রবিবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৬

ফুকেট ও ব্যাংকক ভ্রমণ - ২

(আগের পর্বের লিংক: ফুকেট ও ব্যাংকক ভ্রমণ - ১)
৬।
প্লেনে উঠার পর আমি প্রায় প্রতিবারই এটার সেফটি ইনস্ট্রাকশনের পাতাটা খুঁটিয়ে দেখি। সেখানে প্লেনের মডেল নম্বর, কোন দিকে কয়টা দরজা; ইমার্জেন্সিতে কিভাবে বের হতে হবে প্রভৃতি ছবির মাধ্যমে দেয়া থাকে। আমার দেখাদেখি কন্যাও তার সিটের সামনের পকেট থেকে সেটা বের করে গম্ভীর মুখে দেখতে থাকলো। আমিও দায়িত্ববান বাবার মত ওকে টুকিটাকি প্রশ্নের জবাব দিয়ে সাহায্য করতে লাগলাম। লাইফ জ্যাকেটের বিষয়টা বুঝে সেটা কোথায় আছে একেবারে হাতে কলমে সিটের তলে দেখিয়ে দিতে হল। কে জানে, অজানা ভবিষ্যতে কোন দূর্যোগে এই লাইফ জ্যাকেট কিংবা ধোঁয়া থাকলে না হেঁটে হামাগুড়ি দিতে হয় এরকম এক-একটা ছোট বিষয় এক ঝলকে মনে পড়াতে ওর জীবন বাঁচতে পারে। সেরকম বিপদে এক সেকেন্ড আগে সঠিক কাজ করা হয়তো জীবন-মৃত্যূর পার্থক্য গড়ে দিতে পারে।

প্রথমবার আমি যখন প্লেনে উঠেছিলাম (ব্যাক ইন ২০০১), টেকঅফের সময়ে হঠাৎ করে যে টানটা দেয় সেটার ঝাকুনি আর কানটান বন্ধ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটায় বেশ ভয় পেয়েছিলাম বলে মনে পড়ে - "এ্যাত লোক প্রতিদিন ফ্লাই করে সমস্যা তো হয় না" - ভয় কাটানোর জন্য এই ভেবে নিজেকে প্রব‌‌‌োধ দিয়েছিলাম তখন। কিন্তু কন্যার দেখি তেমন কোন‌ চ্যাৎ-ভ্যাৎ (=প্রতিক্রিয়া) নাই - হয়তো ওর এক্সাইটমেন্ট এ্যাত বেশি ছিল যে টের পায়নি। এছাড়া একা একা ভ্রমণের অসহায় ফিলিংএর সাথে বাবা-মা'র সাথে ভ্রমণের আত্মবিশ্বাস বা নির্ভার-নিশ্চিন্ত থাকার বিষয়টা তুলনা করা যাবে না। টেকঅফের পর আর ল্যান্ডিঙের আগে প্লেন যখন এদিক সেদিক চিৎ কাইত হয় তখন এখনও আমার ভয় লাগে। কিন্তু মেয়ে দেখি তাতে আরও একটু এক্সাইটেড হয় – হুঁ হুঁ বুঝি - ভয় পাওয়ার মত বুঝদার হয়নি। আরেক পিচ্চির সাথে একবার রোলার কোস্টারে চড়েও আমার একই রকম অনুভুতি হয়েছিলো: শক্ত মাটিতে নেমে যখন আমি সুন্দর পৃথিবীতে আস্ত বেঁচে ফিরেছি বলে আপ্লুত তখন পিচ্চি আবার সেই রাইডে উঠতে চাচ্ছিলো!!

উপর থেকে ঢাকাতেও বেশ সুন্দর সুন্দর আল‌োকিত খেলনার মত স্ট্রাকচার দেখা যায়। পরিচিত শহরটাকে পুরাই অপরিচিত লাগে। টেকঅফের সময়ে লাইট নিভানো, আবার লাইট জ্বালানো এইসব ব্যাপারে মেয়েকে বেশ কৌতুহলী দেখা গেল।

