শনিবার, ৭ মার্চ, ২০০৯

অসহায় বাচ্চা, ভয়ংকর ডাক্তার

(বাঁচতে হলে জানতে হবে টাইপ কথাবার্তা আছে ... খোকা খুকিদের না পড়াই ভাল)

আমার ছোটভাই শাহেদের বাচ্চার বয়স প্রায় ৬ মাস। হাসিখুশি আমার এই ভাস্তিটার জন্মের সময়টার কথা মনে পড়লে এখনও ঐ ডাক্তারের উপর রাগে মাথায় রক্ত চড়ে যায়। শাহেদের বউ আমাদের কাজিন ছিল (আছে)। গর্ভের কয়েক মাসের সময় বাইরে বেশি ঘুরাঘুরি করার জন্য সম্ভবত হঠাৎ একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লো। ডাক্তার পরামর্শ দিল বেড-রেস্টে থাকার জন্য। এই সময়টাতে গর্ভবতী মেয়েরা সাধারণত তাঁদের মায়ের কাছে চলে যায় --- এই রেওয়াজ জাপানেও দেখে এসেছি। সুতরাং ও সাভারে ওদের বাসায় চলে গেল।

সাভারেই একটা ক্লিনিকের ডাক্তারকে দেখানোর ব্যবস্থা করা হল। ঐ লেডি-ডাক্তারের দেশের বাইরের বড় ডিগ্রী আছে, উপরন্তু শাহেদের সম্বন্ধীর (আমাদের ..তুতো ভাই) খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মা উনি। ক্লিনিকটা ঢাকা থেকে গেলে সাভার বাজার পার হয়ে কিছুদুর পরে প্রধান রাস্তার বামপাশে অবস্থিত (ভেলরি টেইলরের সি.আর.পি. ওটার উল্টা দিকে কিছুটা ভেতরে)। ডাক্তার সাহেবের আলিশান বাড়িটাও ক্লিনিকের সাথেই লাগোয়া। কাজেই বেশ নির্ভরতার সাথেই ওনার পরামর্শ মেনে চলতে থাকলো ওরা। বাইরের দেশগুলোতে গর্ভবতী মায়েদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয় ... সিজারিয়ান অপারেশন ছাড়াই স্বাভাবিক প্রসবের জন্য তাঁদের নিয়মিত বিভিন্ন ব্যায়াম করানো হয়। জাপানে থাকার সময় এই ব্যাপারটা দেখেছি .... কেউ আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারের জুনিয়র সিনেমাটা দেখে থাকলেও এই ধরনের সিন দেখে থাকবেন। অথচ, আমাদের ডাক্তার এ ধরণের কোন পরামর্শই দিয়েছে বলে কখনো শুনিনি। বরং সবসময়ই এমন কথা বলেন যে সব ঠিক আছে ইত্যাদি।

ফলে শুয়ে থাকতে থাকতে গর্ভবতীর ওজন বেড়ে গেল অস্বাভাবিক। ডেলিভারির সময়ে ঐ ক্লিনিকে ভর্তি করানো হল এবং বাচ্চার পজিশন ঠিক নাই এমন আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট দেখিয়ে সিজার করা হল। আমার ছোটচাচা হোমিওপ্যাথির ডাক্তার, থাকেন সেই কুড়িগ্রামে। উনি পরে বলেছিলেন যে, আসলে বাচ্চার পজিশনের যেই ব্যাপার দেখিয়ে সিজারিয়ান করানো হয় তার বেশিরভাগই ঠিক না। বাচ্চা শুরুতে উল্টা পজিশনেই থাকে। তারপর যতই প্রসবের দিন ঘনিয়ে আসতে থাকে ততই বাচ্চা ঘুরে পজিশনে আসতে থাকে; বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্লিনিকওয়ালাগণ সিজারিয়ান অপারেশন করে টাকা কামানোর জন্য এই পজিশনে আসার আগেই আল্ট্রাসনোগ্রাম করে উল্টা পজিশনের ছবি নেয়। পাশাপাশি ডেট পার হয়ে যাচ্ছে, ঠিক সময়ে প্রসব না হলে বাচ্চার ক্ষতি হবে -- এসব কানপড়া দিতে থাকে। পানি ভেঙ্গে গেলে বাচ্চার ক্ষতি হওয়ার কথাটা পুরাপুরি সত্য, কিন্তু সময় পার হয়ে যাচ্ছে ... এই কথাটা আতঙ্কিত করানোর জন্য বলা হয়; কারণ তা না হলে কয়েকদিন পরে স্বাভাবিক ভাবেই প্রসব হবে ... ওদের সিজারিয়ানের দাও মারা হবে না। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা ভাল - আমার ছোটচাচীর ৫জন সন্তান (+১ জন জন্মের পর মারা গিয়েছিল) সকলেই স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে।

