বুধবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

জাপানের রাস্তায় স্পিড ক্যামেরা: উচ্চতর জ্ঞানের প্রয়োগ ও হাবিজাবি

১।
জাপানে একটা বেশ অদ্ভুদ ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলাম। টোল রোডের কিছু জায়গায় সাইনবোর্ড দেয়া যে কিছুদুর (যেমন: ৩০০ মিটার) সামনে ট্রাফিক ক্যামেরা আছে। তাই না দেখে সমস্ত গাড়িগুলো সব গতি কমিয়ে ৮০ কিমি/ঘন্টার নিচে চলতো, কারণ ঐ রাস্তার স্পিড লিমিট ৮০ কিমি/ঘন্টা। আর যেইনা ক্যামেরা পার হল, আবার আগের মত গতি বাড়িয়ে ১৩০-১৫০ কিমি/ঘন্টায় গাড়ি চালাতো। আমরা বিদেশিগণতো অবাক, আরে এখানকার পুলিশ বেকুব নাকি!! কারণ অন্য জায়গায় হলে ক‌োথায় ক্যামেরা সেগুলো জানানোর প্রশ্নই উঠে না – ওভারস্পিডিং করলে সুন্দর করে বাসায় জরিমানার স্লিপ চলে আসবে। এ আপাত বোকামির ঘটনা বরং জাপানি পুলিশের দক্ষতাতে আমার শ্রদ্ধা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণটা খুবই সাধারণ ---

২।
মানুষকে নিরাপদে এবং দ্রুততর সময়ে গন্তব্যে পৌছানোর লক্ষে প্রকৌশলীগণ প্রতিনিয়ত উন্নততর মসৃন রাস্তা তৈরী করার চেষ্টা করেন। আর সেই রাস্তায় আমাদের দেশে যখন হাতির মত উঁচা স্পিড ব্রেকার দেয়া হয় সেটা দেখে তখন আমার শিক্ষাদীক্ষা হ‌োঁচট খায়! গতি কমাতে চাইলে সেখানে রাস্তা মসৃন ও উন্নত না করে এবড়ো থেবড়ো অবস্থায় ফেলে রাখাই বেশি যুক্তিযুক্ত এবং কম খরচের অপশন। হাতির মত উঁচা স্পিডব্রেকারে একটি গতিময় গাড়ি যদি এসেই পড়ে তাহলে সেটার স্প্রিং ভাঙ্গবে এবং সেটা হটাত ঝাঁকিতে ব্যালেন্স হারিয়ে নিজেই দূর্ঘটনায় পতিত হবে। একান্তই যদি গতিসীমা কমাতে বলা হয় তাহলে সেখানে ছোট ছোট কয়েকটি স্পিডব্রেকার দেয়া উচিত যেটা গতিতে পার হলেও গাড়ির ক্ষতি হবে না, কিন্তু গাড়ির চালক টের পাবে যে গতি কমাতে বলা হচ্ছে। এর পরে একটু বড় স্পিডব্রেকার দেয়া যেতে পারে। ইদানিং দেশের হাইওয়েতে এরকম গুড়ি গুড়ি গুচ্ছ স্পিডব্রেকার দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলো দেখে কোন কোন ইতর গাড়িচালক দাঁত কেলিয়ে, তারপর আরো জোরে টান দিয়ে চলে যায়।

৩।
যেহেতু রাস্তা নকশা ও তৈরী করা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের কাজ, তাই সেই রাস্তার স্পিড-লিমিট বা নিরাপদ গতিসীমাও নির্ধারণ করে দেয় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। রাস্তায় গতিসীমা দেয়া কিন্তু খুবই ঝামেলার কাজ। কারণ, একটি উজ্জ্বল দিনে একটা নির্দিষ্ট রাস্তায় নিরাপদে যত দ্রুত গাড়ি চালানো সম্ভব, সেই একই রাস্তায় সন্ধ্যার আলো আঁধারীতে নিরাপদে চলতে হলে একটু কম গতিতে চলতে হবে। এর সাথে যদি যুক্ত হয় গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি, অর্থাৎ পিচ্ছিল বা স্লিপারি রাস্তা তাহলে নিরাপদ গতি আরো কম হতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন রকম গাড়ি, এবং তাদের ফিটনেস অনুযায়ীও নিরাপদে যাত্রার গতিসীমা কম বেশি হবে। যেহেতু দিনের বেলা, রাতের বেলা, বৃষ্টির সময় আলাদা আলাদা গতিসীমা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, তাই সবরকম বিপদের কথা মাথায় রেখে একটা রক্ষণশীল গতিসীমা লিখে দেয়া হয়। কিন্তু আসলে, একটি উজ্জ্বল শুকনা দিনে ঐ রাস্তায় ঐ গতিসীমার চেয়ে অনেক বেশি গতিতেও নিরাপদে চলা যায়। উন্নত বিশ্বে কিছু রাস্তায় ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ডে কন্ডিশন অনুযায়ী নিরাপদ গতিসীমা দেখানো হয়।

৪।
তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, “সামনে ক্যামেরা” সাইনবোর্ডটা দেখে যদি গাড়িচালক গতি কমিয়ে সেই লিমিটের মধ্যে গাড়ি চালায় তাহলে বোঝা যায় সে হুঁশে আছে, সবকিছু খেয়াল করতে পারছে। সুতরাং আগে-পিছে বেশি গতিতে গাড়ি চালালেও রাস্তায় যাত্রী ও গাড়ির নিরাপত্তাজনিত কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু কোন ড্রাইভার যদি সেই সাইন দেখে খেয়াল না করে, তখন সেই বেশি গতি অন্যদের ক্ষেত্রে নিরাপদ হলেও, ঐ চালক আসলে বেখেয়ালে গাড়ি চালাচ্ছে - যেটা রাস্তা ব্যবহারকারীগণের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ – সুতরাং ক্যামেরাতে ধরা পড়ে তার জরিমানা হওয়া যুক্তিযুক্ত।

জাপানি পুলিশ রাস্তার নিরাপত্তার মূল বিষয়টা সঠিকভাবে বুঝে বলেই ও ধরণের একটা সিস্টেম করেছে। সুতরাং তারা আসলেই জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছে। অযথা মানুষকে হয়রানি করার জন্য সিস্টেমকে কাজে লাগাচ্ছে না।

৫।
শুধু রাস্তায় গতিসীমাই নয়, এরকম আরো অনেক সিস্টেম আছে যেগুলো আসলে অক্ষরে অক্ষরে পালন করা আবশ্যকীয় নয়, ব্যাখ্যা জেনে সঠিক প্রয়োগ করা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু সেগুলো প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ অন্যদেরকে হয়রানি করার জন্য ব্যবহার করে। হতে পারে প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ ঐ নিয়মের মূল বিষয়টাই বোঝে না (না বুঝে মুখস্থ বিদ্যা), না হয় বোঝার চেষ্টাও করে না - অর্থাৎ নিপীড়ন করাই তাই মূল উদ্দেশ্য।

[ ইদানিং এরকম বেকুবি/ নিপীড়নের উদাহরণ দেখে পোস্টটির অবতারণা করলাম]