৭।
প্লেনে চড়ার আসল মজা হল খাওয়া দাওয়া - অন্তত এই অঞ্চলের মানুষের কাছে। খাওয়া না দিলে আবার প্লেন কিসের! ঢাকা-যশোরের ফ্লাইটেও ঐটুকু সময়ের মধ্য খাওন দেয় – অবশ্য ঐটুকু সময় ফ্লাই করলেও একেকজনকে এয়ারপোর্টে আসা এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্লেন ডিলে তথা ঢিলে চলার জন্য প্রচুর সময় ব্যয় করতে করতে ক্ষিদে পেয়ে যায় নাকি সব ভূখা’র দল প্লেনে উঠে তা রহস্যাবৃত। আর প্লেনে খাওয়া দাওয়া করাটা একটা আর্টও বটে – ঐটুকু জায়গার মধ্য হাতের কনুই মাত্র ৪-৬ ইঞ্চির বেশি না নাড়িয়ে, জিনিষপাতি জায়গামত রেখে খাওয়াটা প্র্যাকটিস ছাড়া কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। তবে দেশী অনেকেই সম্ভবত আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে হার্ড ড্রিংকের বিষয়ে বেশি আগ্রহী … থাক ঐদিকে আর না যাই।

হাউজফুল প্লেনের সামন আর পেছন দুই দিক থেকে দুইটা ট্রলিতে করে খাবার সার্ভ করা শুরু করলো। আমরা পেছনের দিক থেকে ৪ কি ৫ সারি সামনে, সুঘ্রান আসে কিন্তু খানা খাদ্য আর আসে না। সামনে খাবার দিয়ে খালি ট্রলি নিয়ে পেছনে যায়; হাসতে হাসতে হাত করে একগাদা ট্রে নিয়ে সামনেরটায় লোড করে, কিন্তু পেছনের বান্দা আর আমাদের পর্যন্ত আসে না। আমরা ভদ্র মানুষের মত হেডফোনের চ্যানেল পাল্টাই; অন বোর্ড শপিংয়ে কি কি পাওয়া যায় সেগুলো পত্রিকায় খুঁটিয়ে দেখে দেখে প্রায় মুখস্থ করে ফেলি। মেয়ের ক্ষুধায় কাতর মুখের দিকে তাকাতে পারি না। এক্কেবারে শেষ ভূখা হিসেবে আমরা খাদ্য পেলাম – এর মধ্যে আমাদের আগে পিছের সকলে রিফিল খানা-খাদ্য-ড্রিংকস চেয়ে নিচ্ছে। বুঝলাম যে ব্যাটা .. না ইয়ে মানে যে কেবিন ক্রু পেছনের দিকে সার্ভ করছিলো সে নিতান্তই আনাড়ি, সম্ভবত সেদিনই ওর ফার্স্ট ফ্লাইট – এ্যাত মানুষজন দেখে পুরা আউলায় গেছে। অন্য কেবিন ক্রুদের ওর দিকে তাকিয়ে বোকা বোকা হাসি আর চোখের চাহনি দেখে সেটা আরও পরিষ্কার বোঝা গেল। যা হোক, তাও দিতে পেরেছে এই ভেবেই সেবার কৃতজ্ঞ হলাম। কে কিভাবে ঝাপিয়ে পড়ে কোন স্টাইলে খেল সেই ডিটেইলে না যাই, সংক্ষেপে: খাদ্য বেশ উপাদেয় ছিল।

৮।
আড়াই ঘন্টার ফ্লাইট লঙ্গরখানার সার্কাস দেখতে দেখতেই শেষ। বিপদআপদ ছাড়াই ব্যাংককে ল্যান্ড করলাম। ব্যাংককে বের না হয়ে সরাসরি ফুকেট বা অন্য জায়গায় যাওয়ার আরও কিছু যাত্রী ছিল। নামার পর তাদেরকে অন্যদিকে ট্রান্সফার ডেস্কে যেতে হল। অনেকদুর হেঁটে যখন সেখানে পৌছুলাম দেখি আমরাই প্রথম … আর কেউ নাই … সব খা-খা করছে। একটু পরে আরও দুটি দেশি পরিবার আসলো - সম্ভবত হানিমুন কাপল। আমাদেরকে এখানেই সকাল ৫:৩০ পর্যন্ত প্রায় ৪ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে।

