সোমবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

মহাদেশ কয়টি


কিছুদিন পূর্বে প্রজন্ম ফোরামে এক ভাই প্রশ্ন করলেন নিউজিল্যান্ড কোন মহাদেশে অবস্থিত। আপাত সহজ এই প্রশ্নটার উত্তরে প্রথমেই মাথায় আসে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের কথা। কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলেই অত সহজ? একটু ঘাটাঘাটি করে দেখা গেল মোটেই তা নয়, বরং প্যাঁচে ভরপুর ... ...


প্রথম সোর্স উইকিপিডিয়াতে (http://bn.wikipedia.org/wiki/মহাদেশ) বলছে ৭টি মহাদেশ। ছোটবেলার ভুগোল বইয়েও তাই পড়েছি বলে মনে পড়ে। এই হল উইকির ছবি:

নিউজিল্যান্ড ওশেনিয়ান অঞ্চলে অবস্থিত। এই তথ্যটুকু এব্যাপারে আরেকটু ঘাটাঘাটি করতে উৎসাহ দিল -- আর ভ্যাজালটা বাধলো তখনই --

এখানে বেসিক প্রশ্ন হল মহাদেশ কাকে বলে? এর সংজ্ঞা কী? এই সংজ্ঞাটা কে দিয়েছে এবং কতটুকু গ্রহনযোগ্য।

প্রথমে উইকিপিডিয়া থেকেই নিচের ছবিটা দেখুন (এনিমেটেড):
http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/7/77/Continental_models.gif/800px-Continental_models.gif

এখানে বলেছে যে, কিভাবে মহাদেশ চিন্তা করা হচ্ছে তার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন রকম মডেল হতে পারে। যেমন: কখনো ইউরেশিয়াকে দুইভাগ দেখাচ্ছে, কখনো দুই আমেরিকাকে একটা বড় মহাদেশ হিসেবে দেখাচ্ছে।

একসাথে যুক্ত বৃহদাকৃতির ভূমি যদি হয়, তাহলে ইউরোপ এবং এশিয়া আলাদা হতে পারে না। আবার ইউরেশিয়ার সাথে আফ্রিকাও যুক্ত। আফ্রিকার মিশরের সাথে এশিয়ার বিরাট অংশ যুক্ত - সুয়েজ খালের অংশ দিয়ে অফ্রিকা আলাদা হয়নি কিন্তু, কারণ সুয়েজ খাল হল মিশরের ভেতরে। সুয়েজ দিয়ে আলাদা হয়েছে বললে, মিশরের এক অংশ আফ্রিকায় আর আরেক অংশ এশিয়ায় বলতে হবে। আবার একইভাবে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা একই সাথে আছে।

বিশেষত ইউরেশিয়াটা যে কোনো সংজ্ঞার সবচেয়ে বড় সমস্যা। ইউরোপীয়ানরা এটাকে আলাদা দেখতে চাইলেও রাশিয়া সহ পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহ এবং জাপান এটাকে এক মহাদেশ হিসেবে দেখতে পছন্দ করে। (তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া)। ইউরোপের ক্ষেত্রফল এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টের বৈচিত্র বিচার করলে তা ভারত এবং চীনের সাথে তুলনীয়। ফ্রান্স, ভারতের উত্তর প্রদেশের প্রায় সমান।
আবার দেখুন ইউরোপ এক মহাদেশ হিসেবে আলাদা কল্পনা করলেও ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন নামক সংস্থায় তুরস্ক, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, আইসল্যান্ড সহ বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ এটার অন্তর্ভুক্ত নয়।


http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/7/75/European_Union_enlargement.gif

টেকটোনিক প্লেট হিসেবে চিন্তা করলে তো আরেক ভেজাল লাগবে। কারণ প্লেটের নাম ইউরেশিয় প্লেট - এটাতে সৌদি আরব কিংবা ভারত নাই: ওগুলো আলাদা প্লেট। আর প্লেটের সংখ্যাও অনেকগুলো।
http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/8/8a/Plates_tect2_en.svg/350px-Plates_tect2_en.svg.png

