মঙ্গলবার, ৩০ অক্টোবর, ২০০৭

পাসপোর্ট নবায়ন করিয়েছিলাম

২০০৬ সালের কথা। এই বছরের মাঝামাঝি সময়ে আমার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে তাই নবায়ন করতে হবে। সে সময়ে থাকতাম জাপানে। রিসার্চের কাজে বছরে গড়ে চারবার করে দেশে যেতে হলেও সেই সফরের স্বল্প সময়ে পাসপোর্ট অফিসের খপ্পরে পড়তে মন সায় দেয়নি। বলা তো যায় না, শেষে দেখা যাবে আমার কনফার্ম করা রিটার্ন টিকিটের ফ্লাইটে চড়তেই পারছি না। তাছাড়া ডেটা সংগ্রহের কাজে ঢাকার বাইরে থাকা অবস্থায় এদিকেও তদারকি করা সম্ভব না। তাই ঠিক করলাম কপালে যাই থাক জাপান থেকেই পাসপোর্ট নবায়ন করাবো।

বাংলাদেশ এম্বেসীর ওয়েবসাইট ঘেটে জানতে পারলাম কিভাবে কী করতে হবে। ফর্ম ডাউনলোড করে সেটা পূরণ করে সবচেয়ে দ্রুত করার জন্য প্রয়োজনীয় ফী সহ পাসপোর্টটি পোস্ট করে দিলাম এম্বেসীর ঠিকানায়। দুই দিন পরে ফোন করে জানলাম জিনিষ পৌছেছে জায়গামত। তারপর শুধু অপেক্ষা।

৩ দিনে নবায়ন করার জন্য প্রয়োজনীয় ফী সহ পাঠিয়েছিলাম, সেই হিসেবে সব মিলিয়ে মোট ৭ দিন (২+৩+২) লাগার কথা। কিন্তু ৮ দিন পরেও কোন খবর নাই। একটু টেনশন লাগছিল। অবশ্য পরে ভাবলাম, এখানেও বোধহয় পাসপোর্ট অফিসের কালচার হবে ... দালাল টাকা নেয় ৩ দিনের তারপর ঘুরাতে থাকে। অবশেষে ১৫ দিন পরে দেয়। ৩ দিনের চেয়ে ১৫ দিনের ফী অনেক কম। বাকী টাকা দালালের পকেটে।

তাই, অপেক্ষা করতে থাকলাম। এখানে হয়তো ৭ দিনের অপশনে করবে। যা ভেবেছিলাম তাই হল বোধহয় ১১ দিনের (২+৭+২) মাথায় পাসপোর্ট হাজির। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হল কিছু টাকা (ইয়েন) ফেরৎ এসেছে। এম্বেসীর কর্মকর্তা ৭ দিনের ফী জমা রেখে বাকী টাকা (ইয়েন) ফেরৎ পাঠিয়ে দিয়েছে।

শুক্রবার, ২৬ অক্টোবর, ২০০৭

ভারত ভ্রমনের কবলে!

পরিকল্পনাটা ছিল এমন - ২৩শে সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে জাপানে পি.এইচ.ডি. শেষে দেশে ফিরে একবার ভারত ভ্রমন করবো। কারণ এর পরপরই আমার স্ত্রী মাস্টার্সে ভর্তি হবে তাই এর আগেই ভারত ভ্রমন করতে হবে। তাছাড়া পরবর্তীতে বাচ্চা কাচ্চা হয়ে গেলে ওদের নিয়ে ইউরোপ/আমেরিকা ভ্রমন করা গেলেও ভারত ভ্রমন করা যাবে না।

যেই ভাবা সেই কাজ। ভারতে ভ্রমনের জন্য ভিসার আবেদন করলাম অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে (১লা অক্টোবর)। পরিকল্পনা ছিল স্থলপথে বাসে ঢাকা-কলকাতা হয়ে ট্রেনে দিল্লি তারপর আগ্রা, জয়পুর, আজমির ঘুরে ঢাকা ফেরৎ। ইতিমধ্যে আবার বুয়েটে মাস্টার্সের সার্কুলার দিয়েছে যেখানে আমার স্ত্রী ভর্তিচ্ছু। সামনে পড়েছে ঈদুল ফিতর আর তার পরে পুজার বন্ধ। লম্বা ছুটি বলে ভ্রমনেচ্ছু ভিসাপ্রার্থীপ্রচুর। আমাদের পক্ষেও দেরীতে গেলে ওর মাস্টার্সের ভর্তির আনুষ্ঠানিকতায় অংশগ্রহন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তাই গেলাম ভিসার আবেদনপত্র জমা দিতে।

আগের সপ্তাহেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া আমার ছোটভাই ভারতে বেড়াতে যাওয়ার জন্য ভিসার আবেদন জমা দিতে গিয়েছিল। লাইনে প্রায় ২০০০ প্রার্থীর পেছনে দাঁড়িয়েছিল। তখন একজন দালাল এসে বলেছিলো যে, ৩০০ টাকা দিলে সামনে ভালো জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেবে। অনন্যোপায় হয়ে ও তাই করে প্রায় ২০০ জনের পেছনে দাঁড়াতে পেরেছিলো। ভিসার আবেদনপত্র জমা দিতে পেরেছিলো, ভিসাও পেয়েছিলো। অবশ্য এজন্য ওকে একবার বাসায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র এবং ফলাফলের ফটোকপি দিতে হয়েছিলো ছাত্রত্ব প্রমাণের জন্য। ভিসার জন্য এমন লম্বা লাইনের কথা শুনে একটু আশাহত হয়েছিলাম। পরবর্তীতে আমার স্ত্রীর পরিচিতা একজন জানালেন যে, মহিলাদের লাইন অনেক ছোট হয় আর সেখানে জমা নেয় তাড়াতাড়ি।

আমার এবং স্ত্রীর ভিসা আবেদনপত্র জমা দিতে সকাল ৭টায় হাজির হলাম ভিসা অফিসের কাছে। পুরুষদের লাইন ভিসা অফিস থেকে বেশ দুরে অবস্থিত গুলশান শুটিং ক্লাবের সামনে চলে এসেছে ইতিমধ্যে, কিন্তু মহিলাদের লাইন অনেক ছোট - ১৩৪ জনের পেছনে দাঁড়ালো। জমা নেয়ার সময়ও মহিলাদের ক্ষেত্রে দ্রুত জমা নিল এবং সকাল ১০:৩০ এর মধ্যে জমা দিয়ে বের হয়ে এলো। অবশ্য টুরিস্ট ভিসার জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার শেষ সার্টিফিকেটের ফটোকপি চাইলো।

পরদিন পেয়ে গেলাম দুটি পাসপোর্ট। স্ত্রীকে ভিসা দিয়েছে আর আমারটিতে ভিসা দেয়নি। পাসপোর্ট তুলতে গিয়েছিলো আমার স্ত্রী - ও কাউন্টারে জিজ্ঞেস করেছিল কেন এই অবস্থা? বলেছিলো যে আমার কাগজপত্রে ওদের মনে সন্দেহ হয়েছে - শিক্ষাগত সার্টিফিকেটের সত্যয়িত ফটোকপি (অনুলিপি) দিতে হবে!! দুজনের কাগজপত্র একই হওয়া সত্ত্বেও একজনকে নিঃসন্দেহে ভিসা দিল আর আরেকজনকে দিল না ... তা-ও টুরিস্ট ভিসার আবেদনে শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট চেয়ে!

আমার শ্বাশুড়ী শিক্ষকতা করেন। সাম্প্রতিক সময়ে ওনার কয়েকজন সহকর্মীও ভিসার জন্য আবেদন করেছিলেন ... স্ত্রীকে দিয়েছে স্বামীকে দেয়নি - এমন হয়েছে সকলের ক্ষেত্রেই। আমার শ্বশুড়ের পরিচিত অনেক সহকর্মীরও একই অবস্থা। কিছু কাহিনী শুনলাম যে, বাবা-মা, আর বাচ্চার মধ্যে বাচ্চাকে ভিসা দিয়েছে, বাবা-মা কে দেয়নি। চিকিৎসার্থে ভারতগামী রোগীর সহযাত্রীদের ভিসা হয়েছে কিন্তু রোগীর হয়নি। অথচ, ভিসা অফিসের বাইরে কিছু লোক বলছে যে পাসপোর্ট প্রতি ৪০০০ টাকা দিলে ভিসা পাইয়ে দিবে। এসব দেখে মূলা ঝূলানো স্টাইলে ভিসা দেয়ার কারণ অনুমান করা যায়!

যা হোক পরদিন আবার সকাল ৬:৩০শে গিয়ে লাইনে দাঁড়ালো। এত সকালেও প্রায় ৩০০ জন মহিলার পেছনে দাঁড়ালো আমার স্ত্রী। আজকে কিন্তু আগের দিনের মত মহিলাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফর্ম জমা নেয়নি। শেষ পর্যন্ত প্রায় ১২:৩০শে ভিসা জমা দিতে ঢুকে ২:৩০শে জমা দিয়ে বের হয়ে আসলো। সাধারণত দুপুর ১২টা পর্যন্ত ফর্ম জমা নেয়, কিন্তু প্রার্থী বেশি বলে প্রায় দুপুর ১টা পর্যন্ত ফর্ম জমা নিয়েছে । কিন্তু তা পরদিনের খাতে জমা নেয়া দেখিয়েছে। পরদিন বৃহস্পতিবার হওয়ায় ওদিনের জমা পাসপোর্ট ফেরৎ দিবে পরের রবিবার (শুক্র, শনি সাপ্তাহিক বন্ধ)। আমার ছোটভাইয়ের স্ত্রীও লাইনে দাঁড়িয়েছিলো কিছুটা পেছনে। ওর ১০/১২ জন আগে গেট বন্ধ আর জমা নিবে না বলে ঘোষণা আসলো, অথচ তার কিছুক্ষণ আগে কনসুলার এসে বলে গিয়েছিলো যে সমস্ত মহিলাদের জমা নেয়া হবে। বেচারী ৭টায় এসে লাইনে দাঁড়িয়েছিলো। নিরাপত্তারক্ষীগণ টাকা খেয়ে লাইনের সামনে কয়েকজনকে ঢুকিয়েছে .... এরা (নিরাপত্তারক্ষীরা) লাইনের পেছনের দিকে এসে বলে লাইন সোজা করেন ইত্যাদি, আর সামনের দিকে লাইন নেই - সব বিশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে। তাদেরকে যতই বলা হয় সামনের লাইন ঠিক করেন ততই না শোনার ভান করে ... ওখানে অবৈধভাবে লাইনে দাঁড় করাচ্ছে, কাজেই লাইন সোজা হলে তো সমস্যা! এই দিন ছিলো প্রচন্ড গরম। গরমে ডিহাইড্রেশন হয়ে বেচারী কাহিল, রাস্তায় প্রায় পড়ে যাওয়ার দশা।