প্রথম কাজ হল দেশে খবর দেয়া যে প্লেন ক্রাশ-ট্রাশ হয় নাই। জীবিত অবস্থায় পৌঁছেছি। কী করা যায় ভাবতে ভাবতেই এয়ারপোর্ট ওয়াই-ফাইয়ে লগ-ইন করে ফেলতে পারলাম। কাজেই নিজেদের খ‌োমার ছবি তুলে সেটা ফেসবুকে পোস্ট দিলাম। এখন এই ছবি দেখে যদি কোনো দু্ষ্টু বান্দা জেনে ফেলে আমরা বাসায় নাই, কিংবা তাদের খপ্পড়ে পড়ার মত কাছাকাছি আছি তাহলে তো সমস্যা। তাই ভেবে চিন্তে ছবির প্রাইভেসি দিলাম ‘অনলি মি’, আর তাতে ছোটভাই আর শ্বশুরআব্বাকে ট্যাগ করে দিলাম। এতে আমি আর এই দুইজন ছাড়া আর কারো এই ছবি দেখার কথা না। নিজের মা’কে আরও দ্রুত জানাতে হলে মেজ ভাইয়ের বউকেও ট্যাগ দিতে পারতাম – কারণ মা-সহ ওরা এক বাসাতেই থাকে, কিন্তু দিলাম না – কারণ আমার সন্দেহ উনি বিবিসি প্রকৃতির – তাই প্রাইভেসির মূল উদ্দেশ্য ব্যহত হবে।



৯।
ড্রিংকিং ফাউন্টেন থেকে পানি খাওয়াটা রপ্ত করতেও যথেষ্ট প্র্যাকটিসের দরকার। এখানে মেয়েকে সেই ট্রেনিং দিয়ে দিলাম। যথারীতি বিশাল এয়ার কন্ডিশনড ফাঁকা স্পেশ পেয়ে সে দৌড়াদৌড়ি আর এক্সপ্লোর করে সময় কাটাতে থাকল। এদিকে আমি এক দিকে কয়েকটা চেয়ারের উপরে শুয়ে ঘুমিয়ে নিলাম একটু।

সকালে কোত্থেকে জানি আরও একদল জাপানি এসে লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। লোকজন দেখে ভাল লাগলো, সেই এনসিয়েন্ট মেরিনারের মত। সময়মতই বেশ সুইফটলি ইমিগ্রেশন পার হয়ে পরের ফ্লাইটের বোর্ডিংএর জায়গায় চলে গেলাম। একটা বাসে করে নিয়ে এসে আমাদের প্লেনে তুলে দিল। বাসের ঢুলুনির ইফেক্টে নাকি ক্লান্তিতে নাকি ভোর হওয়া দেখতে পাওয়ার আনন্দে প্লেনে উঠেই কন্যা ঘুমিয়ে পড়লো। প্লেনও সময়মত ছাড়ার জন্য ট্যাক্সি ওয়েতে টেনে নিয়ে গেল, কিন্তু তারপর খুক্ খুক্ করে করে ইঞ্জিন আর স্টার্ট নেয় না। বেশ কিছুক্ষন পর ঘোষনা দিল যে ‘টেকনিকেল সমস্যা’।

আমাদের আবার প্লেন থেকে নেমে বাসে করে টার্মিনালে আরেকটা বোর্ডিং লাউঞ্জে বসিয়ে রাখলো। সেটার সামনের বোর্ডিং ব্রীজে অন্য আরেকটা প্লেন আমাদের জন্য প্রস্তুত করতে লাগলো। আগের প্লেন থেকে এই পর্যন্ত এবং পরের প্লেনে উঠা পুরা সময়ই কন্যা গভীর ঘুমে অচেতন – কাজেই তাকে কোলে করে বহন করার মহান দায়িত্ব পালন করলাম নিষ্ঠার সাথে। সব মিলিয়ে এই ফ্লাইটে আড়াই ঘন্টা ডিলে হল। বাইরে ঝলমলে র‌োদ। চাইলে জানালা দিয়ে অনেকদুর দেখাও যায়, কিন্তু যার জন্য এ্যাত কিছু ভেবে রাখলাম সে-ই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে রইল।