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এই বিভাজনের ব্যাপারটা বিভিন্নভাবে আসে। যেমন ফিফা বিশ্বকাপে বিভিন্ন মহাদেশভিত্তিক যে কোটা আছে এশিয়ার সাথে অস্ট্রেলিয়া একসাথে। ওশানিয়া আলাদা কিন্তু সেখানে অস্ট্রেলিয়া নাই। রাশিয়া ইউরোপে বলে সাইবেরিয়া হিসাবে আসে না।

আমার ধারণা বিভিন্ন ম্যাপওয়ালারা এই বিভাজনগুলো করেছে। আর এই ম্যাপ তৈরী হয় কোনো না কোনো দেশের সংস্থা দ্বারা। ব্রিটিশরা এখনও মিয়ানমারকে বার্মা বলে - সেই অঞ্চলের নামকরণকে সম্মান না জানিয়ে বরং তাদের দেয়া নামটাই প্রতিষ্ঠিত রাখতে চায়।


ভ্যাজালটা তাহলে রয়েই গেল। মহাদেশের প্রশ্নে স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড উত্তর দেয়া যাবে না মনে হচ্ছে।

সূত্র: http://forum.projanmo.com/topic25049.html

শুক্রবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

ফ্রিকোনমিক্স, প্রণোদনা কেরামতি এবং দ্যা কোবরা ইফেক্ট

একটা বই কিছু অংশ পাঠ আর পডকাস্ট শুনে নতুন কিছু জানলাম, যা অন্যদের কাছে পুরাতন হতে পারে।‌
(কারন বইটির চলিশ লক্ষাধিক কপি বিক্রয় হয়েছে, ইদানিং বাংলা অনুবাদও বের হয়েছে শুনলাম)

গত ২১শে ফেব্রুয়ারী বউ-বাচ্চাকে নিয়ে শাহবাগ গিয়েছিলাম। তারপর সেখান থেকে পলাশী এস,এম,হল -- ওখানে একজন আত্মীয় থাকেন যিনি পলিটিকাল সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক। ওনার বাসায় একটা বই পড়া শুরু করে প্রায় ২৫ পাতা পড়েছিলাম। বইটির নাম ফ্রিকোনোমিক্স। এটি লিখেছেন দুইজন, যার একজন নামকরা ইকোনমিস্ট (Steven D. Levitt) -- মূল আইডিয়াগুলো তারই, কিন্তু লেখার সময় নাই ওনার, তাই অন্যজন (নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক Stephen J. Dubner) এটা লিখেছেন। ওনারা ধারণা করেছিলেন এটার ৮০ কপিও হয়তো বিক্রয় হবে না। কিন্তু বইটি ৪ মিলিয়ন কপির বেশি বিক্রয় হয়েছে। ওনাদের ওয়েবসাইটে (www.freakonomics.com) একজায়গায় কোবরা ইফেক্ট নামক প্রণোদনা সংক্রান্ত একটা পডকাস্ট শুনে ভাবলাম এটা বাংলায় লিখে রাখার মত একটা ব্যাপার -- ওনার বইয়েও এই বিষয়টার উপরে বেশ ভালো আলোচনা আছে যা পড়ে শেষ করতে পারিনি তখন।

কোন একটা বিষয়ে লক্ষ্য পূরণের জন্য সরকার বা কোন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বিভিন্ন রকম প্রণোদনা বা incentiveএর ব্যবস্থা করা হয়। লেখকের ভাষায় সেই প্রণোদনা ধনাত্নক বা ঋণাত্নক (=পুরস্কার বা জরিমানা) হতে পারে; অর্থনৈতীক, সামাজিক বা অন্য ধরণের হতে পারে। কিন্তু সেই প্রণোদনা সবসময় কাজ করে না, বরং এটাতে সম্পুর্ন উল্টা ফলাফল বা হিতে বিপরীত হয়। এইরকম হিতে বিপরীত হওয়ার অনেকগুলো ধরণ আছে - যার একটি হল কোবরা ইফেক্ট, (অর্থাৎ সমাধানের বদলে সমস্যা বাড়ানোর ঘটনা)।

প্রণোদনা ভাল কিছু লাভের আশায় চালু করা হলেও এটা বরং বিভিন্নভাবে দূর্নীতি বাড়াতে পারে। ছোট কর্পোরেটের ম্যানেজার বসে বসে অধীনস্থ কর্মকর্তার রেকর্ডে কারচুপী করতে পারে যাতে তার পারফর্মেন্স সকলের চেয়ে ভাল দেখায় সেজন্য। পরের ক্লাসে উত্তির্ন হওয়াটি লেখাপড়া করার প্রণোদনা - এর জন্য ছাত্র পাশের জনেরটা দেখে লেখে হয়তো। স্কুলের শিক্ষক স্কুলের খারাপ ফলাফলের ফলশ্রুতিতে অনুদান বন্ধ হয়ে যাওয়া ঠেকাতে দূর্নীতি করে -- আমেরিকায় এরকম কেন্দ্রীয় পরীক্ষার সময়ে ক্লাসের বোর্ডে উত্তর লিখে দিয়ে চাকুরী খুইয়েছেন এক শিক্ষক। ইচ্ছা করলে শিক্ষক উত্তর দেয়ার জন্য ছাত্রদেরকে বরাদ্দকৃত সময়ের চেয়ে বেশি সময় দিতে পারে - যা প্রণোদনাঘটিত দূর্নীতি। আগে থেকে প্রশ্নের ধরণ জানা থাকলে শুধু সেই উত্তরগুলোর জন্য ছাত্রদেরকে প্রস্তুতি নেয়াতে পারেন -- এটাতে আইন ভঙ্গ না হলেও শিক্ষার উদ্দেশ্য ব্যহত হয়। সবচেয়ে সুক্ষ্ণভাবে দূর্নীতি করতে পারেন মাল্টিপল চয়েসের খাতা জমা নেয়ার পরপরই খাতা শিক্ষাবোর্ডে পাঠানোর আগে কিছু ছাত্রের কিছু উত্তর সব মুছে ঠিক করে দেয়া - এতে ঐ স্কুলের ছাত্রদের রেজাল্ট ভাল হওয়াতে অনুদান বজায় থাকবে। এটা নিয়ে বিরাট একটা বিশ্লেষণ আছে ঐ বইয়ে। এই ধরণের উত্তরের দূর্নীতি ধরার জন্য একটা এ্যলগরিদমও বানিয়ে সেটা দিয়ে বিভিন্ন স্কুলের খাতার রেকর্ড চেক করে দূর্নীতি চিহ্নিত করার পদ্ধতি বের করেছিলেন মূল লেখক।

এবার ইসরাইলের ডে-কেয়ার সেন্টারটির ঘটনাটা বলি। কর্তৃপক্ষ লক্ষ্য করেছিলো যে প্রতিদিনই কেউ না কেউ নির্দিষ্ট সময়ের পর বাচ্চা নিতে আসেন। ফলে ওখানকার কাউকে না কাউকে অতিরিক্ত সময়ে বাচ্চা আগলে বসে থাকতে হয়। একজন ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্টের পরামর্শে ওরা প্রতিবার লেট-পিকাপের জন্য ৩ ডলার করে জরিমানা ধার্য্য করলো। অবশ্য জরিমানা চালু করার আগে তিন সপ্তাহ যাবত জরিমানা করা হবে এমন নোটিশ দিয়ে রেখেছিলো। ফলশ্রুতিতে কী হলো? লেট পিকাপের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে গেল। মাত্র ৩ ডলারের জন্য টেনিস খেলার মাঝ থেকে উঠে আসার মানেই হয় না, আর এজন্য তো জরিমানা দিচ্ছিই --- তাই অপরাধবোধও নাই। ফলে ৮ সপ্তাহ পরে এই জরিমানা প্রথা বন্ধ করে দিয়েছিলো কর্তৃপক্ষ। কিন্তু লেট পিক-আপের সংখ্যা বাড়ার পর আর কমেনি। জরিমানাটা যদি সেইরকম উচ্চমাত্রায় হত তাহলে হয়তো এরকম কিছু ঘটতো না।

কলম্বিয়ার বোগোটাতে সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে গিয়েছিলেন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টার প্রফেসর বিকাশ মেহত্রা। উনি লক্ষ্য করেছিলেন যে ওনাকে হোটেল থেকে সেমিনারস্থলে নিয়ে যাওয়ার জন্য ওখানকার ইউনিভার্সিটির যে বন্ধু ওনাকে গাড়ি দিয়ে নিয়ে যায়, প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন গাড়ি দিয়ে নিয়ে যান। অনুসন্ধানে জানা গেল যে এর কারণ হল বোগোটা শহরে যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্য লাইসেন্স প্লেট রেশনিং পদ্ধতি। এ রকম যানজট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা মেক্সিকো সিটি এবং চীনের কিছু শহরেও আছে। বোগোটার নিয়ম ছিল অনেকটা এমন: শুক্রবারে ১,২,৩,৪ দিয়ে শেষ হওয়া লাইসেন্সপ্লেট ওয়ালা গাড়ি বের হতে পারবে; ৫, ৬, ৭, ৮ দিয়ে শেষ হলে সেটা সোমবার বের করা যাবে .... .... ইত্যাদি। এই নিয়মের মধ্য থেকে চলার জন্য প্রায় সকলেই দ্বিতীয় গাড়ি কিনেছে। ভূয়া লাইসেন্স প্লেট দিয়েও চালানো যায়, এরকম ভুয়া লাইসেন্স প্লেট ক্রয়বিক্রয়ের ব্ল্যাক মার্কেটও আছে -- তবে ধরা পড়লে খুব কড়া শাস্তি। তাই নিয়ম বা আইন না ভেঙ্গেও রাস্তায় গাড়ি নিয়ে চলাচলের এই উপায়। এতে অবশ্য দূষণের ক্ষেত্রে কিছুটা উপকার হয়েছে, কারণ আগের গাড়িগুলো পুরাতন মডেলের ছিলো - তাই অন্তত অর্ধেক সময়ে উন্নত গাড়ি চলাতে কিছুটা বায়ুদূষণ কমেছে (মেক্সিকো সিটির বায়ুদূষণের তথ্য নিয়ে গবেষণাপত্রও আছে)। তবে এই নিয়মের মূল যেই উদ্দেশ্য ছিল যানজট কমানো --- সেটা কিন্তু বেড়েছে।

যা হোক, এবার কোবরা ইফেক্টের কথায় আসি। নামটা এসেছিলো দিল্লীতে ব্রিটিশ আমলে কোবরা সাপ নিয়ন্ত্রণের প্রণোদনা প্যাকেজ এমন ব্যাকফায়ার করার ঘটনা থেকে। আর এই কোবরা ইফেক্ট নামটা জনপ্রিয় করেছেন জার্মান অর্থনীতিবিদ হোর্স্ট সিবার্ট (Horst Siebert)। উপরের ঘটনাগুলোতে ঋণাত্নক প্রণোদনা তথা জরিমানা কিভাবে দূর্নীতি করে সেটা দেখেছি। কোবরা ইফেক্ট হল পুরস্কার বা প্রণোদনার ঘটনায় দূর্নীতি সংক্রান্ত বিষয়:
ব্রিটিশ শাসিত দিল্লীর শাসকের মনে হয়েছিলো এখানে কোবরা সাপের সংখ্যা বিপদজনকভাবে বেড়ে গেছে, এটা কমাতে হবে। তাই উনি কোবরা মারার পেছনে পুরস্কার (bounty) ঘোষনা করেছিলেন। উনি আশা করেছিলেন যে এতে যেখানে সেখানে বিষধর কোবরা সাপের সমস্যা কমে যাবে। কিন্তু দিল্লীর কিছু লোক এটার প্রতিক্রিয়ায় বরং কোবরা খামার করা শুরু করে -- অর্থাৎ সাপের ফার্ম দিয়েছিল। হঠাৎ করেই এজন্য প্রশাসন অনেক বেশি কোবরা সাপের চামড়া জমা পেতে শুরু করলো -- এতে বুঝতে পারলো যে এই পদ্ধতিটাকে যতটা স্মার্ট ভাবা হয়েছিলো সেটা তা নয়, ফলে এই পুরস্কারের ঘোষনা বাতিল করে দিল। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে কোবরা চাষীদের হাতে অনেকগুলো কোবরা সাপ জমে গিয়েছিলো, পুরস্কার বাতিল করাতে তারা সেগুলো বিক্রয় করতে পারলো না ফলে সেগুলোকে ছেড়ে দিল। এর ফলে দিল্লীতে কোবরা সাপের সংখ্যা মারাত্নকভাবে বেড়ে গিয়েছিলো তখন।

একই রকম ঘটনা আছে ইঁদুর নিয়ে। ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়কে আধুনিক শহর হিসেবে এবং ফরাসী সভ্যতার নিদর্শন তথা এশিয়ার সেরা নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলো ফ্রেঞ্চ প্রশাসক গণ। ফ্রান্সের আধুনিক শহরের চওড়া রাস্তা এবং চমৎকার অট্টালিকা ছাড়াও একটা মূল অংশ হল পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বা সুয়ারেজ নেটওয়র্ক। এই সুয়ারেজ নেটওয়র্কের একটা অনাকাঙ্খিত ফলাফল ছিল - এগুলো ইঁদুরের জন্য চমৎকার বাসস্থান হিসেবে কাজ করে। তাই এই পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা তৈরী হওয়ার পর বিভিন্ন জায়গা থেকে কমোডের ভেতর দিয়ে ইঁদুর বের হয়ে আসার খবর আসছিলো। এমনকি সেটা ফরাসী জনগণের বসবাস করা অভিজাত এলাকাতেও ঘটছিলো। প্লেগ রোগ ছড়ানোর ক্ষেত্রে এটা একটা বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়ালো। এ্যাতদিন পর্যন্ত প্লেগ শুধু ভিয়েতনামীদের সমস্যা মনে করা হলেও ফরাসী এবং অন্য ইউরোপীয় আবাসিক এলাকাতেও ইঁদুর এই রোগ ছড়াতে শুরু করেছিলো। এতে ফরাসী প্রশাসন বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং পয়ঃনিষ্কাশন লাইনে নেমে ইঁদুর মারার জন্য ভিয়েতনামী লোকবল নিয়োগ করেছিলো। ১৯০২ সালের গ্রীষ্ম ও বসন্তে যখন এই ঘটনা ঘটেছিলো তখন প্রথম সপ্তাহে শয়ে শয়ে ইঁদুর নিধন ঘটেছিলো। রেকর্ড ঘেটে দেখা যায়, মাসখানেক পরে ১৯শে মে'র একদিনেই মারা হয়েছিলো ৭,৪৪২টি ইঁদুর। ১২ই জুন ১৯০২ সালে সম্ভবত সর্বোচ্চ সংখ্যক ইঁদুর মারা পড়েছিলো: ২০,১১৪টি। এরকম প্রতিদিনই ৬হাজার, ৭ হাজার, ১১ হাজার, ১৫ হাজার করে ইঁদুর মারা হচ্ছিলো। কাজেই রেকর্ড দেখে সেই সময়ে ইঁদুরের অসীম সরবরাহ ছিল বলে মনে হচ্ছে। এতেও কোন লাভ হচ্ছিলো না। তাই এই কয়েকজন ইঁদুর শিকারী ছাড়াও আরও লোক দরকার হয়ে পড়ছিলো। এমন পরিস্থিতিতে প্রশাসনের কারো মাথা থেকে বের হল যে এই ইঁদুর মারা ভিয়েতনামীদের নাগরিক দায়িত্ব এবং এরপর ইঁদুর মারার জন্য পুরস্কার (bounty) ঘোষনা করা হল। পুরস্কারের টাকা নেয়ার জন্য প্রমাণস্বরূপ জনগণকে মৃত ইঁদুরের লেজ নিয়ে এসে জমা দিতে হবে। সিটি হলে হাজার হাজার লেজ জমা পড়তে থাকলো আর ফ্রেঞ্চ প্রশাসনও ভাবলো এবার ইঁদুর ভালই সাইজ হচ্ছে। কিন্তু কয়েকমাস পর একজন ফরাসী স্বাস্থ্য অফিসার হ্যানয়ের উপকন্ঠে একটা পরিদর্শনে গিয়ে সেখানে অনেক দুইনম্বরি কাজ কারবারের মধ্যে ইঁদুরের খামারও খুঁজে পেয়েছিলো। সেখানে ইঁদুর লালন করে মেরে লেজ নিয়ে শহরের ভেতরে সিটি হলে জমা দিয়ে পুরস্কারের টাকা নিয়ে যাচ্ছিলো কিছু লোক!