যেদিন সন্ধ্যায় বাচ্চা হল, তার পরদিন দেখতে গেলাম। বাচ্চা কোলে নিয়েই মনে হল ওর গায়ে জ্বর। আঙ্গুল দিয়ে বাচ্চার ভ্রুর উপরে এবং কপালে একটু ঘষে ম্যাসেজ করে দিলে বাচ্চা আরামে চোখ বন্ধ করে ফেলে। বাচ্চার মা-বাবা, খালারা সকলের কাছেও তাই মনে হল। তখন বাচ্চার মা বলছিল যে গতরাত্রে যখন সিজারিয়ান করতে নিয়ে যাওয়া হল তখন ঐ কক্ষের তাপমাত্রা এত কমানো ছিল যে ও ঠান্ডায় কাঁপছিলো। এই ঠান্ডার মধ্যে বাচ্চা বের করে ওরা বলাবলি করছিলো যে দূর্বল বাচ্চা ... অবস্থা সুবিধার দেখছি না। তারপর ওর রূমে আসার পর জোর করে বাচ্চাকে একটা ইঞ্জেকশন দিয়েছে।

কাহিনী এখানে শেষ হলেও খুশি হতাম। কিন্তু তারপর আমি চলে আসার পর বাচ্চার নানী যখন বাচ্চার কাপড় পাল্টাতে গেল তখন ভক করে নাকে দূর্গন্ধ এসে লাগলো। বাচ্চা ভুমিষ্ট হওয়ার পর ওকে গরম পানি দিয়ে গোসল দেয়ানোর কথা ... কিন্তু এখানে তা-ও করা হয়নি। একেই তো এয়ার কন্ডিশনারের ঠান্ডায় বাচ্চা কুঁকড়ে ছিলো তার উপর গোসল না দিয়ে কোনো রকমে তুলা দিয়ে মুছিয়ে তোয়ালে জড়িয়ে দিয়েছে। স্তম্ভিত নানী তারপর তাড়াতাড়ি করে গরম পানিতে বাচ্চাকে ধুইয়েছে। শুরুতেই বাচ্চাকে এরকম অসুস্থ করানোর জন্য ক্লিনিকওয়ালারা চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেনি বলে মনে হল (প্রসুতিকে ঠিকভাবে গাইড করেনি, স্বাভাবিকের বদলে সিজারিয়ান, কনকনে ঠান্ডা রূমে প্রসব করিয়ে বাচ্চাকে ঠান্ডা লাগানো, গোসল না দিয়ে জীবানুদের সুযোগ করে দেয়া, ইঞ্জেকশন?)। ফলে বাচ্চা এর পর বেশ কিছুদিন জ্বর, নাড়ি কাঁচা থাকা এবং জন্ডিসে ভুগেছে।

যা হোক অপারেশনের ক্ষত শুকানো মাত্র ঐ ক্লিনিক থেকে ওদেরকে রিলিজ করিয়ে আনা হয়েছে। ঐ কসাইখানা থেকে জীবিত বাচ্চা এবং মা-কে নিয়ে বের হয়ে আসতে পেরে আমরা সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ। নানীবাড়ি থেকে ঢাকায় আনার পর ঐ কয়েকদিনের বাচ্চাকে নিয়ে ঢাকায় রক্ত পরীক্ষা করানো হল ... বাচ্চা আমার কোলে, শাহেদ ক্লিনিকের কাউন্টারে কথা বলছে। যখন রক্ত নিল তখন বাচ্চা আমার কোলে --- সুঁইয়ের সাইজ ওর পায়ের পাতার চেয়ে বড়। পায়ের পাতা থেকে রক্ত নিল। রক্ত/সুঁই এই জিনিষগুলো আমি খুব ভয় পাই - দেখতে পারি না (যদিও নিজে আবার এদিক দিয়ে বেশ ভাল ছিলাম ... মাথা কামাইলে এখনও শুধু ঐটুকুতেই দুই ডজন দাগ দেখা যাবে, বাকী দেহের কথা না হয় বাদই দিলাম)। রক্ত নেয়ার সময় আমি বাচ্চাকে ধরে রেখেছিলাম .. .. যে লোক রক্ত নিল সে, শাহেদ সবাই আমাকে অভয় দিচ্ছে ... দৃশ্যটা বেশ মজার এবং করুণ। জন্মের সময় থেকেই বেচারীকে ভীষন প্রতিকূলতার বিরূদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছে - দূঃখ লাগে এজন্য যে সেই প্রতিকূলতাগুলো কৃত্রিমভাবে কিছু মানুষই(?!) সৃষ্টি করেছিলো।