১০।
ফুকেট পৌছানোর সময় নামার আগে দারুন সব পাহাড় আর সমূদ্র দেখা যায় জানালা দিয়ে। মেয়ে তখনও ঘুমাচ্ছে। প্লেন ল্যান্ড করার পর জোর করে ঘুম থেকে তুলে হাঁটিয়ে নিয়ে, লাগেজ কালেক্ট করে বের হলাম। বের হয়ে মি: শর্মা, মি: অমুক, মি: তমুক লেখা প্ল্যাকার্ড আর কাগজ নিয়ে অনেকেই অপেক্ষা করছে দেখলাম – খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খুঁজেও আমাদের জন্য কাউকে অপেক্ষারত পেলাম না। কী করি কী করি ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত সেই মি: রুবেলকে ফোন করার কথাই মনে আসলো – কারণ আমাদের ট্রাভেল এজেন্টের কাগজপত্রে তাঁর সাথেই সকল বিষয়ে যোগাযোগের কথা বলা আছে।

কিন্তু ফোন করবো কিভাবে! আশে পাশে কোনো ফোন দেখছি না। বউকে দিলাম ঝাড়ি – আয়‌‌োজক হিসেবে এসব ব্যাপার আগে থেকে তার জেনে আসার কথা। বললাম, নিজে খুঁজে বের কর কিভাবে কী করবা।

১১।
এয়ারপোর্ট বিল্ডিংএর গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘামছি, বিরক্ত হচ্ছি। মেয়ের ঘুম পুরা হয়নি, তাই সে ঢুলতেছে – কোলে উঠতে চায়, রেলিংএ বসে ঘুমায় – ওয়াক ওয়াক করে (এটা পুরাতন ব্যাপার আমাদের জন্য)। ওদিকে বউ আবার সিকিউরিটি চেকটেক করে লাউঞ্জে ঢুকে কয়েন ফোন থেকে না পেরে একজন অফিসারের মোবাইল থেকে শেষ পর্যন্ত যোগাযোগ করতে পেরেছে। প্রায় ৪০ মিনিট বাইরে কাটানোর পর যোগাযোগ করার ৫ মিনিটের মধ্যে ট্যাক্সি হাজির। আগেও নাকি ট্যাক্সি এসেছিলো, আমাদের না পেয়ে চলে গেছে – আড়াই ঘন্টা প্লেন লেটের ব্যাপারটা খোঁজ নেয়নি।

একটা বিষয় আগে থেকে জানা থাকলে এই সমস্যাটা হত না। এয়ারপোর্টর ভেতরে সহ বিভিন্ন দোকানে টুরিস্টদের জন্য ৭দিন মেয়াদি ১০০ বাথের টক-টাইম সহ এক্টিভ সিম (মোবাইলের) পাওয়া যায়; দাম সম্ভবত ৩০০ বাথ (= প্রায় ৭০০ টাকা) - এটা কিনে মোবাইলে লাগিয়ে নিলেই হল। এটা ইতিমধ্যে চোখে পড়েছিলো কিন্তু গুরুত্ব দেইনি বা তেমনভাবে খেয়াল করিনি। যা হোক এই তথ্যটুকু আশা করি কারো কাজে লাগবে।

১২।
এয়ারপোর্ট থেকে পাতং এ হোটেল ৪০ মিনিটের ড্রাইভ। চমৎকার ল্যান্ডস্কেপের মধ্য দিয়ে সুন্দর রাস্তা, মাঝে পাহাড়ে উঠানামাও আছে – দারুন সিন-সিনারি। মেয়ে ঘুমন্ত থাকাতে এসবই মিস করেছে। আসার পথে ড্রাইভার ব্যাটা কন্টিনিউয়াস ফোনে কথা বলেছে – যা বেশ বিরক্তিকর ও রিস্কি ছিল। হোটেলটা ছিল বিচ থেকে এক ব্লক ভেতরে - এটা অবশ্য আসার আগেই একবার গুগল ম্যাপে দেখে রেখেছিলাম। দেখলাম রাস্তা দিয়ে কোথাও কোথাও গোসল শেষে সংক্ষিপ্ত প‌োশাক পড়া লোকজন হোটেলে ফিরে যাচ্ছে!

হোটেলে আসামাত্র কাউন্টারের সামনে শরবত আর ফুলের মালা দিয়ে (!!) স্বাগতম জানালো এক মহিলা। পরে বুঝলাম – এই ফুলের মালা আসলে একটা ধান্দার অংশ; ভুজুং ভাজুং বুঝ দিয়ে অন্য আরেক হোটেলের প্রমোশন সেমিনারে নেয়ার জন্য চেষ্টা। বিষয়টা গিন্নি ধরতে পারলো আর আমাকে কড়া করে এইসব সুন্দরী মহিলাদের ট্র্যাপে না পড়ার কথা বললো। আমিও সুড়সুড় করে ঐ মহিলাকে বুঝিয়ে বললাম, আমাদের টাইম খুবই কম, ট্যূর আগে থেকেই বুক করা আছে, তাই এসব সেমিনারে যাওয়া সম্ভব না। যা হোক ৫ তলার রূমে গিয়ে মনটা ভাল হয়ে গেল। ছিমছাম রুম, একদিকে বারান্দা আছে। এসি, টিভি, গরম পানি ইত্যাদি ৩-স্টারসুলভ জিনিষপাতি সবই আছে।

১৩।
ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিয়ে তিনজন হোটলের নিচতলায় থাকা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করতে নামলাম। থাইফুড, ড্রিংকস ইত্যাদি খুব মজা করেই খেলাম। এরপর একটু আশপাশটা ঘুরতে বের হলাম। আসার পথেই জায়গায় জায়গায় সেভেন-ইলেভেন দেখেছিলাম – যা ছিল স্বস্তিদায়ক; কারণ আমি এবং গিন্নি দুজনেই জাপানে এই চেইন শপে গিয়েছি বহুবার। হোটেলের সামনেই রাস্তার অপরপাশে এই দোকান পেলাম। আশে পাশে একটু হেঁটে তারপর এখান থেকে আরো খাবার দাবাড়, পানি ইত্যাদি কিনে রুমে ফিরলাম।



ছাদের উপরে একটা সুইমিং পুল আছে, সেটা দেখতে ছাদে গেলাম। কিন্তু পুলে নামার উপযুক্ত জামা-কাপড়ের অভাবে নামা হল না। ভাবলাম, সময় করে এসে একবার এখানে নেমে দেখবো। পুলের পাশের চেয়ারগুলোতে বসে আইসক্রিম খেয়ে (দুপুরে কেনা, রুমের ফ্রিজ থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম), আর চারপাশের পাহাড় আর সাগরের দৃশ্য দেখে চলে এলাম।



১৪।
ছাদে থাকা অবস্থাতেই সূর্য ডুবে গিয়েছিলো, কাজেই সৈকতে গিয়ে সূর্যাস্ত দেখা হল না সেদিন। কিন্তু সৈকত দেখতে এসে সেটা কি না দেখে থাকা যায়। কাজেই পরবর্তী গন্তব্য পাতং সী বীচ। হোটেল থেকে বের হয়ে বামে ১০০ ফুটের মত এগিয়ে পরই ডানের রাস্তাটা সোজা বীচে চলে গিয়েছে। সন্ধ্যা বেলা ডানের সেই রাস্তাটা দেখে আমি আর বউ চোখাচোখি করে বললাম – ব্যাপারস না। কারণ রাস্তাটা মূলত নাইট-লাইফ সংশ্লিষ্ট রাস্তা। রাস্তায় গাড়ি চলে না, শুধু পায়ে হেঁটে যাওয়া যায় – পুরা রাস্তাই যেন একটা মেলা। রাস্তায় লোক গিজগিজ করছে, দুপাশে সারি সারি রেস্টুরেন্ট, বার, নাইটক্লাব, দোকানপাট – উচ্চস্বরে গান বাজছে, কোথাও লাইভ কনসার্ট হচ্ছে। দুই তিন জায়গায় বারের উপরে মেয়েরা সংক্ষিপ্ততম পোশাকে পোল ড্যান্স দিচ্ছে। রাস্তার নাম “বাংলা রোড”!!

এখানেও কন্যার অবশ্য তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া, কিংবা "এ্যাত ছোট পোশাক ছিঃ" এই টাইপের বেফাঁস কিছু বলতে শুনলাম না। বরং এটাই স্বাভাবিক এমন ভাব নিয়ে আমাদের সাথে ঘুরে বেড়ালো।! আগ্রহী হলে গুগল মামাকে একটু এই নাম “বাংলা রোড, ফুকেট” বা “বাংলা রোড পাতং বীচ” দিয়ে টোকা দিয়ে দেখতে পারেন কি বুঝাতে চাচ্ছি। আপাতত ৩য় দিন সকাল বেলা তোলা ছবি দেখেন। দিনে সব স্বাভাবিক পূতঃপবিত্র রূপ দেখে কল্পনাও করতে পারবেন না রাতে কী চলে এখানে ...






আলো-আঁধারিতে ছবি উঠবে না, তাই ভীড়ের মধ্য দিয়ে তিনজন আস্তে আস্তে জায়গাটা পার হয়ে গেলাম। রাস্তাটা বীচের পাশের রাস্তাতে গিয়ে লেগেছে। রাস্তার ওপারেই পাতং বীচ। রাতেও বীচের পানিতে পা ভিজিয়ে হাঁটা, ঝিনুক কুড়ানো, সেলফি তোলা পার্টির কমতি নাই। আমরা কিছু খাবার দাবাড় নিয়ে গিয়েছিলাম বাংলা রোডের সেভেন ইলেভেন থেকে। বীচে বহুক্ষন ঘোরাঘুরি করে ওপাশের ফুটপাথে হাঁটলাম। এক জায়গায় ঝোলাঝুলি করার জন্য গাছ থেকে মোটা দড়ি আর তার মাথায় একটুকরা গাছের ডাল দিয়ে রেখেছে। কয়েক বার কাপল, ট্রিপল লোকজন হাঁটতে হাঁটতে এসে ওটা দেখে ঝোলাঝুলি করে বা দোল খেয়ে গেল। ফুটপাথের উপর সাদা কাঁকড়া এদিক সেদিক দৌড়াচ্ছে মাঝে মাঝে। কাঁকড়াগুলো সামনের দিকে না বরং পাশের দিকে দৌড়ায়, আর হঠাৎ হঠাৎ স্ট্যাচুর মত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে – দেখলে মনে হয়ে কিছু একটা পড়ে আছে - গ্রেট টেকনিক।



১৫।
ঘন্টাখানেক বীচের হাওয়া খেয়ে ফেরার পথে বাংলা রোডে ম্যাকডোনাল্ডে ঢুকে খাওয়া দাওয়া সারলাম। ফেরার পথে নাইট লাইফ আরো একটু বেশি গিয়ারে চলছে মনে হল। প্রায় শেষরাত পর্যন্ত এখানকার হট্টগোল শোনা গিয়েছিলো হোটেল থেকেই। পরদিন আমাদের প্যাকেজে থাকা ট্যূর। হোটেলের ফোন থেকে এ বিষয়ে জানতে ট্রাভেল এজেন্টকে ফোন দিলাম – বললো সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ৭টার মধ্যে পিক করবে হোটেলের লবি থেকে; আরও জানালো সেভেন ইলেভেনেই ৭দিনের সীম কার্ড পাওয়া যায় – ইচ্ছা করলে কিনে নিতে পারি, এতে যোগাযোগের সুবিধা হবে।

ফোনের পর পরই নেমে সামনের 7-Eleven থেকে সীম কার্ড কিনলাম। এই হোটেলেও ওয়াই-ফাই সুবিধা ছিল।

পরদিনও সন্ধ্যায় সী-বিচে গিয়েছিলাম পা-ভিজিয়ে হাঁটার জন্য। ফেরার পথে সেদিন বীচের ধারে একটা পিজার দোকানে ঢুকেছিলাম পিজা খাওয়ার জন্য। সাথে ফিশ ফিঙ্গারও খাওয়া হল। এখানে লোকজন দেখি এসি-ইনডোরের চেয়ে আউটডোরেই বেশি থাকতে চায়। তাই আমরাও বাইরেই বসেছিলাম। এর মধ্যে একটা স্ট্যান্ডার্ড সাইজের তেলাপোকা হেলেদুলে ফ্লোরে ঘুরে বেড়াতে লাগলো … হয়তো কোনো গাছ থেকে নেমেছে। সেটা দেখে পাশের টেবিলের দুই মহিলা মোটামুটি দোকান থেকে ভেগে গেল। আর অন্য পাশের টেবিলে আসা ৫ জন দশাশই আরব যুবক পা-টা তুলে একাকার অবস্থা। এইসব দেখে লজ্জা নাকি দূঃখে তেলাপোকা চলে গেল।



(পরের পর্বের জন্য এখানে ক্লিক করুন: ফুকেট ও ব্যাংকক ভ্রমণ - ৩)

কোন মন্তব্য নেই: