শনিবার, ৭ মার্চ, ২০০৯

অসহায় বাচ্চা, ভয়ংকর ডাক্তার

(বাঁচতে হলে জানতে হবে টাইপ কথাবার্তা আছে ... খোকা খুকিদের না পড়াই ভাল)

আমার ছোটভাই শাহেদের বাচ্চার বয়স প্রায় ৬ মাস। হাসিখুশি আমার এই ভাস্তিটার জন্মের সময়টার কথা মনে পড়লে এখনও ঐ ডাক্তারের উপর রাগে মাথায় রক্ত চড়ে যায়। শাহেদের বউ আমাদের কাজিন ছিল (আছে)। গর্ভের কয়েক মাসের সময় বাইরে বেশি ঘুরাঘুরি করার জন্য সম্ভবত হঠাৎ একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লো। ডাক্তার পরামর্শ দিল বেড-রেস্টে থাকার জন্য। এই সময়টাতে গর্ভবতী মেয়েরা সাধারণত তাঁদের মায়ের কাছে চলে যায় --- এই রেওয়াজ জাপানেও দেখে এসেছি। সুতরাং ও সাভারে ওদের বাসায় চলে গেল।

সাভারেই একটা ক্লিনিকের ডাক্তারকে দেখানোর ব্যবস্থা করা হল। ঐ লেডি-ডাক্তারের দেশের বাইরের বড় ডিগ্রী আছে, উপরন্তু শাহেদের সম্বন্ধীর (আমাদের ..তুতো ভাই) খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মা উনি। ক্লিনিকটা ঢাকা থেকে গেলে সাভার বাজার পার হয়ে কিছুদুর পরে প্রধান রাস্তার বামপাশে অবস্থিত (ভেলরি টেইলরের সি.আর.পি. ওটার উল্টা দিকে কিছুটা ভেতরে)। ডাক্তার সাহেবের আলিশান বাড়িটাও ক্লিনিকের সাথেই লাগোয়া। কাজেই বেশ নির্ভরতার সাথেই ওনার পরামর্শ মেনে চলতে থাকলো ওরা। বাইরের দেশগুলোতে গর্ভবতী মায়েদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয় ... সিজারিয়ান অপারেশন ছাড়াই স্বাভাবিক প্রসবের জন্য তাঁদের নিয়মিত বিভিন্ন ব্যায়াম করানো হয়। জাপানে থাকার সময় এই ব্যাপারটা দেখেছি .... কেউ আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারের জুনিয়র সিনেমাটা দেখে থাকলেও এই ধরনের সিন দেখে থাকবেন। অথচ, আমাদের ডাক্তার এ ধরণের কোন পরামর্শই দিয়েছে বলে কখনো শুনিনি। বরং সবসময়ই এমন কথা বলেন যে সব ঠিক আছে ইত্যাদি।

ফলে শুয়ে থাকতে থাকতে গর্ভবতীর ওজন বেড়ে গেল অস্বাভাবিক। ডেলিভারির সময়ে ঐ ক্লিনিকে ভর্তি করানো হল এবং বাচ্চার পজিশন ঠিক নাই এমন আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট দেখিয়ে সিজার করা হল। আমার ছোটচাচা হোমিওপ্যাথির ডাক্তার, থাকেন সেই কুড়িগ্রামে। উনি পরে বলেছিলেন যে, আসলে বাচ্চার পজিশনের যেই ব্যাপার দেখিয়ে সিজারিয়ান করানো হয় তার বেশিরভাগই ঠিক না। বাচ্চা শুরুতে উল্টা পজিশনেই থাকে। তারপর যতই প্রসবের দিন ঘনিয়ে আসতে থাকে ততই বাচ্চা ঘুরে পজিশনে আসতে থাকে; বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্লিনিকওয়ালাগণ সিজারিয়ান অপারেশন করে টাকা কামানোর জন্য এই পজিশনে আসার আগেই আল্ট্রাসনোগ্রাম করে উল্টা পজিশনের ছবি নেয়। পাশাপাশি ডেট পার হয়ে যাচ্ছে, ঠিক সময়ে প্রসব না হলে বাচ্চার ক্ষতি হবে -- এসব কানপড়া দিতে থাকে। পানি ভেঙ্গে গেলে বাচ্চার ক্ষতি হওয়ার কথাটা পুরাপুরি সত্য, কিন্তু সময় পার হয়ে যাচ্ছে ... এই কথাটা আতঙ্কিত করানোর জন্য বলা হয়; কারণ তা না হলে কয়েকদিন পরে স্বাভাবিক ভাবেই প্রসব হবে ... ওদের সিজারিয়ানের দাও মারা হবে না। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা ভাল - আমার ছোটচাচীর ৫জন সন্তান (+১ জন জন্মের পর মারা গিয়েছিল) সকলেই স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে।

যেদিন সন্ধ্যায় বাচ্চা হল, তার পরদিন দেখতে গেলাম। বাচ্চা কোলে নিয়েই মনে হল ওর গায়ে জ্বর। আঙ্গুল দিয়ে বাচ্চার ভ্রুর উপরে এবং কপালে একটু ঘষে ম্যাসেজ করে দিলে বাচ্চা আরামে চোখ বন্ধ করে ফেলে। বাচ্চার মা-বাবা, খালারা সকলের কাছেও তাই মনে হল। তখন বাচ্চার মা বলছিল যে গতরাত্রে যখন সিজারিয়ান করতে নিয়ে যাওয়া হল তখন ঐ কক্ষের তাপমাত্রা এত কমানো ছিল যে ও ঠান্ডায় কাঁপছিলো। এই ঠান্ডার মধ্যে বাচ্চা বের করে ওরা বলাবলি করছিলো যে দূর্বল বাচ্চা ... অবস্থা সুবিধার দেখছি না। তারপর ওর রূমে আসার পর জোর করে বাচ্চাকে একটা ইঞ্জেকশন দিয়েছে।

কাহিনী এখানে শেষ হলেও খুশি হতাম। কিন্তু তারপর আমি চলে আসার পর বাচ্চার নানী যখন বাচ্চার কাপড় পাল্টাতে গেল তখন ভক করে নাকে দূর্গন্ধ এসে লাগলো। বাচ্চা ভুমিষ্ট হওয়ার পর ওকে গরম পানি দিয়ে গোসল দেয়ানোর কথা ... কিন্তু এখানে তা-ও করা হয়নি। একেই তো এয়ার কন্ডিশনারের ঠান্ডায় বাচ্চা কুঁকড়ে ছিলো তার উপর গোসল না দিয়ে কোনো রকমে তুলা দিয়ে মুছিয়ে তোয়ালে জড়িয়ে দিয়েছে। স্তম্ভিত নানী তারপর তাড়াতাড়ি করে গরম পানিতে বাচ্চাকে ধুইয়েছে। শুরুতেই বাচ্চাকে এরকম অসুস্থ করানোর জন্য ক্লিনিকওয়ালারা চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেনি বলে মনে হল (প্রসুতিকে ঠিকভাবে গাইড করেনি, স্বাভাবিকের বদলে সিজারিয়ান, কনকনে ঠান্ডা রূমে প্রসব করিয়ে বাচ্চাকে ঠান্ডা লাগানো, গোসল না দিয়ে জীবানুদের সুযোগ করে দেয়া, ইঞ্জেকশন?)। ফলে বাচ্চা এর পর বেশ কিছুদিন জ্বর, নাড়ি কাঁচা থাকা এবং জন্ডিসে ভুগেছে।

যা হোক অপারেশনের ক্ষত শুকানো মাত্র ঐ ক্লিনিক থেকে ওদেরকে রিলিজ করিয়ে আনা হয়েছে। ঐ কসাইখানা থেকে জীবিত বাচ্চা এবং মা-কে নিয়ে বের হয়ে আসতে পেরে আমরা সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ। নানীবাড়ি থেকে ঢাকায় আনার পর ঐ কয়েকদিনের বাচ্চাকে নিয়ে ঢাকায় রক্ত পরীক্ষা করানো হল ... বাচ্চা আমার কোলে, শাহেদ ক্লিনিকের কাউন্টারে কথা বলছে। যখন রক্ত নিল তখন বাচ্চা আমার কোলে --- সুঁইয়ের সাইজ ওর পায়ের পাতার চেয়ে বড়। পায়ের পাতা থেকে রক্ত নিল। রক্ত/সুঁই এই জিনিষগুলো আমি খুব ভয় পাই - দেখতে পারি না (যদিও নিজে আবার এদিক দিয়ে বেশ ভাল ছিলাম ... মাথা কামাইলে এখনও শুধু ঐটুকুতেই দুই ডজন দাগ দেখা যাবে, বাকী দেহের কথা না হয় বাদই দিলাম)। রক্ত নেয়ার সময় আমি বাচ্চাকে ধরে রেখেছিলাম .. .. যে লোক রক্ত নিল সে, শাহেদ সবাই আমাকে অভয় দিচ্ছে ... দৃশ্যটা বেশ মজার এবং করুণ। জন্মের সময় থেকেই বেচারীকে ভীষন প্রতিকূলতার বিরূদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছে - দূঃখ লাগে এজন্য যে সেই প্রতিকূলতাগুলো কৃত্রিমভাবে কিছু মানুষই(?!) সৃষ্টি করেছিলো।