এরকম ঘটনা আরও আছে --- এমনকি ঘটেছে এই সাম্প্রতিক সময়েও। ফোর্ট বেনিন শহরের কাহিনীটা দেখুন তাহলে। ফোর্ট বেনিন হল দক্ষিন পশ্চিম জর্জিয়ার একটা ক্যান্টনমেন্ট বা আর্মি বেস কেন্দ্রিক শহর। আটলান্টা শহরের দ্বিগুনেরও বড় আকারের এই শহরে এক লাখ কুড়ি হাজার লোক থাকে এবং এই শহরটাতেও অন্য শহরের মত স্কুল, রেস্টুরেন্ট, গ্যাস স্টেশন, আবাসিক এলাকা ইত্যাদি সবই আছে। জঙ্গল, রাস্তা, খাল - সবকিছু এ্যাত ছিমছাম যে মনেই হয় না যে এটা একটা আর্মি বেস কেন্দ্রিক শহর -- শুধু মাঝে মাঝে দুরে কোথাও কামানের শব্দ ছাড়া। দক্ষিন আমেরিকার অনেক এলাকার মত এখানেও অসংখ্য বন্য শুকর ছাড়া অবস্থায় ঘুরে বেড়ায়। বন্যশুকর ঘুরে বেড়ালে সেটা বিরাট ঝামেলা করে। এরা মাটি খুড়ে খাবার খোঁজে। কয়েকটা শুকর হইলেই একটা এলাকার অবস্থা খারাপ করে দিতে পারে। আর এই শহরে সেই তান্ডবের শিকার হওয়ার তালিকায় সুন্দর লন, বাগান ছাড়াও দামী দামী সেনাবাহিনীর যন্ত্রপাতিও আছে। কিছু লোক শখ বশত মাঝে মাঝেই শুকর শিকার করে খেলেও সেটাতে এর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছিলো না। ২০০৭ সালের গ্রীষ্মে এদের অত্যাচার এমন মাত্রায় পৌঁছেছিলো যে শুকর শিকারে পুরস্কার ঘোষনা করেছিলো প্রশাসন। শিকার করে পুরস্কার দাবী করলে একটা ফর্মে কখন, কোথায়, কিভাবে শিকার করেছে সেটা উল্লেখ করে শুকরের লেজ জমা দিতে হত। প্রতি লেজে ৪০ ডলার, যা শিকারের বুলেটের খরচ, তেলের খরচ ইত্যাদি সবই পুষিয়ে দেয়! এটা ছাড়াও শুকর নিয়ন্ত্রণের জন্য এখানকার ইউনিভার্সিটিতে একটা গবেষণাও চলছিলো। সেই গবেষণাদলের কাজ ছিল শুকরগুলো কোথায় কোথায় চলাচল করে ট্র্যাকিং করে সেটার জিপিএস ডেটা সংরক্ষণ করা আর সেগুলোকে মেরে এনে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা। তো যখন এই শুকর শিকারের প্রণোদনা চালু হল তখন এটা কতটা কার্যকরী হচ্ছে সেটার মূল্যায়ন করতে বলা হয়েছিলো গবেষকদের। এটার শুরুতে ওদের হিসাব ছিল যে শহরের মধ্যে প্রায় হাজারখানেক বন্যশুকর আছে। দেড় বছরে শিকারীরা প্রায় দেড় হাজার শুকর শিকার করেছিলো - যার অর্থ দাঁড়ায় শুকরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রনের মধ্যে চলে এসেছে। কিন্তু গবেষক দল যখন আবার শুকরশুমারী করলো তখন বরং দেখা গেল শুকরের সংখ্যা বেড়ে আগের দ্বিগুন!! শিকারীদের দেয়া ডেটা শিটে কখন, কিভাবে এবং কোথায় শিকার করেছিলো সেই ডেটা বিশ্লেষন করে দেখা গেল এমন এমন জায়গায় এ্যাতগুলো শুকরের কথা বলেছে যেখানে অতগুলো শুকরের যাওয়ার কোন পূর্বরেকর্ডই নাই। ওখানে মাংস প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি থেকেও লোকজন ৫-১০ ডলারে বাচ্চা শুকর কিনে সেটা মেরে লেজ কেটে জমা দিয়েছে (=৪০ ডলার + শুকরের মাংসতো থাকলোই) এমন ঘটনা জানা যায়। এরকম দশটা জমা দিতে পারলেই তো সাড়ে তিনশো ডলারের বেশি ইনকাম!! প্রশ্ন হল মাংসের দোকান থেকে আর কিছু শিকারের শুকর থেকে লেজ জমা দিলেও এদের সংখ্যা এ্যাত বাড়লো কিভাবে? অনুসন্ধানে জানা যায় যে, শুয়োরগুলোকে শিকারের জন্য ঝোপের ভেতর থেকে খোলা জায়গায় আনার জন্য টোপ হিসেবে উচ্ছিষ্ট খাবার দাবার ব্যবহার করা হত। এই টোপের হাজার হাজার টন খাবার খেয়ে শুকরের বংশবৃদ্ধির হার বেড়ে গিয়েছিলো।

শুধুমাত্র পশু বা পোকামাকড় মারতেই যে কোবরা ইফেক্ট হয় তা-ই না। কিছুদিন আগে গ্লোবার ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ কমানোর জন্য বিভিন্ন দেশ কিছু গ্যাস নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে ঐক্যমত হয়েছিলো। বিভিন্ন ক্ষতিকারক গ্রীনহাউজ গ্যাসের নিঃসরন কমাতে পারলে সেই কারখানার জন্য পুরস্কার স্বরূপ বেশ ভাল ভর্তূকীর ব্যবস্থা ছিল জাতিসংঘের তহবিল (কার্বন ফান্ড) থেকে। সাধারণ কুল্যান্ট থেকে বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে নিঃসরিত HFC23 গ্যাসের জন্য ভর্তূকীর পরিমান সবচেয়ে বেশি ছিল। ফলাফল হল, বিভিন্ন কারখানায় এই শীতলকারক (coolant) এর উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে লাগলো, কারণ এতে বেশি পরিমাণ বাইপ্রোডাক্ট গ্যাস উৎপন্ন হবে যা ধ্বংস করে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ভর্তূকি (কার্বন ফান্ড) নেয়া যায়। সমস্যার আরেকটা বিপদজনক দিক হল যে এই শীতলকারকটি নিজেও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক।

বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের জন্য করা আইনও একইভাবে উল্টা ফলাফল দিতে পারে। একটা প্রাণীকে বিলুপ্তপ্রায় করার আগে কয়েকবছর ধরে সেই প্রাণী কতবার দেখা গিয়েছে সেটার পরিসংখ্যান নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলে। তারপর হয়তো সেটার আবাসস্থলকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষনা করা হয়। এই পরিসংখ্যান নিয়ে তর্ক বিতর্কের সময়েই কেউ হয়তো সেই জঙ্গলটি এর পর নিষিদ্ধ হতে পারে ভেবে সেখান থেকে সম্পদ আহরণ বাড়িয়ে দিয়ে সেই প্রাণীটাকে আরও বিলুপ্তির পথে ঠেলে দেয়।

ড. লেভিটের মতে তাই কোন ধরণের প্রণোদনা প্যাকেজই সম্পুর্ন তস্কররোধী নয়। যারা আইন বা প্রণোদনা প্যাকেজ বানায়, তাদের চেয়ে চালাক ব্যাক্তি থাকতেই পারে, যারা এই প্রণোদনা ব্যবহার করে নিজেদের আখের গুছিয়ে মূল উদ্দেশ্য ব্যহত করতে পারে।

তথ্যসূত্র:
বই: Freakonomics: A Rogue Economist Explores the Hidden Side of Everything, Published: April 12, 2005, Authors: Steven D. Levitt, Stephen J. Dubner
পডকাস্ট: http://www.freakonomics.com/2012/10/11/the-cobra-effect-a-new-freakonomics-radio-podcast/
উইকি: http://enwikipedia.org/wiki/Cobra_effect