বুধবার, ২১ এপ্রিল, ২০১০

আবর্জনা থেকে মুক্ত হওয়ার সময় এখনই

(সর্বপ্রথম সচলায়তনে প্রকাশিত)
পেশায় পরিবেশ প্রকৌশলী বলে আবর্জনার প্রতি আমার একটা আত্মার টান দেখা যায়। না ... ইয়ে .. মানে .... আবর্জনা দেখলেই পরিষ্কার করার বিষয়ে বলতে চেয়েছিলাম। আম্মার কাছে শুনেছি যে যখন একরত্তি বাচ্চা ছিলাম, তখনও হাতের কাছে ঝাড়ু পাইলেই ঝাড়ু দেয়া শুরু হয়ে যেত। এখনও হাতের কাছে ন্যাকড়া পেলেই জব্বর (জব্বার কাগু নয়) মোছামুছি শুরু করে দেই। ক্লাসরূম, সিড়ি ইত্যাদিতে কাগজ পড়ে থাকতে দেখলেও কুড়িয়ে পাশের "আমাকে ব্যবহার করুন" এ স্থাপন করি। অবশ্য শেষোক্ত এই অভ্যাসটা শুরু হয়েছে জাপান থেকে ... দেখতাম বুড়াগুলো ইভনিং ওয়াক করার সময়ে হাতে একটা পলিথিন ব্যাগ আর আরেক হাতে বিরাট চিমটা নিয়ে হাটে। হাঁটতে হাঁটতে কোনো ময়লা যেমন কাগজের টুকরা, বাচ্চাদের ফেলে যাওয়া চকোলেটের খোসা ইত্যাদি পেলেই চিমটা দিয়ে টুক করে ধরে পলিথিনে ঢুকিয়ে ফেলে, তারপর ফেরার পথে সেই পলিথিন ব্যাগটা ডাস্টবিনে ফেলে দেন ... ... পরিবেশের স্বাস্থ্য ঠিক রাখাতে সাহায্য করে আসলে নিজের স্বাস্থ্য ঠিক রাখার আরেকটি দিকও (হাটার পাশাপাশি পরিচ্ছন্ন পরিবেশ) ঠিক রাখলো। যাক ধান ভানতে শীবের গীত হয়ে গেল অনেক ... ... আসল কথায় আসি ... ...

স্কুলের পাঠ্য বইয়ে আমাদের সময়ে কম্পিউটার শিক্ষা বলে কোনো কিছু ছিলো বলে মনে পড়ে না (আমার SSC =১৯৯০)। ইদানিং বিভিন্ন জায়গায় পড়ছি যে আমাদের নীরবতার সুযোগে এই জায়গায় কিছু আবর্জনা পুশ-ইন করা হয়েছে। কিন্তু এই আবর্জনা পঁচে বায়োগ্যাস বা সার কিছুই হওয়ার উপায় নাই, তাই উদ্দিষ্ট ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে এটা সহায়তার বদলে পেছনে টেনে লক্ষ্য থেকে দুরে সরিয়ে রাখবে বলে প্রতীয়মান হয়। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল নামক একটা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষেও ইদানিংকার পঁচা দূর্গন্ধ দেখে আবর্জনা দিয়ে ভর্তি বলে প্রতীয়মান হল। তাই এই উৎস থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রেরণা নিলে 'ডিজি' বাদ চলে গিয়ে শুধুই 'টাল' অবশিষ্ট থাকবে বলে আমার দৃঢ় ধারণা।

এদিকে ২০১৩ সালেরও বেশি দেরী নাই। কিন্তু পাঠ্যক্রমের ঐ বইগুলোতে প্রোপাইটারী দামী সফটওয়্যার চালানো শেখানোর চেষ্টা করা হযেছে বলে জানতে পারলাম। যদি পুরা তরুন সমাজকে ঐ পথে এগিয়ে নেয়া হয় তাহলে প্রজন্মশুদ্ধ শিক্ষিত লোকজন গুটিকয়েক সফটওয়্যার কম্পানির কাছে জিম্মি হয়ে থাকবে ... ... আর একপেশে দক্ষতার সেই প্রজন্মকে কাজে লাগাতে হলে দেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মূদ্রার বেশিরভাগ অংশই ঐ বিদেশী কোম্পানিগুলোর পকেটে চলে যাবে কারণ TRIPS চুক্তির অধীনে সরকার পাইরেসী ঠেকাতে বাধ্য।