ইতিপূর্বে অতিকষ্টে রবিবার রাত্রে ছেড়ে যাওয়া ঢাকা-কলকাতা বাসের টিকিট পেয়েছিলাম। তাই রবিবার বিকালে খুব চিন্তায় থাকলাম পাসপোর্ট ফেরৎ পাওয়া নিয়ে। কিন্তু আমার পাসপোর্ট আর পাওয়া গেল না। ওদিকে অফিসের ভেতরে আমার স্ত্রীর তদন্তে বের হল যে, যেগুলো পাসপোর্টে ভিসা দিয়েছে সেগুলোতেও আমার পাসপোর্ট নেই, যেগুলো ভিসা পায়নি সেগুলোতেও নেই। সম্ভবত আমাকে সাক্ষাতকার নিতে ডাকবে। আমার বাসের টিকিটের দেড় হাজার টাকাও গচ্চা গেল।

পরদিন আমাকে ভিসা অফিস থেকে ফোন করে সাক্ষাতকারের স্লিপ সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে বললেন। তারও পরের দিন সাক্ষাতকার দিতে গেলাম। এবার আমার চাকুরীর কাগজপত্র দেখতে চেয়েছেন কর্তৃপক্ষ (!! টুরিস্ট ভিসা চেয়েছিলাম)। সাক্ষাতকারটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক ছিলো আমার জন্য।

বললো, আপনি এর আগে গতবছর ভারতে গিয়েছিলেন ... বললাম হ্যা মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা ছিল, প্রফেশনাল কাজে গিয়েছিলাম। আমার রেফারেন্সের কথা জিজ্ঞেস করল ... জানালাম একজন আমার আপন মামা, আরেকজন একটি এন.জি.ওর প্রধান যার সাথে আমাদের প্রফেশনাল কাজ হয়। আমাকে চাকুরীর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করাতে বললাম যে আমি দুই সপ্তাহ আগে জাপান থেকে ফিরেছি, এই মুহুর্তে বেকার। জাপান যাওয়ার আগের কাগজপত্র দেখতে চাইলো তখন ... বললাম, সেগুলো আমার আছে তবে সাথে নিয়ে আসিনি, তাছাড়া আমার আর ভিসার প্রয়োজন নেই, এমনকি ভিসা দিলেও আমি ভারতে যাবো না, কারণ আমার বাসের টিকিট করা ছিলো আরো দুই দিন আগে; এখন চেষ্টা করলেও টিকিট পাবো না, আর ঈদ/পূজার বন্ধের পরেও আমার যাওয়া সম্ভব নয় কারণ আমার স্ত্রীর মাস্টার্সের ভর্তি সংক্রান্ত কাজগুলি পড়বে সেই সময়ে। জবাবে সাক্ষাতকারগ্রহনকারী বলেন যে এমন করলে আপনি কিন্তু আপনার পাসপোর্ট আর ফেরৎ পাবেন না। আমি লোকটির স্পর্ধা দেখে অবাক হয়ে গেলাম - আমার দেশে বসে আমার পাসপোর্ট আটকে রাখতে চায়!! পরে মনে হল, উল্টা পাল্টা বলে আমাকে ভয় দেখাতে চাচ্ছে যেন আমি অন্যপথে যেতে চাই (বাইরে তো দালালরা দাঁড়িয়ে আছেই)। যা হোক আমি জবাবে বললাম, আমার পাসপোর্ট ফেরত পাওয়ার অধিকার আমার রয়েছে। শুনে ব্যাটা বলে যে, আমার রিপোর্টের উপর নির্ভর করছে আপনার পাসপোর্টের কী হবে, এমন হতে পারে আপনাকে আর কখনো ভারতে ভিসা দেয়া হবে না .... আমি বললাম, আমার অসুবিধা নেই। তখন ঐ লোক আরো বলে, এমন হতে পারে আপনার পাসপোর্ট আমরা ফেরৎ দেবো না, আপনার দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে ফেরৎ পাবেন ... জবাবে আমি বললাম, আমার কোনই অসুবিধা নেই, আপনার যেমন ইচ্ছা রিপোর্ট লিখুন তবে আমার পাসপোর্ট ওভাবে ফেরৎ দিলে আমাকে সঠিক ভাবে সেটা আপনাদের জানাতে হবে। তবে পাসপোর্টটি আগামী ১৭ তারিখের আগে ফেরৎ দেবার দরকার নেই। আজ সন্ধ্যায় আমি কুড়িগ্রাম যাচ্ছি। চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কুড়িগ্রাম কোথায়? ... বললাম দেখুন আমার পাসপোর্টে আমার স্থায়ী ঠিকানা লেখা আছে, ওখানে আমার দাদার বাড়ী। ভারতে যেহেতু যেতে পারছি না, তাই ওখানেই যাবো; আমাকে ভিসা দেয়ার দরকার নেই, শুধু পাসপোর্টটি ফেরৎ দিবেন। সাক্ষাতকার শেষ। আমি জিজ্ঞেস করলাম আমার পাসপোর্টের জন্য কোথায় যোগাযোগ করবো - বললেন যেখানে জমা দিয়েছেন সেখানে। এখানে বলে রাখা ভালো, সাক্ষাতকারটি হয়েছে ভারতীয় দূতাবাসের ভিসা সেকশনে, আর পাসপোর্ট জমা নেয় অন্য একটি ভবনে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার অধীনে।

