই বুজরুকি আছে তাহলে! তারপর হাত আর পায়ের ছাপ তো সোনালী রঙের, সম্ভবত ছাপগুলো বাঁধায় রাখছে; আর ছাপের সাইজ দেখে মনে হল এই সাইজের হাত আর পা হলে মানুষটার উচ্চতা কমপক্ষে ৮ ফুট হওয়ার কথা। হাতের তুলনায় পা বেশ বড় – বিগফুটের মত অনেকটা। ছাপের উপরে কিছু কয়েন আগে থেকে রাখা আছে – সেই পিকে মুভির সহজ ইনভেস্টমেন্টের মতই মনে হয়েছিল সবকিছু। এটা বেশ শিক্ষনীয় সফর হয়ে থাকবে বলে মনে হল।

যুগে যুগে প্রকৃতির শক্তি আর অসুস্থতার কাছে নিজেদের অসহায়ত্ব অনুভব করে মানুষ সুপেরিয়র কোনো শক্তির কাছে সারেন্ডার করে আশ্রয় লাভ করতে চেয়েছে। ভক্তিভারে নতজানু লোকজন তাই লালসালুওয়ালা মজিদদের খুব পছন্দনীয়।ভক্তি ব্যবসা একটা দারুন ব্যবসা। এখানে আমাদের মত শখের টুরিস্ট যেমন আছে, তেমনি তীর্থস্থানে আসা ভক্তিভারে নতজানু কিছু টুরিস্টও চোখে পড়েছে।







৪১।
এখানে চারপাশের দৃশ্যাবলী আসলেই মনমুগ্ধকর। যত দেখি ততই চেয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। সেরকম ভিউগুলো উপভোগ করার জন্য বেশ কিছু পয়েন্টও আলাদাভাবে তৈরী করা আছে। ছবি তুলে মন ভরে না, ছবিতে আসল সৌন্দর্য আসে না।

মঠ বা মন্দির থেকে নামার/ফেরার পথ এখানে প্রবেশ করার সিড়ি থেকে আলাদা। প্রবেশ পথ দিয়ে ফিরে যাওয়া নিষেধ। বের হওয়ার সময় ডানে এখানকার সন্যাসী বা মন্কদের একটা আশ্রম আছে। অবশ্য সেটা গাছপালা বা ল্যান্ডস্কেপিং দিয়ে যত্ন করে আলাদা করা। সেখানে একরঙা কাপড় জড়ানো লোকজন আছে, যাঁরা সম্ভবত এই মন্দির নাকি মঠের পূজারী। এইখানেও একটা বেড়ালের সাথে দেখা, যে কিনা মানুষজনকে পাত্তাই দিল না। হঠাৎ এই কালো বেড়ালটাকে দেখলে মনে হয় সেও এখানকার কোনো ধ্যানরত পূজারী।

বের হওয়ার পথে সিড়ি দিয়ে কিছুটা নামলে একটা পাবলিক টয়লেট আছে। যতদুর মনে পড়ে এখানে রানিং ওয়াটার ছিল না - তারপরেও পরিছন্ন ছিল। সবশেষে নিচতলায় মূল মূর্তির ঠিক নিচে একটা সুভ্যনির শপের ভেতর দিয়ে বের হতে হয়। বেগম সাহেবা সেখান থেকে বেছে এমন একটা সুভ্যেনির কিনলো যা অন্য জায়গাগুলোতেও আছে। অথচ এই স্থানের ইউনিক সুভ্যনিরও ছিল। যাক, ব্যাপার নাহ্।

এই পর্যায়ে আমাদের ট্যাক্সির চালক দেখি আমাদের খুঁজতে খুঁজতে এসে হাজির। হয়তো আমাদের লেট দেখে চিন্তায় পরে গিয়েছিলো। আমরা বের হওয়ার সময় তিনজন নারকেল দেয়া আইসক্রিম খেলাম – ঐ মুহুর্তে যা অমৃতের মতই লেগেছিলো।













৪২।
সর্বমোট ১ ঘন্টার মধ্যে এই জায়গাটা দেখা শেষ। গাড়িতে উঠতে উঠতে ভাবলাম এবার তাহলে এয়ারপোর্ট। কিন্তু পাহাড় থেকে নামার আগেই ড্রাইভার মোটামুটি আমাদেরকে ফুসলিয়ে ঐ সাপ কিংবা পাখির শো যেখানে, সেখানে গাড়ি ঠেকাল। বাইরে থেকে পার্কিংএর জায়গাটা দেখে বড়সড় একটা নির্জন জায়গা মনে হচ্ছিলো। যার বাম পাশে সাপের আর ডানপাশে পাখির শো। কন্যা কালবিলম্ব না করে পাখি বেছে নিল (Phuket Bird Paradise)। ৩জন ঢুকতে নিল মোট ১৩০০ বাথ (৫০০*২+৩০০)। টিকিটের দাম দেখে একটু আক্কেল গুড়ুম হলেও কোন দ্বিধা করলাম না - কারণ এসেছি তো ঘুরতে আর গাছে ধরা টাকা উড়াইতে।

যেই মেয়ে দুইজন টিকেট কাউন্টারে ছিল; তাদের একজন আবার ভেতরে মশা আছে বলে হাতে পায়ে মশা-তাড়ানি স্প্রে দিয়ে দিতে চাইলো। দেশ থেকে এ্যাত দুরে আসতে পারলাম তাই এইসব ছোটখাট মশাটশাকে ভয়টয় পাওয়ার কোনো কারণ দেখলাম না। তারপরও যখন দিতে চাইছে, কন্যার হাতে পায়ে দেয়ায় নিলাম। তারপর ওরা বললো, বার্ড শো শুরু হতে আরও ২০ মিনিট বাকি আছে, তোমরা এই সময়টায় ভেতরে অন্য পাখি দেখ। ভেতরটা আহামরি তেমন বড় কিছু না; ১ একরের মত জায়গা হবে পুরাটা – সেখানে বিভিন্ন খাঁচায় বিভিন্ন রকম সুন্দর সুন্দর পাখি রাখা। ওটা ঘুরে দেখতে ১০ মিনিটের বেশি লাগার কথা না। আমরা ঘুরে যখন আসছি তখন আরেক মহিলা কন্যাকে ছবি তোলার স্পট দেখিয়ে দিল। সেই মহিলা তখন শো-এর স্থানের বাইরের দিকটা ঝাড়ু দিচ্ছিলো।



৪৩।
শো এর জায়গায় বসে আছি। আমরা ছাড়া আর কেউ নাই। একটু পর দেখি আরো দুয়েকজন আসলো। সব মিলিয়ে ১০ জন দর্শকও হয়নি। কিন্তু ‘শো মাস্ট গো অন’। এক কথায় অসাধারণ একটা শো – হয়তো তেমন কিছু আশা করি নাই দেখে; হয়তো দর্শক কম থাকায় মনযোগ বেশি পেয়েছি দেখে – নাহ্, আসলেই ভাল ছিল শোটা। বিভিন্ন রকম পাখি, খেলার মধ্যে দুষ্টামি, আর কন্যাকে ডেকে নিয়ে অংশগ্রহণ করানো। মনে হয় আমরা প্রায় সবাইই কোনো না কোনো ব্যাপারে পার্টিসিপেট করেছি। হাতে, মাথায় পাখি নিয়ে ছবি-টবি তোলার ব্যাপারও ছিল। কন্যা তো গোসলের পর সারাদিন মূর্তি-টূর্তি দেখে একটু ফিউজ হয়ে ছিল, এখানে তার মুড পুরা ভাল হয়ে গেল – আমাদের টাকা পুরা উসুল। মাত্র কয়েকজন মহিলা মিলে একটা স্পট চালাচ্ছে কিভাবে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন - আর যে মহিলাকে বাইরে ঝাড়ু দিতে দেখেছিলাম -- উনিই কিন্তু পোশাক পরিবর্তন করে এসে শোটা পরিচালনা করলেন! গুগলে একটু Phuket Bird Paradise লিখে সার্চ দিয়ে ছবি দেখলে আরও একটু ভাল ধারণা হবে।

শো শেষে ফুরফুরে মেজাজে বের হওয়ার সময় চমৎকার প্রিন্ট করা ছবি পাওয়া গেল, সেগুলোও কেনা হল। এরপর গাড়িতে চড়ে সোজা এয়ারপোর্ট চলে আসলাম।





৪৪।
দিনের বেলা এখানকার রাস্তাঘাটের ধারের জীবনযাত্রা আরেকটু বিস্তারিত দেখা গেল। এখানে একটা বিষয় বেশ মজা লেগেছে সেটা হল মটরসাইকেলের পাশে (পেছনে নয়) ফ্রেমের মত করে চাক্কা সহ একটা গাড়ি লাগানো – অনেকটা আমাদের ভ্যানের মত। এই সাইকেল-মাইক্রোট্রাকে করে ওরা বিভিন্ন স্ট্রিট-শপ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আরেকবার একটা পিকআপ ভ্যানের পেছনে ছোট ছোট প্যাকেটে ঝুলানো মালপত্রওয়ালা মুদি দোকানটাও বেশ ভাল আইডিয়া মনে হল।





এয়ারপোর্টে বেশ আগেই পৌঁছেছি। কাজেই সেখানকার একটা ফাস্ট ফুডের দোকানে ঢুকে বকেয়া খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলাম। এবার আর প্লেন ডিলে ছিল না।

৪৫।
ব্যাংকক এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর পর ৩ নং গেটের সামনে মিস প্লা-এর সাথে যোগাযোগ করার কথা। আমরা লাগেজ সংগ্রহ করে ৩ নং গেট খুঁজে পৌছাতে পৌছাতেই দেখি সেখানে আমার নাম লেখা কাগজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মধ্যবয়স্ক একজন লোক। সেই লোককে পরিচয় দিয়ে ফলো করতে করতে এয়ারপোর্ট বিল্ডিং থেকে সরাসরি রাস্তার অন্যদিকে পার্কিং বিল্ডিংএ চলে আসলাম একটা ব্রিজ দিয়ে। আমাদেরকে দাঁড় করিয়ে গাড়ি নিয়ে আসলো। গাড়িটা বাইরে থেকে খুব দামী লাক্সারি মডেলের ব্যক্তিগত গাড়ি মনে হচ্ছিলো। ভেতরে দেখলাম সেটা টয়োটা, কিন্তু আসলেই ভেতরটা সেইরকম দামী এবং প্রশস্ত। মেয়ে তো বলেই বসলো - সাচ এ নাইস কার!

ব্যাংককে তখন বেশ রাত। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল পৌঁছুতে ৩০ মিনিটের মত লাগলো। রাস্তার মধ্যে ফ্লাইওভারের মত হাইওয়েই ছিল বেশি - সেখানে গাড়ি চলেছে ১২০-১৩০ কিমি গতিতে। মূল শহরে একটা জায়গায় দেখি একদিকে রং ওয়েতে গাড়ি ঢুকিয়ে দিল -- অবশ্য সামনে পিছে আরও গাড়ি ছিল। পরে একসময় খেয়াল করলাম রাস্তার ৮ লেনের জন্য ৮টা সিগনাল বাতি - তার মধ্যে সবচেয়ে বামের ১টাতে (কোথাও ২টাতে) সবুজ আর বাকীগুলো লাল-কাটা দেয়া - কাজেই আমরা আসলে ঠিকই আছি, রংওয়েতে না। অর্থাৎ কোনরকম ডিভাইডার ছাড়াই একটা ৮ লেনের রাস্তা কোনরকম ঝামেলা ছাড়া লেন মেনে সকলে ব্যবহার করছে। নিশ্চিতভাবেই ট্রাফিক ডিমান্ড অনুসারে দিনের বিভিন্ন সময়ে আসা এবং যাওয়ার লেনের সংখ্যা পরিবর্তন করে দেয় সেখানে।

৪৬।
এক্কেবারে শেষ পর্যায়ে বেশ কিছু চিপা গলি দিয়ে হোটেল অ্যাম্বাসেডরে এসে পৌঁছালো -- এই এয়ারপোর্ট পিকআপ আমাদের প্যাকেজের অন্তর্গত ছিল। এই এলাকাটার রাস্তা (গলিগুলো) এখনও লোকজন, দোকানপাটে গমগম করছে। ৪-স্টার হোটেল অ্যাম্বাসেডরের লবিটা এত বিশাল যে অবাক হয়ে গেলাম। যা হোক চেকইন করে টরে রুমে মালপত্র রেখে একটু ফ্রেশ হয়েই বের হলাম খাদ্যের সন্ধানে। হোটেলে প্রবেশের আগেই গাড়ি থেকে 7-Eleven দেখেছিলাম। কাজেই তিনজনে মিলে গিয়ে ঠিক সামনের গলির উল্টাপাশেই সেইখান থেকে বিপুল পরিমানে খানা-খাদ্য কিনে নিয়ে আসলাম।

মজার ব্যাপার হল হোটেলের লবি থেকে বের হয়ে সামনে আরেকটা ভবনের মাঝের করিডোর দিয়ে গিয়ে গলি ক্রস করলেই দোকান। আর হোটেলর অংশ যেই ভবনটার মধ্য দিয়ে আসলাম সেটার মধ্যেই আমাদের ট্রাভেল এজেন্টের অফিস। বাংলাতে সাইনবোর্ড লেখা আরও ৪-৫টা ট্রাভেল এজেন্টের দোকান সেখানে। এমনকি বাংলা খাবার পাওয়া যায় এমন লেখাও দেখলাম। ট্রাভেল এজেন্টের অফিস খোলা ছিল, তাই পরদিনের ট্যূর সম্পর্কে জেনে তারপর রুমে চলে আসলাম।

(চলবে)

1 টি মন্তব্য:

নামহীন বলেছেন...

ধন্যবাদ, অনেক কষ্ট করে বিস্তারিত লেখার জন্যে।
নতুন কেউ গেলে কাজে লাগবে।