কাজেই প্রস্তুতি নেয়ার জন্য এখনই সময়। শিক্ষাসূচীকে যুগোপযোগী করতে হলে মুক্ত সফটওয়্যার বিষয়ক বিষয়গুলোকে বেশি বেশি করে শিক্ষাক্রমে নিয়ে আসতে হবে। এতে বিকশমান প্রজন্ম নির্ভরশীলতার শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে এবং সত্যিকাল লক্ষ্য তথা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। তাই আসুন শিক্ষাক্রম থেকে নির্ভরশীলতার আবর্জনা সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করতে জনমত গড়ে তুলি। যাদের মনে মুক্ত সফটওয়্যারের সামর্থ নিয়ে সন্দেহ দোলা দেয়, তাদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি মোজিলা ফায়ারফক্স, উইকিপিডিয়া, অভ্র-কীবোর্ড, ওপেনঅফিস, গিম্প, লিনাক্স ইত্যাদি মুক্ত সফটওয়্যার ও মুক্ত সংস্কৃতির সাফল্যের উদাহরণ। এছাড়া এই লেখা যেই ব্লগ বা ফোরাম থেকে এই লেখাটি পড়ছেন সেটাও মুক্ত সফটওয়্যারের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।

ভবিষ্যত প্রজন্মকে সফটওয়্যার-গোলামী থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য সঠিক দিক নির্দেশনা দেয়া জরুরী। সফটওয়্যারের বিষয়টা পাত্তা পাওয়ার যোগ্য কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিগণই সফটওয়্যার ব্যবসা করে অর্থ কামাচ্ছেন। আমাদের বয়স বেড়ে চলেছে। এই আধবুড়াদের পক্ষে নতুন বিষয়গুলো আয়ত্ব করা সম্ভব না হলেও নতুন প্রজন্মের পক্ষে মুক্তির পথ আয়ত্ব করা সহজ হবে। তাই শিক্ষাক্রম থেকে আবর্জনাপ্রসুত আবর্জনাগুলো সরিয়ে ফেলা অতি জরুরী।

তাই সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি যে যার অবস্থান থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের কানে কার্যকরভাবে এই কথাগুলো পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের অনেকেরই ভাই, দুলাভাই, চাচা, মামা, বন্ধু, বন্ধুর বাবা, আঙ্কেল, শিক্ষক ইত্যাদি পরিচিত ব্যক্তির মধ্যেই সরকারের উচ্চ পর্যায়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি/শিক্ষক/সাংবাদিক/কর্মকর্তা খুঁজে পাওয়া যাবে। প্রথমে তাদেরকে TRIPS, পাইরেসি, ওপেনসোর্সের শক্তি-সফলতার কথাগুলো সহজ ভাবে বলতে হবে। এছাড়া এ-ও জানাতে হবে যে বিভিন্ন দেশেই সরকারী পর্যায়ে ওপেনসোর্সকে প্রমোট করে অযথা খরচ বাঁচিয়েছে; অনেক বড় বড় কোম্পানিই ওপেনসোর্স ভিত্তিক সমাধান বেছে নিচ্ছে। এনারা জানলে এবং দেশপ্রেমিক হলে সামনে পুশ করতে থাকবেন বলেই আশা করি। এটা হবে অনেকটা জমিতে বীজ লাগানোর আগে জমি প্রস্তুত করার মত একটা পদক্ষেপ।

শুধু সচেতনতা বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়। যদি নতুন শিক্ষাক্রমকে সমর্থন দেয়ার মত যথেষ্ট বিকল্প শিক্ষা উপকরণ প্রস্তুত না থাকে তবে সরকারের সদিচ্ছা হলেও আগের আবর্জনা ফেলতে পারবেনা। তাই ওপেনসোর্স ভিত্তিক শিক্ষাক্রম এবং এর উপযোগী শিক্ষা উপকরণ তৈরী করা জরুরী। সরকার শুরু করুক বা না করুক আমরা কিন্তু এই কাজটা এগিয়ে রাখতে পারি। এজন্য বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এবং ইন্টারনেটে অ্যাকটিভ দেশপ্রেমিক তথ্য-প্রযুক্তিবিদ ও শিক্ষাবিদদেরকে একটা ফোরামের মাধ্যমে একত্রে করে তাঁদের দিয়ে একটা উন্মুক্ত সুপারিশমালা তৈরী করাতে পারি। এতে শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের সুক্ষ্ণ বিষয়াদি উঠে আসবে এবং সরকারের কাছে পেশযোগ্য একটা সুন্দর প্রস্তাব তৈরী হয়ে থাকবে বলে আশা করা যায়। এই প্রস্তাব হয়তো সরকার আবার দেশের শিক্ষা-সংক্রান্ত কমিটিতে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পাঠাবে (আশা করি এই প্রক্রিয়া আবর্জনামুক্ত থাকবে)।

পাশাপাশি সেই সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষা উপকরণের তৈরীর কাজ এগিয়ে নিতে পারি, যেন সরকারকে সেই সব স্যাম্পল উপকরণও সরবরাহ করা যায়। উইকি এবং বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক ইবুকের সফলতা দেখে এই স্বপ্নটাকে অবাস্তব মনে হয় না।

এই আবর্জনা দূরীকরণের পাশাপাশি আরেকটা বিষয়ে লক্ষ্য দেয়া দরকার। সেটা হল বর্তমান সরকারী কর্মীবাহিনীকে ২০১৩ পরবর্তী সময়ের জন্য প্রস্তুত করা। ইতিমধ্যেই কিছু জায়গায় অভ্র ব্যবহার করতে না জানাকে অযোগ্যতা বলে ধরা হবে - এরকম ঘোষনার কথা শুনেছিলাম। একই ভাবে যদি ওপেন-অফিস এবং লিনাক্সকে প্রমোট করার উপায় বের করা যায় তাহলে কিন্তু আমরা শক্তভাবে প্রস্ততি নিতে পারি।
আসুন আমরা একটা ইবুক খুলি যেটাতে ভবিষ্যতে বিদ্যালয়ে যুগোপযোগী কম্পিউটার শিক্ষাক্রম বিষয়ক পোস্ট এবং আলোচনাগুলো ধরে রাখি -- এবং ডেডলাইন ফিক্স করে একটা প্রাথমিক খসড়া দাঁড় করিয়ে ফেলি। পাশাপাশি চেনাজানা প্রাসঙ্গিক ফোরামগুলোতে প্রয়োজনে ইংরেজিতে এই প্রক্রিয়াতে যুক্ত হওয়া আহ্বান ছড়িয়ে দেই। শুরুর দিকের বিষয়গুলো এমন হতে পারে:
-- আমাদের দেশে বনাম অন্য দেশে কেমন সিলেবাস
-- কোন শ্রেণীতে কী সিলেবাস হওয়া উচিত

====ডিসক্লেইমার====
তাওয়া গরম থাকতে থাকতেই পরটা ভাজার নিয়ম, তাই তাড়াহুড়া করে এই পোস্ট করলাম... তাই নিঃসন্দেহে লেখা সুগঠিত হয়নি, এবং অনেক জরুরী বিষয়ও বাদ পড়ে গেছে - এটা ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ থাকলো।

তাওয়া গরম থাকার ব্যাপারটা কারো মাথার উপর দিয়ে গেলে জেনে রাখুন যে পাঠ্যক্রমের বইগুলো স্বঘোষিত আই.টি. বিশেষজ্ঞ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রণেতা মোস্তফা জব্বার সাহেবের লেখা।