আমার ছোটভাই অতিকষ্টে বাসের দুটি টিকিট কেটে রেখেছিলো লালমনিরহাট হয়ে বুড়িমারী সীমান্ত পথে ভারত যাওয়ার উদ্দেশ্যে কিন্তু ওরা তো ফর্ম জমা দিতেই পারেনি। তাই ঐ টিকিটে আমি আর আমার স্ত্রী লালমনিরহাট হয়ে কুড়িগ্রাম চলে গেলাম। বেশ আনন্দের সাথে ঈদ করলাম সেখানে।

২২-অক্টোবর গিয়েছিলাম পাসপোর্ট আনতে। দেখি, পাসপোর্ট এসেছে (সাক্ষাতকার গ্রহণকারী ব্যাটা আমাকে ব্লাফ দিয়েছিলো) আবার ভিসাও দিয়েছে ১৫ দিনের। এই ভিসার জন্য গুলশান যাতায়াত আর কলকাতার বাস-টিকিট মিলিয়ে প্রায় তিন হাজার টাকা নষ্ট হয়েছে আমার। অবশ্য ভারত ভ্রমনে গেলে এর ১৫/২০ গুণ বেশি খরচ হত নিঃসন্দেহে ... সেটা থেকে বেঁচে গেলাম (আঙ্গুর ফল টক )।

ভিসার আবেদন করতে যে ভোগান্তি হল সেটা কোন সভ্য দেশে হতো না বলেই মনে হয়। জাপানে থাকা অবস্থায় পাসপোর্ট নবায়ন করিয়েছি বাংলাদেশ এম্বেসী থেকে -- সবই ডাকযোগে। এছাড়াও আমি জাপানে থাকা অবস্থায় সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভারত, নেপাল, ভিয়েতনামের ভিসা পেয়েছি অনায়েসে। এমনকি ভারতের ভিসার জন্য তো কনসুলার অফিসেও যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। ফোনে কনসুলার সাহেবের সাথে কথা বলে ওনার কথামত সব কাগজপত্র ও পাসপোর্ট ডাকযোগে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম আর ওনারাও ভিসা দিয়ে ডাকযোগে ফেরৎ পাঠিয়েছিলো কাগজপত্র। ঢাকা থেকে আমার স্ত্রী সিঙ্গাপুরের ভিসার জন্য আবেদন করেছিলো ইতিপূর্বে - সিঙ্গাপুর এন্বেসী থেকে ১০টি সংস্থাকে (ট্রাভেল এজেন্সী) ভিসা প্রসেসিং ক্ষমতা দিয়েছে। ভিসার জন্য যে কোন সময়ে ওগুলোর কোনটাতে গিয়ে কাগজপত্র এবং প্রসেসিং ফী জমা দিলেই ওরা পরদিন সেগুলো এম্বেসীতে নিয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে সাক্ষাতকার গ্রহনের জন্য ডাকে আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাক্ষাতকার ছাড়াই ভিসা দিয়ে দেয় বলেই শুনেছি। আমার স্ত্রীর ভিসার জন্য সাক্ষাতকার দরকার হয়নি। গত সপ্তাহে দেখলাম ব্রিটিশ এম্বেসী অনলাইনে ভিসা আবেদন করার পদ্ধতি চালু করেছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো কোথায় পড়ে আছে!

মঙ্গলবার, ৯ অক্টোবর, ২০০৭

জাপানের শেষ দিনগুলি

বিদায় আসন্ন:

দেখতে দেখতে জাপান থাকার সময় শেষ হয়ে গেল ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ২৩শে সেপ্টেম্বরে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনে করে ফুকুওকা থেকে ভায়া সিঙ্গাপুর হয়ে ঢাকা ফিরে যাচ্ছি।

যাই যাই ভাবটা শুরু হয়েছিলো গত জুন মাস থেকেই। সম্বন্ধীর বিয়ে উপলক্ষে আমার বউ দেশে চলে গেল ১৭ই জুন। আমিও ফুকুওকা গেলাম বিদায় জানাতে। নাইট বাসে করে গিয়েছিলাম। জুলাই মাসে সম্বন্ধীর বিয়ের পরে বউ আবার জাপানে ফিরবে কি না সেটা নিয়ে একটু ধাঁধাঁর মধ্যে পড়ে যাই দুজনেই। কারণ হিসেব মত সেপ্টেম্বরে আমার পি.এইচ.ডি. শেষ হলে আমার ফিরে আসতে হবে। কাজেই ও যদি জাপানে আসেও তাহলেও দেড় দুইমাস পরেই আবার বাংলাদেশে ফিরতে হবে। আর ট্যাকের যে অবস্থা তাতে এ্যাত ঘনঘন আসাযাওয়া করলে সামনে অন্ধকার ... ... তাই কষ্ট হলেও দুজনেই ঠিক করলাম যে, যদি না জাপানেই আমার কোন চাকরী বা পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চারের কাজ জোটে তাহলে ও আর জাপানে আসবে না। আর, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তও নেয়া যাচ্ছিলো না কারণ, পোস্ট ডক্টরালের জন্য আবেদনের ফলাফল দেয়ার কথা অগাস্টের ২০ তারিখের দিকে। সুতরাং অন্ততপক্ষে ঐ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। শেষ পর্যন্ত আমার আর ওটা হয়নি, যদিও খুব আশা করেছিলাম যে রিসার্চের প্রস্তাবটা গৃহীত হবে। আমার প্রফেসরও খুব ভালভাবে রেকমেন্ড করে দিয়েছিলেন কিন্তু তাও হলোনা।

যা হোক বউ জাপানে ছিল না সেই জুন মাস থেকে। এবং ঐ সময়ে আমার কাজের চাপ অত্যধিক বেশি ... শেষ টার্ম বলে কথা। থিসিস ডকুমেন্টের একটার পর একটা ড্রাফট ঠিক করছি আর প্রফেসরদের পরীক্ষা কমিটি ওগুলোতে গাদা গাদা সংশোধনী দিচ্ছে... হাতে সময়ও কম। এটার কাজ করতে করতে রাত-দিনের হুশ পাই না। তাই বউ যাওয়ার আগে ওকে সময়ও দিতে পারিনি যথেষ্ট। বউ চলে যাওয়ার পরে, সময় দেয়ার দায়িত্ব একটু কমে গেল বটে, তবে স্বাভাবিক জীবন যাপন বাঁধাগ্রস্থ হল প্রবল ভাবে। বউয়ের সতর্ক দৃষ্টির আড়ালে থেকে নিয়মিত ব্যায়াম বাদ পড়ে গেল ... ... অবশ্য এর পিছনে অসম্ভব গরমটাও দায়ী ছিল বহুলাংশে।

গরমের সময়ে মনে হয়েছিলো যে, এই সময়ে বউ এখানে না থেকে খুব ভাল হয়েছে ... এখানে নির্ঘাত গরমে অসুস্থ হয়ে পড়তো -- ওর ঠান্ডা লাগার ধাত আছে, এয়ার কন্ডিশনার সহ্য হয় না ... তাই বাসায় এ.সি.ও লাগানো নাই। গরমের সাথে অসম্ভব আদ্রতা ... মনে হয় সেটা ঢাকার চেয়েও বেশি। কারণ সম্ভবত আমাদের শহরটার অবস্থান। প্রশান্ত মহাসাগরের পাড়ে শহরটা, আর আমাদের বাসার পূর্বদিকে বড়জোর তিন কিলোমিটার দুরেই মহাসাগর, দক্ষিন দিকে দুই কি আড়াই কিলোমিটার দুরে পাহাড়, সুতরাং ভ্যাপসা আবহাওয়া।

থিসিস ডিফেন্স ও ডিগ্রী প্রাপ্তি:

বউ ঢাকায় থাকাতে ওর এই অসহ্য গরম সহ্য করতে না হলেও আমার অবস্থা খুব খারাপ হয়েছিলো। যা হোক একটু একটু করে সমস্ত কাজ শেষের পথে চলে আসলো আর দোসরা অগাস্টে আমার ফাইনাল ডিফেন্সের তারিখ পড়লো। ঠিক তার পরে পরেই ৫ তারিখে আমার প্রফেসরসহ বাংলাদেশে একটা রিসার্চ ট্রিপের পরিকল্পনা ছিল, যেখান থেকে ১৯ তারিখে আবার জাপানে ফিরবো। সব প্রস্তুতি শেষ, তবে ডিফেন্সের আয়োজনটাকে বলা যায় এলাহি কারবার .... .... কারণ এর আগেও কয়েকজনের পি.এইচ.ডি থিসিস ডিফেন্স দেখেছিলাম এখানে। দর্শক হয় হাতে গোনা কয়েকজন। পরীক্ষক বাদে নিজ ল্যাবের দুই/একজন, স্বামী বা স্ত্রী, আর বাইরের দর্শক বলতে আমি! কিন্তু আমার বেলায় প্রফেসর দাওয়াত দিয়েছিল অনেককে। আগের অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা ছিল যে মোটামুটি ভাবে ফাইনাল প্রেজেন্টেশনের হ্যান্ডআউটের ২০ কপি করলেই তা দর্শকদের জন্য যথেষ্ট হবে। কিন্তু প্রফেসরকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করাতে উনি যা বললেন তা শুনে আমি তো অবাক। উনি প্রথমেই ফরেন স্টুডেন্ট এসোসিয়েশনের গ্রুপ মেইলৈ একটা মেইল করিয়েছেন (আমিও সেটা পেয়েছিলাম), তারপর দাওয়াত দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ করে এমন দুটি সংগঠনের যতজন এই শহরে আছে সকলকে (এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়র্ক এবং রিসার্চ গ্রুপ অব এপ্লাইড জিওলজি), এছাড়া দাওয়াত দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু প্রফেসরকে, সবশেষে উনার ল্যাব থেকে গত ১০ বছরে যতজন পাশ করে গেছে সকলকে। উনি হিসাব দিলেন পঞ্চাশ কপির বেশি করতে হবে, মোট সত্তর কপি করতে বললেন। সব কপি করলাম, স্ট্যাপল করে সেট বানালাম ... এসব করতে করতে আমার অবস্থা কেরোসিন। এদিকে হয়েছে আরেক কারবার ....

আবহাওয়া রিপোর্টে দেখাচ্ছিল যে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে একটা টাইফুন ধেয়ে আসছে এবং সমস্ত পূর্বাভাষ বলছে এটা সরাসরি আমাদের শহরের (মিয়াজাকি) উপর দিয়ে ভূমিকে আঘাত হানবে। তবে সেটা আঘান হানবে ৩রা অগাস্ট সকালের দিকে, সুতরাং ২রা অগাস্টের দুপুরে আমার প্রেজেন্টেশন হতে কোন সমস্যা নাই কারণ ঝড় শুরু হবে মাঝরাত থেকে। ১লা অগাস্টের বিকালের আবহাওয়া রিপোর্টে বলল যে টাইফুন এর গতি পরিবর্তন করে আরও দ্রুতবেগে এগিয়ে আসছে এবং পরদিন দুপুরে আমাদের শহরের উপর দিয়ে ভূমিতে আঘাত হানবে!! সন্ধ্যা ৬:১৫তে প্রফেসর বললেন টাইফুনের কারণে আগামীকালের থিসিস ডিফেন্স পিছিয়ে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ (না করে উপায় নাই, কারণ দুপুর ২টা থেকে ৩টা ডিফেন্স আর ঐ সময়েই টাইফুনের কেন্দ্র আমাদের উপর দিয়ে যাবে!)। পিছিয়ে দিয়েছে কবে?? ২০শে অগাস্ট। কারণ আমরা ৫ই অগাস্টে ট্যুরে যাচ্ছি, আর টাইফুনের পরের দুই/একদিন কে কী অবস্থায় থাকে তার ঠিক নাই .... অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে ১৯শে অগাস্ট দুপুরে জাপানে আমাদের শহরে ফিরে পরদিন দুপুরে প্রেজেন্টেশন।

পরিচিত সকলেই (জাপানি সহ) বলছিল.... এ তো খুব ধকল যাবে, বিমান ভ্রমনের জেট ল্যাগ কাটার আগেই প্রেজেন্টেশন। অবশ্য আমি চিন্তিত ছিলাম না কারণ, ইতিপূর্বে কয়েকটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছি। এমনও হয়েছে যে ভোরে ওখানে বিমান থেকে নেমে দুপুরে প্রেজেন্ট করেছি। কাজেই এটাতেও সমস্যা হবে না। যা হোক, ভেবেছিলাম থিসিস ডিফেন্স করে মাথা থেকে এই বোঝা নামিয়ে হালকা মাথায় দেশে যাবো, সেটা আর হলো না। তবে একটা লাভ হয়েছিলো। দেশে কাজের ফাকে (যশোরে) ওখানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনিয়ারদের এবং যশোরে ডি.পি.এইচ.ই-জাইকা আর্সেনিক মিটিগেশন প্রজেক্টের টেকনিক্যাল কর্মকর্তাদের সামনে প্রায় একই জিনিষ একবার প্রেজেন্টেশন করে নিজেকে একটু ঝালাই করে নেয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এই প্রেজেন্টেশনটা আসলে দেয়ার কথা ছিল আমার প্রফেসরের, কারণ উনি উক্ত প্রজেক্টের টেকনিকাল এক্সপার্ট হিসেবে গিয়েছিলেন। এখানে উপস্থিত সকলেই সরাসরি মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন জন্য বিষয়টার খুটিনাটি ভালো জানেন এবং বোঝেন, ফলে ওনাদের সাথে প্রেজেন্টেশনের পরের প্রশ্নত্তোর পর্বটা থিসিস ডিফেন্সের চেয়ে কার্যকর হবে এটাই আশা করেছিলাম। কারণ থিসিস ডিফেন্সে যাঁরা আসবেন ওনারা আমার কাজ সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না... কাজেই মূল লক্ষ্যটা হবে ওনাদের মাথায় বিষয়টা সম্পর্কে ধারণা দেয়া, বিষয়ের গভীরে যাওয়ার সুযোগ সীমিত। কিন্তু যশোরের টেকনিক্যাল প্রেজেন্টেশনে বিষয়ের খুব গভীরে গিয়ে আলোচনা/প্রশ্নত্তর পর্ব হয়েছিল কারণ, ওনারা আসলে আমার গবেষণার ফলাফলটাকেই মাঠপর্যায়ে প্রয়োগ করছেন ঐ প্রজেক্টে। আর ওটাতে খুব ভালভাবেই উৎরে গিয়েছিলাম।

মিয়াজাকি ফিরে এসে তাই থিসিস ডিফেন্স করতে কোন অসুবিধা অনুভব করিনি। মোট ৪৩ জন উপস্থিত ছিলো ঐ সময়ে। আর ডিফেন্সের পরে পরীক্ষক কমিটির প্রফেসরগণ বললেন আমার প্রেজেন্টেশন আর প্রশ্নোত্তর পর্ব আশাতীত ভাল হয়েছে। কাজেই সাথে সাথেই দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়েছিলাম। আমাকে ডক্টরাল সার্টিফিকেট দেয়া হল ১৩ই সেপ্টেম্বর, আর তার দশদিন পরে জাপান ত্যাগ করলাম।

গৃহহীন হওয়ার পর্ব:

ডিগ্রী পেতে অসুবিধা না হলেও ওখানকার বাসা এবং অন্য সবকিছু ছেড়ে আসতে অসম্ভব ঝামেলা পার করতে হয়েছে। প্রথমত বাসা থেকে সমস্ত আসবাব সরাতে হয়েছে। আশেপাশের বিদেশী ছাত্রদের এবং বাঙালী ভাইদেরকে তিল তিল করে গড়ে তোলা প্রথম সংসারের সমস্ত জিনিষ বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে দিতে প্রচন্ড কষ্ট হলো। এরপর পরিষ্কার করতে হলো সমস্ত ময়লা। এখানে ময়লা ফেলার আগে ওগুলোকে ভাগ করে বিভিন্ন ভাগে ফেলতে হয়। দহনযোগ্য, অদহনযোগ্য, প্লাস্টিক, রিসাইকেল, বোতল/ক্যান ... ময়লা ভাগ করার কত যে প্রকারভেদ।

কয়েকমাস ধরে জমানো শুকনা ময়লা বেছে আলাদা আলাদা করে ফেললাম। শুনতে খুব সহজ মনে হলেও কাজটা খুবই বিরক্তিকর এবং সময় সাপেক্ষ ... একটু ব্যাখ্যা করি। দেশে কাগজের প্যাকেটে যেমন জুস পাওয়া যায়, এখানে তেমন দুধ/জুস ইত্যাদি পাওয়া যায়। ঐ প্যাকেট ধুয়ে পানি ঝরিয়ে রেখে দিয়েছেলাম, কারণ ওটাকে স্বাভাবিক ময়লার সাথে দহযোগ্য হিসেবে ফেলা যাবে না। প্রতিটি প্যাকেটকে নির্দিষ্ট আকারে কেটে তারপর সেগুলোকে একসাথে বেঁধে রেখে আসতে হবে রিসাইকেলযোগ্য (পূণর্ব্যবহারযোগ্য) ময়লা হিসেবে। মোট ৬৭টি প্যাকেট জমেছিলো আমার বাসায়।

এরপর আসি ড্রিংকের বোতলের কথায়। বোতলগুলো সাধারণত PET বোতল, ওগুলোকে আলাদা ফেলতে হবে। তবে বোতলের মুখগুলো আবার অন্য প্রকৃতির ময়লা (প্লাস্টিক রিসাইকেল) এছাড়া বোতলের গায়ের লেবেল লাগনোগুলো কাগজের হলে দহনযোগ্য আর প্লাস্টিক/পলিথিনের হলে প্লাস্টিক ময়লা। বুঝুন ঠেলা ... বোতলের মুখ/ক্যাপ একদিকে, লেবেল ছিড়ে আলাদা করে একদিকে আর বোতল আরেকদিকে। ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর গত কয়েকবছরে ব্যবহৃত আর অব্যবহৃত কাপড়চোপড় ... ... নতুন পুরাতন মিলিয়ে মোট দশ বস্তা কাপড় ফেলে দিতে হলো - পূণর্ব্যবহারযোগ্য ময়লা হিসেবে। থালাবাটি কিছু ফেলা হল অদহনযোগ্য ময়লা হিসেবে আর কিছু বিভিন্ন লোকজন নিয়েছে। পর্দা, পর্দা লাগানোর রেইল সব খোলা হল .... .... ...। নতুন টেলিভিশন কিনেছিলাম। কিন্তু ওটা শেষে একটু সমস্যা করতো। তাই ওটা ফেলে দিলাম। টেলিভশন ফেলতে ৩৩০০ ইয়েন ফী দিতে হল!

এরপর ছিল কাগজপত্র আর বই। নিজের বই ছিলো প্রায় ৪০-৫০ কেজি। তার মধ্য শুধু যেগুলোতে নিজের কোন গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে ওগুলো (১২ কেজির মত) আর দেশ থেকে আগে নিয়ে আসা কাঁথা চাদর মিলিয়ে ২০ কেজি মাল দেশে পাঠালাম পোস্ট অফিসের মাধ্যমে ... খরচ ১২০০০ ইয়েন। বাকী বইপত্র সব ল্যাবে দিয়ে আসলাম। ওরা যদি সামনে কখনো বাংলাদেশে ট্যুরে আসে তাহলে কয়েকটা বই নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করে আসলাম .... ওখানে জাপানে কেনা বই যেগুলো ছিলো ওগুলোর মূল্য ১০০০০ ইয়েনের বেশি। এছাড়া বিভিন্ন জিনিষ কেনার সময়ে বাসায় প্রবেশ করা কাগজের বাক্স (কার্টন) ফেলতে পারলাম না। এগুলো ফেলতে হয় আলাদা ভাবে। সবগুলো ভাঁজ করে একসাথে নির্দিষ্ট দিনে (অন্যান্যগুলোও নির্দিষ্ট দিনে ফেলতে হয়) ফেলতে হয়। ল্যাবের জাপানি জুনিয়র বললো ওগুলো ল্যাবে রেখে যেতে, পরবর্তী বৃহস্পতিবার ফেলার একটা তারিখ আছে তখন ওরা ফেলে দেবে।

এই সব কাজ করতে করতে শেষের সপ্তাহ দুই মন ও শরীরের উপরদিয়ে স্টীম রোলার গেল। শেষ দুইরাত দুই দিন মিলিয়ে মোট চার ঘন্টা ঘুমিয়েছি। কাজ করতে করতে শরীর এতই অবসন্ন হয়ে যায় যে মনে হয় নিজের শরীরের ভার নিজেই বহন করতে পারি না। রাতে পরিষ্কারের কাজ আর দিনে ল্যাবের শেষ দিকের কাজ যেমন সি.ডি. বানানো, অন্য প্রফেসরের কামলা খাটা, অফিসিয়ালি সমস্ত সার্ভিস (মোবাইল ফোন, ল্যান্ডফোন, ইন্টারনেট সার্ভিস, ভাড়া-বাসা, স্বাস্থ্যবীমা, ক্রেডিটকার্ড, পোস্টঅফিস একাউন্ট, ব্যাংক একাউন্ট, বিদ্যূৎ, গ্যাস, পানি ইত্যাদি) বন্ধ করার জন্য ছোটাছুটি, ফোন করা ইত্যাদি। গাড়িটা ফেলে দিতে চেয়েছিলাম ... গাড়ি ফেলার জন্য প্রয়োজনীয় ফী (৯৪০০ ইয়েন) জমা দিয়েছিলাম অনেক আগেই। যেই দোকান থেকে গাড়ি কিনেছিলাম ওখানে যখন গাড়িটা কয়েকদিন আগে নিয়ে গিয়ে বললাম গাড়িটাতো ফেলতে চাই, দোকানের মালিক কাগজপত্র দেখে বলে গাড়িটা যথেষ্ট ভাল আছে এখনও (বয়স ১৩ বছর) তাই এটা ফেলো না, কারণ তাহলে ওরা গাড়িটা ভেঙ্গে ফেলবে। তার চেয়ে আমি এটা কিনে নিচ্ছি। নামমাত্র মূল্যে গাড়িটা কিনে নিলেন .. (আমি তো ফেলেই দিতাম .. কাজেই যা পাওয়া যায় তাই লাভ)। সবার শেষের দিন অর্থাৎ গতকাল (২২-সেপ্টেম্বর) বাসার চাবি কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধির কাছে বুঝিয়ে দিয়ে তারপর গাড়িটা দিয়ে আসলাম ... গৃহহীন ও গাড়িহীন হলাম।

অবশেষে বিদায় মিয়াজাকি:

(গতকাল ২২শে সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় ইফতার পার্টি হল বাঙালি বড় ভাইয়ের বাসায়। বাঙালী সাড়ে চার পরিবারের সকলেই এসেছিলো (আমি একা, তাই অর্ধেক পরিবার!)। খুব জমেছিল ইফতার ও তার পরের আড্ডা। তারপর রাত ১১টার বাসে চলে আসলাম ফুকুওকা। আমাকে বাসস্ট্যান্ডে এগিয়ে দিয়ে গেল ওখানের সকল পুরুষগণ। এছাড়া ল্যাব থেকেও ৩জন ছেলে ওখানে এসেছিল বিদায় জানাতে। বিদায় নিতে তেমন কষ্ট হলো না ... খারাপ লাগলো না তেমন একটা। কারণ, গত কয়েকদিনে তিল তিল করে গড়ে তোলা আমাদের প্রথম সংসারটার স্থাবর অংশগুলো দান করতে আর ময়লা হিসেবে ফেলতে ফেলতে কষ্টের যে শেল মনে জমা হয়েছে (অধিক শোকে পাথর) তার তুলনায় এই বিদায় তো তেমন কিছু না। বিদেশের কঠিন পরিবেশে জীবনযুদ্ধের মাঝে আপনজন বাঙালিদের সাথে দেখা হয় হয়তো মাসে একবার ... ... আর সংসারটা ছিল পুরা সময় জুড়ে কত স্মৃতির ধারক হয়ে। তাই বিদায় দিতে তেমন কষ্ট লাগেনি ... ... ...।

মিয়াজাকিকে আসলেই খুব মিস করবো আমি আর আমার বউ - এখানে আমাদের নিজেদের মত করে সংসার করার প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিলো।।

এই মুহুর্তে বসে আছি সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে; ৫ ঘন্টা ট্রানজিট। তাই বসে বসে গত কয়েকদিনের স্মৃতিচারণ করে ল্যাপটপটার সদ্ব্যবহার করলাম।