মাঝে মাঝে ভাবি, বিদেশে যেখানে স্বাভাবিক প্রসবের জন্য এ্যাত চেষ্টা করা হয় সেখানে আমাদের কিছু ডাক্তার/ক্লিনিকগুলো এ্যাত কসাইগিরি করতে চায় কেন? টাকা কি মানুষকে এ্যাতই খারাপ বানিয়ে দেয়? যাদের উপর জীবনের জন্য নির্ভর করে মানুষ, তারাই কিনা এটা নিয়ে ছিনিমিনি খেলে! .... .... আরেকটু চিন্তা করলে বুঝি যে এটা আমাদের সিস্টেমের জন্যই হয়েছে। এদেশের বাস্তবতায়, এই সিস্টেম ভুল না শুদ্ধ সেই তর্ক তোলা থাক আপাতত। অন্য দেশের ডাক্তারগণের স্বাভাবিক প্রসবপ্রীতির পেছনেও টাকার ক্ষুধা কাজ করে - সেটা কেন তা ব্যাখ্যা করি একটু। জাপান বা অন্য উন্নত দেশে সকলের রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বীমা থাকে। চিকিৎসা খরচ দেয় সরকার, কিছু ক্ষেত্রে রোগীকে খরচের সামান্য অংশ বহন করতে হয়। অন্য দেশের কথা জানিনা, জাপানে প্রতি সন্তান প্রসবের জন্য ঐ ক্লিনিক/হাসপাতাল/ডাক্তার বেশ ভাল একটা টাকা পায় সরকার থেকে। এই টাকার পরিমান নির্দিষ্ট। কাজেই স্বাভাবিক প্রসবের বদলে যদি সিজারিয়ান করানো লাগে তাহলে ঐ ডাক্তার/ক্লিনিকের খরচ বেড়ে যাবে - ভাগের টাকা কম পড়ে যাবে। তাই ওরা প্রানান্ত চেষ্টা করে যে স্বাভাবিক ডেলিভারি হউক। অনেকক্ষেত্রেই সিজারিয়ান দরকার এমন রোগীকেও স্বাভাবিক প্রসব করানোর চেষ্টা থাকে। যেটা আমাদের দেশে জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য ভ্যাসেকটমি করানোর সেই প্রজেক্টের কথা মনে করিয়ে দেয়।

অসুখ বিসুখ হলে তাই পারতপক্ষে ডাক্তারের কাছে যাই না। ওমুখো না হওয়ার জন্য নিয়ম কানুন মেনে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার দাবার খাওয়ার চেষ্টা করি। আর, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা নেয়াটা হল আমার সর্বশেষ অপশন। দরকার হলে হোমিও ঔষধ খাই। অপেক্ষাকৃত কম প্রচারওয়ালা এই চিকিৎসা পদ্ধতিটা সম্পর্কে আজেবাজে কথা প্রচলিত থাকলেও জার্মানিতে আবিষ্কৃত এবং জার্মানি /আমেরিকা /পাকিস্থান /ভারত /বাংলাদেশে তৈরী ঔষধওয়ালা এপদ্ধতিতেই বেশি আস্থা রাখি (এক্ষেত্রে চিকিৎসা খরচ এবং সুঁই-এর অনুপস্থিতি আমার জন্য একটা বিরাট ইস্যূ)।

দেশে ভাল অনেক ডাক্তার আছেন ... যাঁরা সত্যিকারের চিকিৎসার উদ্দেশ্য নিয়েই চিকিৎসা করেন (এই মুহুর্তে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে চিকিৎসাগ্রহণরত স্ত্রীর পাশে বসে লিখছি)। তাঁদের অসম্মান করা এই পোস্টের উদ্দেশ্য নয়। নীতিগত ভাবে আমি হোমিও চিকিৎসা নেয়ার পক্ষপাতি হলেও বেশ কিছু ডাক্তার (এলোপ্যাথি) চিরজীবনই আমার কৃতজ্ঞতা পাবেন। আমার খারাপ অভিজ্ঞতাগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা; এতে, ডাক্তার বা চিকিৎসাপদ্ধতি খারাপ - এমন কোনো জেনেরালাইজেশনে না যাওয়াই ভাল।

(৭-মার্চ-২০০৯, বিকাল ৩:৩০)

সচলায়তনে প্রকাশিত

শুক্রবার, ৬ মার্চ, ২০০৯

বাচ্চা ভয়ংকর ডাক্তার ভয়ংকর!

(বাঁচতে হলে জানতে হবে টাইপ কথাবার্তা আছে ভেতরে ... বেশি ছোটরা না পড়াই ভাল)

আমার বিবাহিত জীবন প্রায় ছয় বছর ছুঁই ছুঁই করছে। বাচ্চা কাচ্চা নেয়ার কোন রকম অবকাশ পাই নাই এর মধ্যে। যখন বিয়ে করি তখন বউয়ের বুয়েট লাইফের ৩য় বর্ষ ... ২১তম বিসিএস-এর কল্যানে আমি কেবল গণপূর্ততে যোগদান করেছি আর ওদিকে পি.এইচ.ডি করার জন্য জাপান সরকারের বৃত্তি হবে হবে করছে। মাত্র চার মাস চাকুরী করেই একা জাপান চলে গেলাম। জাপান থাকাকালীন সময়েও গবেষণার নমুনা সংগ্রহের জন্য গড়ে প্রতি ৩ মাসে একবার করে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে আমার প্রফেসর .... কাজেই দৌড়ের উপরেই ছিলাম। বাংলাদেশে ঘন ঘন আসার ফলে হোম সিকনেস কেটে যেত - এই সুবিধা থাকলেও ঘন ঘন আসার ফলে জাপানে জীবন ধারণ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে জটিলতা দেখা দিত -- একবার তো লম্বা ভ্রমনের কারণে ঠিক সময়মত স্বাক্ষর করতে পারিনি বলে এক মাসের বৃত্তিই পাইনি।

যা হোক, জাপানে আমার বয়স দেড় বছরের মাথায় আমার স্ত্রী তাঁর বুয়েটের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েই চলে এল ... এর আগেও দুই সেমিস্টারের মাঝের বন্ধগুলোতে ৪৫ দিন করে দুইবার বেড়িয়ে গিয়েছিলো। বাকী আড়াই বছরেও বাচ্চা কাচ্চা নেয়ার চিন্তা করি নাই, কারণ আমার পি.এইচ.ডি.'র ঐ ক্রিটিকাল সময়ে এ সংক্রান্ত বিষয়ে সাপোর্ট দিতে তো পারতামই না বরং আমারই অতিরিক্ত সাপোর্ট দরকার ছিল।

দেশে ফেরার পর স্ত্রী আড়াই বছর পড়ালেখাবিহীন কাটানোর পর এখানে বুয়েটেই মাস্টার্স করতে ভর্তি হল। সমস্ত থিওরী কোর্স শেষ .... থিসিসও শেষ হওয়ার পথে। জন্ম নিয়ন্ত্রন বড়ি খেলে বা অন্য কোন ব্যবস্থা নিলে সেটার রাসায়নিক প্রভাব স্ত্রীর দেহে পড়ে তাই, উভয়ের সম্মতিতেই আমার বউ কোনরকম জন্ম নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি নেয়নি .... ইন্টারনেটের কল্যানে স্বাভাবিক নিয়ম আর আমার দিক থেকে প্রোটেকশন নেয়া হয়েছে। এদিকে পরিচিত আত্মীয় স্বজন সবাই কথা বার্তায় ডাক্তার দেখানো, বিভিন্ন জটিলতার কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। আড়ালে হয়তো, আমাদের দুইজনের মধ্যে কে সন্তান নিতে অক্ষম সেই বিষয়েও ফিসফাস আলোচনা চলে!

বউয়ের মাস্টার্স শেষের পথে, চাকুরী করে না .... তাই অনেকটা সামাজিক চাপে বাধ্য হয়েই বাচ্চা নেব বলে ঠিক করলাম কিছুদিন আগে। পরের মাসেই বউএর স্বাভাবিক জীবন ব্যহত হল। স্টিক টেস্টে গর্ভাবস্থা নিশ্চিত হওয়ার পরপরই বমি ইত্যাদি হয়ে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লো। কাজেই নিজের বাসা ছেড়ে মাসাধিককাল যাবৎ শ্বশুর মহাশয়ের অন্ন ধ্বংস করে চলেছি চোখ টিপি । অবস্থা এ্যাত বেশি খারাপ হল যে, পানি খেলেও এক মিনিটের মধ্যে বমি হয়ে বেরিয়ে আসছিলো। শরীরে পানির অভাবে প্রশ্রাব লালচে হয়ে গেল। ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেলাম। এদিকে নিজ বাসার বাইরে থাকার কারণে আমার ঘুম এবং টয়লেট ব্যহত হচ্ছে .... অনুভুতিটা সুখকর নয় .... কিন্তু বাচ্চার জন্য তো সারা জীবনেই কত কিছু ত্যাগ করতে হবে - এই চিন্তায় ওসব পাত্তা দেই না, শ্বশুর বাড়িতে আছি - এই আনন্দে মনটাকে ভরানোর চেষ্টা করি।

সারারাত আর দিন আমি বউয়ের দেখাশোনা করি, সন্ধ্যায় অফিসে যাই (বিকাল ৬টা থেকে ১০টা আমার ক্লাস নিতে হয়) ... ঐ সময় শুধু শাশুড়ি দেখাশোনা করেন। চোখের সামনে বউয়ের অমানুষিক কষ্ট দেখতেও খারাপ লাগে।

খালা শাশুড়ি ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তার, নিজের ক্লিনিকও আছে .... উনি পরামর্শ দিলেন যে গ্রীনরোডের সেন্ট্রাল হাসপাতালে প্রফেসর (ঢাকা মেডিকেল কলেজ) ফারহানা দেওয়ানকে দেখাতে। দেখালাম ... রক্ত পরীক্ষা এবং আলট্রাসনোগ্রাম করালেন। তারপর অতিরিক্ত বমির জন্য একটা ট্যাবলেট আর স্বাভাবিক ফলিক এসিডের জন্য আরেকটা ট্যাবলেটের ব্যবস্থাপত্র দিলেন। ১৪ মি.মি. বাচ্চার ছবি দেখে আমরা খুশি হই ... রিপোর্ট বলে ৬-৮ সপ্তাহের গর্ভাবস্থা, বাচ্চার হার্টবিট নাই; আমাদের হিসেবে যখন টেস্ট করা হয়েছে তখন বাচ্চার ভ্রুণের বয়স সর্বোচ্চ ৪ সপ্তাহ (স্বাভাবিক জন্ম নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলাম বলে ফার্টাইল পিরিওড সম্পর্কে ঠিক ঠাকভাবেই জানি)। ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী সব করলেও অবস্থা একটু ভাল হয়ে আবার খারাপ হতে থাকলো। বউ বারবার বলছে যে তাঁরটা স্পেশাল কেস যেখানে অবস্থা বেশি খারাপ থাকে এবং স্যালাইন নিতে হয়। আমরা (আমি, শাশুড়ি, শ্বশুর ইত্যাদি) এসবে পাত্তা দেই না ... কারণ এ্যাত বড় একজন প্রফেসরকে দেখিয়ে এনেছি ... পরবর্তীতে আরো দুইবার রিপোর্ট করেছি -- এরপরে কথা থাকা উচিত না ... যে ভোগে সে তো সহানুভুতি পাওয়ার জন্য অনেক কথাই বলে।

একমাসে অবস্থা আরো খারাপ হল ... প্রফেসর বললেন যে আরেকবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করাতে, বাচ্চার হার্টবিট এসেছে কি না সেটা নিশ্চিত হতে হবে -- এটাই বড় চিন্তার বিষয়। ওর খালা মেডিসিন থেকে পাশ করলেও স্পেশালাইজেশন হল মানসিক/মাদকাসক্ত চিকিৎসায় -- তাই নিজে আগ বাড়িয়ে মন্তব্য করেন না; কিন্তু ভাগ্নির অবস্থা এবং রিপোর্ট দেখে একটু ভ্রু কুঞ্চিত করলেন। তারপর বললেন যে তুমি একটু গ্লুকোজ খাও ... আর তোমাকে আমার ক্লিনিকের পাশেই আরেকটা ক্লিনিকে গাইনোকোলজিস্ট আছেন তাঁর সাথে পরামর্শ করি, তোমাকে একটু সেখানেও দেখাই। ইস্কাটনের সেই ক্লিনিকে দেখাতে নিয়ে গেল আমার শ্বশুর-শাশুড়ি এবং খালা শাশুড়ি .... উনি (ডাক্তার) দেখেই হলি ফ্যামিলিতে ভর্তি করাতে বললেন। কারণ উনি মূলত হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজ/হাসপাতালের ডাক্তার এবং ঐ ক্লিনিকটা রাস্তার উপরে হওয়াতে শব্দ বেশি।

ক্লাস নেয়া শেষ করে আমি সোজা হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে এসে দেখি হাতে স্যালাইন লাগিয়ে ওকে শুইয়ে রেখেছে, কয়েকটা ইঞ্জেকশনও দিয়েছে স্যালাইনের ঐ পথে (ক্যানোলা)। অবাক হয়ে দেখলাম, ওর সেই অস্বস্তিগুলো নেই। গত কয়েকদিনে রক্ত, প্রস্রাব ইত্যাদি পরীক্ষা নিরীক্ষায় জানা গেল যে, ওর শরীরে গ্লুকোজ, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি মারাত্নক রকম কমে গেছে। বাচ্চা ঠিক আছে ... সাইজে আরেকটু বড় হয়েছে (১৭ মি.মি.) আর হার্টবিট এসেছে।

এখানে যেই জিনিষটি অবাক লাগলো যে, প্রথমবার টেস্টেই কিন্তু ওর রক্তে গ্লুকোজ কম ধরা পড়েছিল। ওটার বিরূদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় আস্তে আস্তে অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। আমার বউয়ের ঐ কথাটাই ঠিক ছিল .... আসলেই ওর স্পেশাল কেস ... এই অবস্থাটার নাম হাইপারেমেসিস(সম্ভবত এরকমই কিছু খটমটে নাম) আর কারণ সম্ভবত:হাইপোগ্লাইসিমিয়া, পরিসংখ্যানগত ভাবে যেটা হাজারে ৫ জন গর্ভবতীর হয়ে থাকে। এই ব্যাপারটা কেন এ্যাত বড় প্রফেসরের চোখ এড়িয়ে গেল সেটাই খালাশাশুড়িকে চিন্তিত করে তুলেছে। মামা শ্বশুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক - মামী শাশুড়ির সূত্রে ওনার ঐ অধ্যাপকের বাসায় পরিচিতি আছে, উনি বললেন সম্ভবত প্রফেসরের বাসায় কিছু ঝামেলা চলছে, তাই একটু অমনোযোগী। আমি খারাপ মানুষ তাই খারাপ চিন্তাটাই আগে মাথায় আসে .... প্রফেসর সাহেব হয়তো চেয়েছিল যে আমার বউয়ের অবস্থা খারাপ হউক... তারপর নিজেরাই সুড়সুড় করে গিয়ে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি হব। কে জানে আসলে কী জন্য এমন করলো‍! এদিকে হলি ফ্যামিলিতে বেশ ভাল যত্ন নিচ্ছে .... এটা কী খালা শাশুড়ির পরিচয়ের সুবাদে, নাকি কেবিনে থাকি বলে ... নাকি হাসপাতালের গুনে সেটা বুঝতে পারি না।

সেন্ট্রাল হাসপাতালে খালা শাশুড়ির পরিচয়ের সূত্র ব্যবহার করি নাই। আর এখানকার সম্পর্কে ধারণাটা এমনিতেই ভাল না -- ব্যস্ত সড়কের উপরে অবস্থিত বলে আর সন্ধ্যায় কনসালটেন্সি রোগী/মেডিকেল প্রমোশন অফিসারদের ভীড়ে এটার যতদুর দেখেছি সেটা বাজারের মত সরগরম মনে হয়েছে। এছাড়া শাশুড়ির কলিগের আত্মীয়ের কাহিনীটাও সুখকর নয়। ঐ কলিগ (যার ছেলে বুয়েটে আমার রুমমেট/ক্লাসমেট ছিল ... ওর সূত্রেই শ্বশুরপক্ষের সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিল) এর আত্মীয়ের ছেলের একটা ফোঁড়া হয়েছিল। হাউ কাউ করে ছেলেকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো। ওখানে ফোঁড়া গালিয়ে দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে .. তারপর ঐ হাতটাকে গলার সাথে ঝুলিয়ে দিয়েছে (হাঁড় ভাঙ্গা রোগীদের যেমন দেয়) ---- এই পর্যন্ত কাহিনীতে কোন সমস্যা ছিল না .... কিন্তু এই কাজের জন্য ১২০০০ টাকা বিলটাই সব কেমন জানি করে দিল (হ্যাঁ ভাই, I repeat: বার হাজার টাকা!!)।

বর্তমানে গত রাত বাদ দিলে (আজ শুক্রবার বলে রাতে শাশুড়ি ছিলেন) চার রাত ধরে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালটাই আমার বাড়ি ঘর। এখানেই থাকি, খাই, ঘুমাই, গোছল করি ... এখান থেকেই সন্ধ্যায় অফিসে যাই (তখন শ্বশুর/শাশুড়ি পাহারা দেয়), অফিস শেষে এখানেই ফেরৎ আসি। বউ-এর রক্তের সমস্ত প্যারামিটারগুলো স্বাভাবিক হয়ে এসেছে .... তারপরেও কিছুটা অসুস্থ আছে। আগামী আরো দুই/এক মাস এমন যাবে, তারপর স্বাভাবিকভাবেই শরীরের হরমোন লেভেল এডজাস্ট হয়ে ঠিক হয়ে যাবে। এখন শরীরের অভাবগুলো স্যালাইন দিয়ে মিটিয়ে দিচ্ছে .... এ অবস্থায় বাসায় গেলে সমস্ত যত্নের মধ্যেও আবার এরকম হবে ... ১০/১২ দিন পর আবার এসে স্যালাইন নিতে হবে --- পরিচিতের মধ্যে দেশে/বিদেশে যারা এইরকম লক্ষণের মধ্য দিয়ে গেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা তাই বলে। ব্যাপারটা অনেকটা ব্যাটারি চার্জ করার মত। একবার রক্তে পুষ্টির চার্জ দিলে এতে ১০/১২ দিন যায়।

বাবা হওয়ার পথটা মোটেও সুখকর নয় .... না জানি সামনে আরো কী কী সইতে হবে। মন খারাপ

(এই লেখাটা গতকাল কেনা HP mini 1001TU নেটবুক কম্পিউটার ব্যবহার করে হাসপাতালে বসে লেখা। ৬ই-মার্চ-২০০৯, শুক্রবার দুপুর আড়াইটা)

সচলায়তনে প্রকাশিত

রবিবার, ১ মার্চ, ২০০৯

পরাজয়ের তেতো স্বাদ মুখে

সম্প্রতি বিডিআর বিদ্রোহের নামে যা ঘটলো তাতে পরাজিত হওয়ার একটা বাজে অনুভুতি হচ্ছে।

এই ধরণের পরিকল্পিত ঘটনা ঘটানোর সময় প্রথমেই একটা গ্রুপ সেন্টিমেন্টাল ইস্যূ খুঁজে বের করে, যেটা ঐ মূহুর্তে সৈন্যদের খেপিয়ে তুলতে পারে। জানা কথা গুলি চালানো শিক্ষা পাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বেশিরভাগেরই মগজ হাটুতে চলে আসে -- সুতরাং সহজেই তাঁদেরকে বিভ্রান্ত করে ভুল করানো সম্ভব হয়।

এই গ্রুপের কাজ হল তাতিয়ে তোলা, তারপর শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ। আগের গ্রুপ উন্মাদনা ছড়িয়ে দিলেও পাইকারী খুন করানোর মত অবস্থা করতে পারে না। বিভ্রান্তি ছড়ায় এই বলে যে ওরা তাদের অফিসারদের মেরেছে .... আবার ওদের কাছে গিয়ে বলে এরা মেরে ফেলেছে ... সবাইকে বলে তোমাদের একজন জওয়ানকে অফিসার গুলি করেছে। আর এদিকে কিন্তু কিলার গ্রুপ ঘুরে ঘুরে খুন করতে থাকে, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের মত। দলীয় বা মিছিলে মানুষের ব্যবহার পাল্টে যায় (মব বিহেভিয়ার বলে আলাদা শব্দই আছে) ... রক্তের বন্যায় কিছু দূর্বল চরিত্রের জওয়ানও খুনিদের মত আচরণ করতে থাকে।

আরেকটি গ্রুপ বিভ্রান্তি ছড়ানোর কাজে ব্যস্ত থাকে। চিল্লিয়ে মিডিয়াকে জানায় মনগড়া কিন্তু বেশ মর্মস্পর্শী কিছু কাহিনী। কিছুক্ষণের জন্য হলেও সেটা সময় পাইয়ে দেয় কসাইদের, অগোচরে নিরাপদে বের হয়ে চলে যাওয়ার জন্য। এদের আসা যাওয়া সহজ করার জন্য বাইরের দিকে এলোপাথারি গুলিও চলতে থাকে। খবর ছড়ানো হয় যে, সেনাবাহিনীর অগ্রসর ঠেকানোর উদ্দেশ্যে এই গুলি। আর্মার্ড কার বলে এক ধরণের বাহন আছে যেটা দিয়ে এই গুলির মধ্যেও চাইলে সেনারা এগোতে পারতো।

বাইরের এজেন্টরা মিছিল করায়, মিছিলের সাথে মিশে বেরিয়ে যায় আরো কিছু ঘাতক; অগ্রসরমান ট্যাঙ্ক বহরকে আটাকানোর চেষ্টা করে পাবলিক সেন্টিমেন্ট দিয়ে। বেশিরভাগের চোখকে ধুলা দিয়ে কী রকম সাবলিল ভাবে এ্যাত বড় একটা নিখুত ক্ষতি করে দিয়ে গেল দেশের সেনাবাহিনীর!

---
বুলডগকে শক্রুকে কামড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ দিলে সেটা মালিককের গাল চাটবে না .. তাদের দিকেও দাঁত খিচাবে .... এই বৈশিষ্টের বুলডগই দরকার। তাই বুটের লাত্থি খাওয়া ব্লাডি সিভিলিয়ান হলেও সেনাবাহিনীর গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নাই। তাঁদের এ্যাতজন উন্নত স্ট্র্যাটেজিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চৌকস শীর্ষ কর্মকর্তা হারানো সেনা কর্মকান্ডে একটা বিরাট শূণ্যতার সৃষ্টি করবে নিঃসন্দেহে।

---
সেনাবাহিনী মাথাশূণ্য হলে কার লাভ? যাদের লাভ তারাই করিয়েছে ... এটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নাই। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ধীরে ধীরে চৌকস এবং ঈর্ষনীয় একটা সেনাবাহিনীতে পরিণত হচ্ছিলো ... জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে তাঁদের দক্ষ অংশগ্রহণে এটা পুরা পৃথিবীর কাছেই প্রতীয়মান হয়েছে। এই সেনাবাহিনী অস্থিরতায় টালমাটাল দেশকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনলো; ক্ষমতা দখলের বদলে, দেশকে উপহার দিলো জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ডেটাবেস। ... সেনাবাহিনীকে কেন্দ্র করে একটা দেশের এ্যাতসব সফলতা কাদের চক্ষুশূল হতে পারে?

তাই এমন আক্রমণ অস্বাভাবিক বা অনাকাঙ্খিত ছিল না। কিন্তু সেটা ঠেকাতে না পেরে নিজেরা বিভ্রান্ত হয়ে একে অপরকে দোষারোপ করতে ব্যস্ত ছিলাম ... প্রতিপক্ষের ফাঁদে পা দিয়েছিলাম সবাই .... পারলাম না ক্ষতিটা ঠেকাতে।

---
৭১'এর ১৪ই ডিসেম্বরে দেশের বুদ্ধিজীবিদের হত্যা না করা হলে এ্যাতদিনে হয়তো তাঁদের কাছ থেকে সঠিক দিক নির্দেশনা পেয়ে দেশ হিসেবে আমরা মালয়েশিয়া/সিঙ্গাপুরকে ছাড়িয়ে যেতাম। কিন্তু প্রতিপক্ষ কার্যকর ক্ষতির জন্য সঠিক নীলনকশা বাস্তবায়ন করে আমাদের চরম ক্ষতি করতে সক্ষম হয়েছিল। ঐটি ছিল যুদ্ধে এদেশের সবচেয়ে বড় ক্ষতি।

আবার, শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের হারিয়ে একই রকম একটা বড় ক্ষতির সম্মূখীন হল দেশ। ভবিষ্যতে এই চৌকস কর্মকর্তাদের অভাবে না জানি কতদিন বিভিন্ন ভুলের পূনঃপৌনিক বৃত্তে ঘুরপাক খেতে হবে। কত ক্ষেত্রেই না জানি অন্য দেশগুলোর চাইতে পিছিয়ে পড়বো।

আসলেই আন্তর্জাতিক কুটকৌশলের কাছে আমরা আবার পরাজিত হলাম খারাপভাবে। মুখতা তিতা হয়ে গেছে ... সাথে রক্তের লোনা স্বাদটাও রয়ে গেছে।

(একই সাথে প্রজন্ম ফোরামে প্রকাশিত)