মাঝে মাঝে ভাবি, বিদেশে যেখানে স্বাভাবিক প্রসবের জন্য এ্যাত চেষ্টা করা হয় সেখানে আমাদের কিছু ডাক্তার/ক্লিনিকগুলো এ্যাত কসাইগিরি করতে চায় কেন? টাকা কি মানুষকে এ্যাতই খারাপ বানিয়ে দেয়? যাদের উপর জীবনের জন্য নির্ভর করে মানুষ, তারাই কিনা এটা নিয়ে ছিনিমিনি খেলে! .... .... আরেকটু চিন্তা করলে বুঝি যে এটা আমাদের সিস্টেমের জন্যই হয়েছে। এদেশের বাস্তবতায়, এই সিস্টেম ভুল না শুদ্ধ সেই তর্ক তোলা থাক আপাতত। অন্য দেশের ডাক্তারগণের স্বাভাবিক প্রসবপ্রীতির পেছনেও টাকার ক্ষুধা কাজ করে - সেটা কেন তা ব্যাখ্যা করি একটু। জাপান বা অন্য উন্নত দেশে সকলের রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বীমা থাকে। চিকিৎসা খরচ দেয় সরকার, কিছু ক্ষেত্রে রোগীকে খরচের সামান্য অংশ বহন করতে হয়। অন্য দেশের কথা জানিনা, জাপানে প্রতি সন্তান প্রসবের জন্য ঐ ক্লিনিক/হাসপাতাল/ডাক্তার বেশ ভাল একটা টাকা পায় সরকার থেকে। এই টাকার পরিমান নির্দিষ্ট। কাজেই স্বাভাবিক প্রসবের বদলে যদি সিজারিয়ান করানো লাগে তাহলে ঐ ডাক্তার/ক্লিনিকের খরচ বেড়ে যাবে - ভাগের টাকা কম পড়ে যাবে। তাই ওরা প্রানান্ত চেষ্টা করে যে স্বাভাবিক ডেলিভারি হউক। অনেকক্ষেত্রেই সিজারিয়ান দরকার এমন রোগীকেও স্বাভাবিক প্রসব করানোর চেষ্টা থাকে। যেটা আমাদের দেশে জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য ভ্যাসেকটমি করানোর সেই প্রজেক্টের কথা মনে করিয়ে দেয়।

অসুখ বিসুখ হলে তাই পারতপক্ষে ডাক্তারের কাছে যাই না। ওমুখো না হওয়ার জন্য নিয়ম কানুন মেনে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার দাবার খাওয়ার চেষ্টা করি। আর, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা নেয়াটা হল আমার সর্বশেষ অপশন। দরকার হলে হোমিও ঔষধ খাই। অপেক্ষাকৃত কম প্রচারওয়ালা এই চিকিৎসা পদ্ধতিটা সম্পর্কে আজেবাজে কথা প্রচলিত থাকলেও জার্মানিতে আবিষ্কৃত এবং জার্মানি /আমেরিকা /পাকিস্থান /ভারত /বাংলাদেশে তৈরী ঔষধওয়ালা এপদ্ধতিতেই বেশি আস্থা রাখি (এক্ষেত্রে চিকিৎসা খরচ এবং সুঁই-এর অনুপস্থিতি আমার জন্য একটা বিরাট ইস্যূ)।

দেশে ভাল অনেক ডাক্তার আছেন ... যাঁরা সত্যিকারের চিকিৎসার উদ্দেশ্য নিয়েই চিকিৎসা করেন (এই মুহুর্তে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে চিকিৎসাগ্রহণরত স্ত্রীর পাশে বসে লিখছি)। তাঁদের অসম্মান করা এই পোস্টের উদ্দেশ্য নয়। নীতিগত ভাবে আমি হোমিও চিকিৎসা নেয়ার পক্ষপাতি হলেও বেশ কিছু ডাক্তার (এলোপ্যাথি) চিরজীবনই আমার কৃতজ্ঞতা পাবেন। আমার খারাপ অভিজ্ঞতাগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা; এতে, ডাক্তার বা চিকিৎসাপদ্ধতি খারাপ - এমন কোনো জেনেরালাইজেশনে না যাওয়াই ভাল।

(৭-মার্চ-২০০৯, বিকাল ৩:৩০)

সচলায়তনে প্রকাশিত

কোন মন্তব্য নেই: