সোমবার, ১৭ জুলাই, ২০১৭

কাউন্সেলিং বিষয়ক চিন্তাভাবনা

বর্তমানে কাউন্সেলিং শব্দটি আমাদের কর্মক্ষেত্রের প্রশাসনিক পরিমণ্ডলে বার বার ঘুরে ফিরে আসছে। সাধারণ ভাবে মনে হয় councelling -এই ইংরেজি শব্দটির অর্থ কাউকে পরামর্শ দেয়া। কিন্তু গুগল আংকেলের কাছে এই বিষয়টির ব্যাপারে জানতে চেয়ে ধারণা হল, এর ব্যাপ্তি আরো অনেক গভীর এবং এটা করতে চাইলে রীতিমত আলাদা দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষন নেয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়।

গুগলে কাউন্সেলিং লিখে সার্চ দিলে এই সংজ্ঞাটি আসে
Counselling is a type of talking therapy that allows a person to talk about their problems and feelings in a confidential and dependable environment. A counsellor is trained to listen with empathy (by putting themselves in your shoes). They can help you deal with any negative thoughts and feelings you have.
অনলাইনে এ বিষয়ে বিভিন্ন রকম সাহায্যমূলক পোস্টও দেখলাম (বাংলা এবং ইংরেজিতে) – কয়েকটির বিষয়বস্তু হচ্ছে যে কখন নিজেই বুঝতে পারবো আমার কাউন্সেলিং দরকার। আমার মনে হয়, একজনের পক্ষে নিজে নিজেই এই সমস্যা এবং প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারার বিষয়টা হল সবচেয়ে ভাল অবস্থা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই অন্যেরা একজনের মাঝে অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করলেও সেই ব্যক্তি নিজে কিন্তু সেটা অনুভব করতে পারেন না; এমনকি কেউ যদি বলে তোমার কাউন্সেলিং দরকার, তাহলে উল্টা মাইন্ড করে বসতে পারে। বিশেষত শিশুদের ক্ষেত্রে অবশ্যই আরেকজন দক্ষ এবং অভিজ্ঞ চোখের দরকার হয়, যে শিশুদের আচরণের মধ্যে অস্বাভাবিকতা থাকলে সেটা চিহ্নিত করতে পারবে এবং সেই অনুযায়ী সঠিক ব্যবস্থা নিবে। আমার ধারণা, শিশুকে সরাসরি কিছু কাউন্সেলিং দেয়ার পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রেই তার পরিবারকে কাউন্সেলিং দেয়া বেশি জরুরী হয়ে যায়।

অর্থাৎ সকলেরই হয়তো কাউন্সেলিং-এর দরকার নাই। কারো কারো দরকার আছে। কেউ যদি সেটা নিজেই বুঝতে পারে তাহলে তো ভাল, কিন্তু না হলে আরো কিছু চোখ দরকার যারা দেখে শুনে কিংবা তাদের অজান্তেই কিছু মানসিক বিষয় পরীক্ষা করে দেখে কাউন্সেলিং দরকার – এমন ব্যক্তি চিহ্নিত করতে পারবেন। চিহ্নিত ব্যাক্তিটি প্রতিষ্ঠানের স্টাফ, কর্মকর্তা, শিক্ষক কিংবা ছাত্র হতে পারে।

আপনাদের হয়তো জানা আছে, সরকারী চাকুরীর মৌখিক পরীক্ষা বা সাক্ষাতকারের সময়ে সেই ভাইবা বোর্ডে একজন মানসিক বিশেষজ্ঞ বসে থাকেন এবং চাকুরীপ্রার্থীর আচরণ এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করতে থাকেন। একই রকম বা এর চেয়েও সিরিয়াসভাবে মানসিক গড়ন পরীক্ষা করা হয় সেনাবাহিনীর নিয়োগ প্রক্রিয়ায়। আমার বাচ্চার স্কুলেও এরকম পূর্ণকালীন সাইক্রিয়াটিস্ট আছে বলে শুনেছি।

কিছু কিছু অস্বাভাবিকতা আমরা যে কেউ চিহ্নিত করতে পারি – যেমন ক্লাসে অমনোযোগী, বাচালতা, উগ্রতা, মনমরা হয়ে থাকা ইত্যাদি। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলোর সমাধানও সকলের জানা - যদিও সব ইস্যূতে প্যাঁদানি দেয়া কোনো সঠিক সমাধান হতে পারে না ... ... আবার, এখন তো স্কুলে মারধর করা আইনত নিষেধ (ইস্ আমাদের সময়ে যদি এমন থাকতো! ...); আর কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের মারধর তো দুরের কথা, বকা দিতেও এখনকার যুগে রীতিমত ভয় লাগে ... ...। আমি যতটুকু বুঝি, বকা দিয়ে এই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হয় না। ভারতীয় নায়ক আমীর খানের ‘তারে জামিন পার’ সিনেমাটি হয়তো অনেকেরই দেখা আছে - এটা এবিষয়ে চিন্তার খোরাক যোগাবে।

কাউন্সেলিংএর কথা একটু বাদ থাক ... আমরা যে শিক্ষকতা করি সেটারই উপযুক্ত প্রশিক্ষণ কয় জনের আছে? আমি নিজে প্রকৌশলী হওয়ার শিক্ষা পেয়েছি, শিক্ষকতা করার জন্য কিছু আলাদা দক্ষতার প্রয়োজন আছে, যা বিকাশের জন্য কোন উপযুক্ত প্রশিক্ষন পাইনি – আমাদের পাঠ্য সিলেবাসে ছিল না। সম্ভবত বেশিরভাগ বিষয়ের শিক্ষকগণেরও আমার মত একই অবস্থা – আমরা গান শিখে নয়, বরং গাইতে গাইতে গায়েন হয়েছি। আমার ধারণা, যাঁরা লেখাপড়া বিষয়ে লেখাপড়া করেন অর্থাৎ বি.এড, এম.এড করেন (কিংবা পুরানা আমলের বি.এ.বি.টি) তাঁদেরকে এই বিষয়গুলোর অনেকটাই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আবার বিদেশী, বিশেষত আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রীর কোর্স কনটেন্ট ঘাটাঘাটি করে দেখেছি সেখানে ক্লাস ম্যানেজমেন্ট, প্রশ্নপত্র প্রণয়ণ, গবেষণার পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়ে রীতিমত কোর্সওয়র্ক করতে হয়। – এর উপরে যুক্ত হচ্ছে কাউন্সেলিং; কাউন্সেলিংকে আলাদাভাবে চিন্তা করছি তার কারণ আছে ...

কার কাউন্সেলিং-এর দরকার আছে সেটা চিহ্নিত করাটা একটা প্রাথমিক কাজ। এটার জন্য প্রশিক্ষণ দরকার আছে। চিহ্নিত করার জন্য হয়তো কিছু ধাপে ধাপে করার মত প্রক্রিয়া আছে, হয়তো কিছু প্রশ্নপত্র আছে যার অনেকগুলো সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে – সেই উত্তরের প্যাটার্ন থেকে একেকজনের মানসিক গড়নটা বেরিয়ে আসবে, অস্বাভাবিকত্ব থাকলেও বেরিয়ে আসবে। হয়তো কিছু মানসিক পরীক্ষা আছে, যেগুলোতে প্রতিক্রিয়া দেখে অস্বাভাবিকত্ব চিহ্নিত করা যাবে।

সম্ভবত, এর পরের কাজ হল সেই কাউন্সেলিং দেয়া অথবা তাকে অভিজ্ঞ কাউন্সেলরের কাছে পাঠানো। ছাত্র কাউন্সেলিং নিয়ে গুগল আংকেল ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে দেখলাম বিদেশি কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সেলিং বিষয়ে রীতিমত আলাদা বিরাট সেটাপ রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন রকম বিষয়ে কাউন্সেলিং দেয়া হয়; বিষয়গুলোর নামের উদাহরণ দিচ্ছি -যেমন আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির (Iowa State University) কাউন্সেলিং বিষয়ক বিভাগের ওয়েব পেজ অনুযায়ী বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায়:

- আত্মপরিচয় এবং নৈতিকতা (exploration of identity and values)
- পেশাগত উন্নয়ন – ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং? (exploration and development of career and majors)
- সম্পর্ক বিষয়ক সমস্যা (relationship problems)
- হীনমন্যতা (low self-esteem)
- চাপ (stress)
- একাকীত্ব (loneliness)
- মানসিক অবস্থার সমস্যা, মনমরা থাকা (mood disturbances or depression)
- সামাজিক রীতিনীতির পার্থক্য অভিযোজন বিষয়ক (cultural exploration or navigating differences)
- যৌননিপীড়ন থেকে আরোগ্য (sexual assault recovery)
- শরীরবৃত্তীয় অথবা খাদ্যাভাস বিকৃতি বিষয়ক (body image or disordered eating concerns)
- মানসিক আঘাত এবং/অথবা অত্যাচার (trauma and/or abuse)
- যৌনপ্রবৃত্তি বা পরিচয় বিষয়ক (questioning sexual identity or orientation)
- দ্রব্যের অপব্যবহার (substance misuse)
- লেখাপড়া বিষয়ক কিংবা প্রেরণা (academic concerns or motivation)

এ্যাতসব বিষয়ে সম্যক জানা এবং কাউকে সঠিক পরামর্শ দেয়া এবং তাঁর মানসিক পর্যায়ে প্রভাবিত করা যে কোন একজনের পক্ষে বেশ কঠিন কাজ হবে বলেই মনে হয়। আর, যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছাড়া এটা করতে গেলে হীতে-বিপরীত প্রতিক্রিয়া হবে না - এমনটিও নিশ্চিত করা যায় না। ব্যক্তিগত কাউন্সেলিং ছাড়া দলগত কাউন্সেলিংও আছে বলে দেখেছি। এমনকি সমবেত সংগীতে অংশগ্রহণ করলেও কিছু বিষয়ে উপকার হয় বলে কোথায় জানি পড়েছিলাম। পরিবেশ, শব্দ, রং, সংগীত সবই মানুষের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা (এবং অসুস্থতা) প্রভাবিত করে বলে বেশ ভালো গবেষণা প্রকাশনা রয়েছে। মানুষের মনের অলিগলিতে কত রহস্য লুকিয়ে আছে কে জানে। আমার মনে হচ্ছে, এই বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষিত একটা লোকবল যে কোন প্রতিষ্ঠানের সফলতার জন্য একটা মূল্যবান সম্পদ হতে পারে।

দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকায় গত ৩১-জানুয়ারী-২০১৬ সালে এ বিষয়ক একটা অসাধারণ উপসম্পাদকীয় প্রকাশিত হয় যা হুবহু নিচে তুলে ধরা হল। এখানে লেখকদ্বয় সরাসরি বলে দিয়েছেন কাউন্সেলিং মানে শুধু পরামর্শ দেয়া নয় …

মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় কাউন্সেলিং
গ্লোরিয়া রোজারিও ও প্রিয়াংকা শঙ্কর দাস

একটি হাসপাতালের মানসিক বিভাগে আমার ভিজিটিং কার্ড দিতে গিয়েছিলাম, যাদের কাউন্সেলিং প্রয়োজন তাদের যেন ‘রেফার’ করা হয়। কিন্তু মানসিক ডাক্তারের কথায় আমি হতবাকই হলাম। তিনি বললেন যে ‘আমিই কাউন্সেলিং করি। কারো কাছে আমার ‘রেফার‘ করার প্রয়োজন হয় না। ’

আরেক দিন একটি স্কুলে গিয়ে প্রচার চালাচ্ছিলাম, যেসব ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষকের মানসিক সমস্যার জন্য সাহায্যের দরকার তারা যেন কাউন্সেলিংয়ের জন্য ‘রেফার’ করেন। দুজন শিক্ষক আমাকে মুখের ওপর ফের বলে দিলেন, ‘ছাত্রছাত্রীদের আমরাই কাউন্সেলিং করি। ’ এ তো একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ হয়ে দাঁতের যন্ত্রণায় কাতর রোগীর দাঁতের অপারেশন করার শামিল। একজন স্কুল শিক্ষক যদি মানসিক সমস্যার জন্য কাউন্সেলিং করেন (প্রশিক্ষণ ছাড়া), তাহলে ওই রোগী বা ক্লায়েন্ট কি সঠিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাবে? তাঁদের কথা শুনে ভাবলাম, সবাই যদি কাউন্সেলিং করেন, তবে যাঁরা কাউন্সেলিংয়ের ওপর পড়াশোনা ও উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তাঁদের কাজ কী হবে!

অপ্রিয় হলেও সত্য যে এখনো পর্যন্ত অনেকেরই কাউন্সেলিং সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই। অনেকেই ভাবেন, কাউন্সেলিং হলো পরামর্শ দেওয়া। কিন্তু না, কাউন্সেলিং মোটেও পরামর্শ দেওয়া নয়। কাউন্সেলিংয়ে মূলত একজন মানুষের চিন্তাভাবনা, আবেগ ও আচরণগত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা হয়। তাই আমাদের এ লেখার মূল উদ্দেশ্য হলো কাউন্সেলিং সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেওয়া।

কাউন্সেলিং প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল প্রাচীন সভ্যতার মিসর, মেসোপটেমিয়া (বর্তমানে ইরাক) ও পারস্যে (ইরান)। সেখানকার ধর্মযাজকরা মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি দান করতেন। ঐতিহাসিক পণ্ডিতদের মতে, সমসাময়িক কাউন্সেলরদের আবির্ভাব ঘটে ১৮০০ শতকের পর। তখনকার কাউন্সেলররা মূলত ছিলেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক (বিশেষত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষক), যাঁরা ছাত্রদের শুধু একাডেমিক ফলাফল ছাড়াও তাদের ব্যক্তিগত বিভিন্ন সমস্যা, যেমন আবেগীয় ও আচরণগত সমস্যা, এসব ক্ষেত্রে তাদের সাহায্য করে কাউন্সেলরের ভূমিকা পালন করতেন। আমেরিকার কংগ্রেস ১৯৫৮ সালে ন্যাশনাল ডিফেন্স এডুকেশন অ্যাক্ট (এনডিইএ) চালু করে এবং এর মাধ্যমে স্কুলগুলোতে কাউন্সেলিংয়ের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে।

যে ব্যক্তি কাউন্সেলিং দেন, তিনিই কাউন্সেলর। একজন ব্যক্তি কাউন্সেলিং পেশায় সংশ্লিষ্ট হওয়ার জন্য তাঁকে মনোবিজ্ঞানে অনার্স ও কাউন্সেলিং সাইকোলজি কিংবা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে উচ্চতর শিক্ষা অর্থাৎ মাস্টার্স, সেই সঙ্গে দক্ষতা অর্জনের জন্য বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হয়। আর যে ব্যক্তি কাউন্সেলিং সেবা নেন তাঁকে বলা হয় ক্লায়েন্ট।

কাউন্সেলিং এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে একটি পেশাগত সম্পর্ক বিরাজ করে এবং ব্যক্তিগত, দলগত ও পারিবারিক বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা হয়। ফলে তাদের মধ্যে নিজেদের ও অন্যদের সম্পর্কে এমন একটা স্পষ্ট ধারণা জন্মায় যেটা তাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা ও দ্বন্দ্বগুলো সফলভাবে কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। অনেকেই কাউন্সেলিং ও সাইকোথেরাপি শব্দ দুটি সমার্থক কিংবা একই অর্থে অদলবদল করে ব্যবহার করে। থেরাপি শব্দটি গ্রিক শব্দ থেরাপিয়া থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘একসঙ্গে পথ হাঁটা’। কাউন্সেলিং প্রক্রিয়ায় কাউন্সেলর ও ক্লায়েন্ট একসঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করেন। তাহলে দুটি বিষয়ই অর্থাৎ কাউন্সেলিং ও সাইকোথেরাপির কাজ মোটামুটি একই রকম।

কাউন্সেলরের প্রাথমিক কাজ হলো ক্লায়েন্টকে তার নেতিবাচক চিন্তাপদ্ধতি পরিবর্তন, প্রতিরোধ, পুনর্বাসন, জীবনের মানোন্নয়ন ও বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে সে যেন তার অনুকূল মাত্রায় মনঃসামাজিক কাজকর্মে সক্রিয় হতে পারে সে ক্ষেত্রে তাকে সাহায্য করা। এ জন্য কাউন্সেলররা মানসিক স্বাস্থ্য, মনোবৈজ্ঞানিক ও মানুষের বিকাশগত বিভিন্ন তত্ত্ব প্রয়োগ করে চিন্তাভাবনা, আবেগীয়-আচরণীয় অথবা নিয়মতান্ত্রিক বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে তাদের ভালো থাকা বা সুস্থ থাকা, ব্যক্তিগত বিকাশ অথবা পেশাগত উন্নয়ন, এমনকি মনোরোগ থাকলে সে ক্ষেত্রেও সাহায্য করে থাকেন।

কাউন্সেলরের ভূমিকা অন্যান্য পেশা থেকে ভিন্ন। কারণ এখানে কাউন্সেলর সমস্যাটির দিকে খেয়াল করেন এই ভেবে যে এই সমস্যাটি ব্যক্তি, নিয়ম ও সংস্কৃতি—সব মিলিয়েই বেড়ে চলেছে। কাউন্সেলররা রোগ নির্ণয় ও প্রতিকারের তুলনায় বেশি খেয়াল করেন ক্লায়েন্টদের মানসিক বিকাশ ও মানসিক ব্যাধি প্রতিরোধ, দক্ষতা, গুণাগুণ, মানসিক শক্তির উৎস ও চাপ নিয়ন্ত্রণ করা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর।

সাধারণত কাজে অনাগ্রহ, সামাজিক ভয়, প্রিয়জনকে হারানোর বেদনায় আচ্ছন্ন, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, যোগাযোগে অক্ষম, অবিরাম চিন্তা, দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন, যেকোনো মাদকে আসক্ত হয়ে পড়া, শুচিবায়ু, বারবার হাত ধোয়া, হতাশাগ্রস্ততা, একাকিত্ব, আশাহীনতা, পেটে সমস্যা, মাথাব্যথা, অকারণে জ্ঞান হারানো, অনিয়ন্ত্রিত রাগ, ভাঙচুর করা, মিথ্যা কথা বলা, অতি চঞ্চলতা, অমনোযোগী, অটিজম, মিশতে না পারা, দুঃখজনক ঘটনা থেকে প্রাপ্ত আঘাত, দুঃস্বপ্ন দেখা, নিদ্রাহীনতা, ঘুমে ব্যাঘাত, মন মরা হয়ে থাকা কিংবা অনিয়ন্ত্রিত আনন্দ করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং করা হয়।

কাউন্সেলিং প্রক্রিয়াটি যখন শুরু হয় তখন ক্লায়েন্ট তার মনের কষ্টের সব কথা খুলে বলতে থাকে। দুঃখের কথা বলতে গিয়ে অনেক সময়ই সে খুব কান্নাকাটি করে, ভেঙে পড়ে। তখন ক্লায়েন্ট নিজেও হয়তো মনে করতে পারে যে এখানে এসে সব কিছু খুলে বলে তো আমি আবারও আগের সেই আঘাত পাওয়া মুহূর্তের কষ্টটা পাচ্ছি। তাহলে আমার সঙ্গে এটা কী হচ্ছে? এটা কাউন্সেলিং প্রক্রিয়াতে ক্লায়েন্টের জন্য বিপজ্জনক। কিন্তু ভয়ের কিছুই নেই; সেই বিপজ্জনক মুহূর্তটিতেও তাকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্যই কাউন্সেলররা আছেন। কাউন্সেলরই ওই মুহূর্তটিতে তাকে সহায়তা করবেন স্থির হওয়ার জন্য, ভালো থাকার জন্য।

কাউন্সেলিং সেশনটি সাধারণত হয় ৪৫-৫০ মিনিটের। আর কাউন্সেলিং সেশন সংখ্যার গড় হলো সাত-আটটি। তবে সমস্যার বিষয়ভেদে ও ক্লায়েন্ট অনুযায়ী সেশন সংখ্যা কমবেশি হতে পারে।

কাউন্সেলিং সেশনে গোপনীয়তা রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে ক্লায়েন্ট কাউন্সেলরের কাছে যেসব কথা বলবে সেসব কথা গোপন রাখা হয়। তবে তিনটি ক্ষেত্রে গোপনীয়তা ভাঙা হবে। প্রথমত, ক্লায়েন্টের যদি আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে, তাহলে ক্লায়েন্টের মা-বাবা বা কাছের মানুষদের তার জীবন বাঁচানোর জন্যই তথ্যটি জানাতে হবে। দ্বিতীয়ত, ক্লায়েন্ট যদি কাউকে হত্যার পরিকল্পনা করে। তৃতীয়ত, যদি কখনো কোর্ট থেকে নির্দেশ আসে। তবে এ তথ্যগুলো জানানোর আগে অবশ্যই ক্লায়েন্টকে এ বিষয়ে বলে নেওয়া হবে।

আমাদের দেশে কাউন্সেলিং করাতে হলে ফি দিতে হয় ৬০০ থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে কিছু কিছু জায়গায় বিনা মূল্যেও কাউন্সেলিংসেবা পাওয়া যায়। যেমন—ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য টিএসসির কাউন্সেলিং ও গাইডেন্স সেন্টারে।

কাউন্সেলিং হলো মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য একটি পেশাগত প্রক্রিয়া। একজন পেশাদার কাউন্সেলরের এ পেশা চর্চা করার জন্য একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। কাউন্সেলররা দক্ষতার সঙ্গে ক্লায়েন্টদের আবেগ, চিন্তাভাবনা ও আচরণ নিয়ে কাজ করেন। কাউন্সেলিং নেওয়ার আগে কাউন্সেলরের যোগ্যতা সম্পর্কে জেনে নিন, যেন সঠিক সেবা পেতে পারেন।


লেখকদ্বয় : গ্লোরিয়া রোজারিও, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও
প্রিয়াংকা শংকর দাস, কাউন্সেলর, হিলিং হার্ট কাউন্সেলিং ইউনিট, বসুন্ধরা, ঢাকা

ধৈর্যসহ এ্যাতদুর পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

সহায়কমূলক তথ্যসূত্রসমূহ:
http://www.kalerkantho.com/print-editio … /31/319282 (মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় কাউন্সেলিং)
https://bn.thecabindhaka.com.bd/10-sign … -health-2/ (১০ টি সংকেত যা নির্দেশ করে আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কাউন্সেলিং দরকার)
http://www.newsbangladesh.com/details/2399 (অনলাইনে সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং)

সোমবার, ১ মে, ২০১৭

নিয়োগযোগ্যতার জরুরী গুণাবলী - জেনে রাখা ভাল


ভূমিকা

কিছুদিন আগে নিয়োগযোগ্যতা বিষয়ে একটা আন্তর্জাতিক সেমিনারের কিছু অংশে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়েছিল। সেখান থেকে কিছু অংশ খুবই জরুরী মনে হওয়ায় সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এই ছোট্ট প্রয়াস। যদি ইতিমধ্যে জানা না থাকে তাহলে চাকুরীপ্রার্থী এবং চাকুরীদাতা উভয়পক্ষই হয়তো এই তথ্যগুলো জেনে উপকৃত হবেন। যেই গুরুত্বপূর্ণ শব্দগুলো এই ক্ষেত্রে ঘুরে ফিরে এসেছে সেগুলো হল Employed, Employable, Hard Skill এবং Soft Skill। এর মধ্যে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল Soft skill - অথচ এই বিষয়টা সম্পর্কে আগে থেকে আমার কোন স্বচ্ছ ধারণাই ছিল না। এই শব্দগুলো দিয়ে কী বোঝা যায় সেটা দেখা যাক।

Employed বনাম Employable

Employed অর্থ হল বর্তমানে একজনের একটা চাকুরী আছে; কিন্তু এই মূহুর্তে employed বলেই সেই চাকুরী থাকবে কি না, কিংবা একটা ছাড়লে আরেকটা পাবে কি না সেটার গ্যারান্টি নাই।

Employable অর্থ হল এই লোকের মধ্যে এমন কিছু গুনাবলী আছে যে সব প্রতিষ্ঠানই এঁকে চাকুরী দিতে চাইবে। এই গুনাবলীগুলোকে soft skill বা employability skill বলে। ক্যারিয়ারে সফলতার জন্য এই গুনাবলীগুলো অপরিহার্য। কাজেই এই দক্ষতাগুলো থাকলে সেই ব্যক্তি ইচ্ছামত এক চাকুরী ছেড়ে আরেকটি নিতে পারবে। নিয়োগযোগ্যতার দক্ষতাগুলোকে কখনো সফট স্কিল, ফান্ডামেন্টাল স্কিল, ওয়র্ক-রেডিনেস স্কিল কিংবা জব-রেডিনেস স্কিল বলা হয়।

দক্ষতার প্রকারভেদ

কোন একজন ব্যক্তি Employable বা নিয়োগযোগ্য বলতেই তার দুই ধরণের দক্ষতার বিষয়টা সামনে চলে আসে। প্রথমটা হল Hard Skill আর অন্যটা Soft Skills। এর মধ্যে Hard Skill সম্পর্কে আমরা প্রায় সকলেই মোটামুটি ভাল ধারনা রাখি, কিন্তু অতি জরুরী Soft Skillগুলো সম্পর্কে আমরা অনেকেই মোটেই সচেতন নই।

Hard স্কিল সমূহ

যেই পেশার জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়, সেই পেশার নামের মধ্যেই সেই পেশা সংশ্লিষ্ট দক্ষতার বিষয়টা বোঝা যায়। এছাড়া নিয়োগের বিজ্ঞাপনে সাধারণত সেই Hard skill গুলোর ব্যাপারে উল্লেখ করা থাকে। যেমন: ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারীবিদ্যা, একাউন্টিং, টাইপিং-স্পিড, প্রোগ্রামিং দক্ষতা ইত্যাদি। 

চাকুরীপ্রার্থীদেরকে প্রাথমিক ভাবে বাছাই করতে এই hard skillগুলো ব্যবহৃত হয়। এক পেশার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে সেই পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন অন্য পেশায় ডিগ্রীধারী কেউ আবেদন করলে সেই আবেদনপত্র এমনিতেই বাতিল হয়ে যাবে। অথবা একটা চাকুরীর জন্য নির্দিষ্ট টাইপিং স্পিড কিংবা নির্দিষ্ট প্র‌োগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ চেয়েছে - প্রার্থীর সেই দক্ষতাটুকু না থাকলে তার আবেদন করার যোগ্যতাই প্রশ্নবিদ্ধ হবে।  

সাধারণত Hard skillগুলো সার্টিফিকেট দেখেই বোঝা যায়, কারণ যাঁরা এগুলোর সার্টিফিকেট দেয় তাঁরা অনেক দীর্ঘমেয়াদে দেখেশুনে অনেকভাবে পরীক্ষা করেই এগুলো দিয়েছেন বলে আশা করা যায়। এই দক্ষতাগুলোকে যে কোন সাধারণ চাকুরী পেতে এবং টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে। 

প্রাথমিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই দক্ষতাগুলো অর্জনের পর নিজের ক্যারিয়ারকে আরো আগে বাড়াতে চাইলে কিংবা উঁচু পদে কাজ করতে চাইলে ক্রমান্বয়ে আরও কিছু বিষয়ে মনোযোগী হওয়া দরকার। নিচে এই বিষয়গুলো এবং অর্জনের জন্য দরকারী ধাপগুলো উল্লেখ করা হল:

পেশায় উন্নয়ন
-- নতুন কিছু শেখা এবং বিভিন্ন রকমের প্রকল্পে কাজ করা
-- কার্যনির্বাহী কমিটিতে কাজ করা
-- নিজেই উদ্যোগী হয়ে এবং যৎসামান্য তত্বাবধানে কাজ করার সক্ষমতা/ বৈশিষ্ট
-- নিজের ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়ন এবং এর ব্যবসার ধরণ সম্পর্কে ধারণা রাখা
-- নিজ কাজের লক্ষ্য আর চাকুরীদাতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুসারে ঠিক করা
-- সহকর্মীদের ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা বুঝতে পারা

নেতৃত্ব
-- অন্যদের প্রশিক্ষণ এবং উন্নততর পরামর্শ দেয়া
-- প্রয়োজনে ঝুঁকি নিতে রাজি/প্রস্তুত থাকা
-- দর কষাকষিতে সক্ষমতা
-- কর্মীদের কাজে পরিচালনা ও অনুপ্রাণিত করা
-- দক্ষতা প্রদর্শন করা
-- পদ্ধতি সরলীকরণের চেষ্টা করা
-- ব্যবসার প্রয়োজন বিশ্লেষনের মাধ্যমে অর্থ বা সময়ের সাশ্রয় করা।
-- সহকর্মীদের সাথে অংশীদারীত্ব এবং গোষ্ঠী গঠন করা।

সফট স্কিলসমূহ

পেশাগত দক্ষতাগুলো প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হতে সাহায্য করলেও চাকুরীদাতাগণ তাদের কর্মীদের মধ্যে অন্যরকম কিছু প্রবলভাবে প্রত্যাশা করেন - এই অন্যরকম দক্ষতাগুলো নির্দিষ্টি কোনো পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। প্রাথমিক ভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর, বাছাই প্রক্রিয়া শেষে চাকুরী পেতে এই অন্যরকম যোগ্যতাগুলোই তখন মূল চাবিকাঠি হয়ে যায়। তাই সেই অন্যরকম যোগ্যতাগুলোকে Employability Skill বা Soft Skill বলে। এই যোগ্যতাগুলো থাকলে একজন প্রার্থীর কখনোই চাকুরীর বা কাজের অভাব হবে না। এগুলি এমন কিছু দক্ষতা ও অভ্যাস-আচরণের সমন্বয় যা প্রতিটা কর্মক্ষেত্রই জরুরী।

কিন্তু soft skillগুলোর সাধারনত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট নাই। আর এগুলো দেখার জন্যই মূলত: ইন্টারভিউয়ে ডাকা হয়। যদিও আমাদের দেশে বেশিরভাগ জায়গায় চাকুরীর ইন্টারভিউ যাঁরা নেয় - তাঁরা এই ব্যাপারগুলোতে কতটুকু সচেতন এই বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে, কিন্তু বিদেশের নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলো লম্বা সময় নিয়ে (কিছুক্ষেত্রে কয়েকদিন) সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকা সম্ভাব্য চাকুরীপ্রার্থীদের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এই বিষয়গুলোই বুঝে নেয়।

নিয়োগযোগ্যতার এই দক্ষতা থাকলে একজন প্রার্থী যা করতে পারে তা হল:
-- সহকর্মীদের সাথে কার্যকর যোগাযোগ
-- কর্মক্ষেত্রে সমস্যা সমাধান
-- দলের মধ্যে নিজের ভূমিকা বুঝে কাজ করা
-- দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নেয়া
-- নিজের ক্যারিয়ারের চালক হওয়া

অন্যের সাথে আপনার মিথস্ক্রিয়া কেমন হবে তা আপনার ব্যক্তিগত গুণাবলী, অভ্যাস ও দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভরশীল। এই দক্ষতাগুল‌ো চাকুরীদাতার কাছে গুরুত্ব বহন করে কারণ তার কর্মীগণের পারস্পরিক কিংবা সেবাগ্রহীতা/ক্রেতার সাথে সফল/সুন্দর মিথস্ক্রিয়া/ব্যবহার তার ব্যবসা বা কর্মক্ষেত্রে উন্নতির জন্য জরুরী। তাহলে দেখা যাক ঠিক কোন বৈশিষ্টগুলোকে soft skillবলে:

মূল দক্ষতাসমূহ (Foundational Skills)
-- গোছানো (সুবিন্যস্ত, শৃঙ্খলাবদ্ধ)
-- নির্দিষ্ট সময়ে কিংবা আগেই কর্মস্থলে পৌঁছানো
-- নির্ভরযোগ্য
-- কাজের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব থাকা
-- হাল ছেড়ে না দিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা ও লেগে থাকা
-- সময়মত সঠিকভাবে কাজ সম্পন্ন করা
-- দক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টায় আরো তথ্য সংগ্রহ
-- ছাড় দেয়া এবং অভিযোজন করার ক্ষমতা
-- অপ্রীতিকর হলেও সমস্ত দায়িত্ব সম্পুর্ন করা
-- কর্মস্থলে পোশাকের রীতিনীতি এবং নির্দেশাবলী বুঝতে পারা
-- ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা

আন্তব্যক্তিগত দক্ষতা (Inter personal skills)
-- বন্ধুসুলভ এবং বিনয়ী
-- সহকর্মী এবং কর্মকর্তাদেরকে সম্মান করা
-- সেবাগ্রহীতার অনুরোধে সঠিক উপায়ে সাড়া দেয়া
-- (কাজের/সেবার) প্রতিক্রিয়া জেনে নেয়া
-- গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ করার মানসিকতা
-- শান্তিপূর্ণ এবং সততার সাথে বিরোধ নিষ্পত্তি করা

যোগাযোগের দক্ষতা (Communication skill)
-- লিখিত নথি পড়তে ও বুঝতে পারা
-- অপরের কথা শোনা, বোঝা এবং প্রশ্ন করা
-- নির্দেশাবলী মেনে চলার সক্ষমতা
-- লিখিত বা মৌখিক ভাবে ধারণাকে স্বচ্ছভাবে উপস্থাপন করা
-- প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি যথাযথ ব্যবহারে সক্ষমতা

সমস্যা সমাধান এবং বিশ্লেষনের চিন্তাশক্তি (Problem solving and Critical thinking)
-- পরিবর্তন মেনে নেয়া
-- দায়িত্ব পরিবর্তন, আরম্ভ বা বিরত থাকতে রাজি থাকা
-- ব্যস্ত পরিবেশেও শান্তভাবে কাজ করা
-- বলার আগেই নিজ উদ্যোগে কাজ শুরু করে দেয়া
-- সমস্যার সমাধানে এবং আরও ভালভাবে কাজ করার লক্ষ্যে প্রশ্ন করা

দলগত কাজ (Team work)
-- বিভিন্ন প্রকৃতির লোকের সাথে সহজে কাজ করতে পারা
-- অন্যের দরকারের প্রতি সংবেদনশীলতা
-- নিজের অংশের কাজের ভালমন্দের দায়দায়িত্ব নেয়া
-- দলগত লক্ষ্যে অবদান রাখা

আইনগত এবং নীতিগত দায়িত্ব (Ethics and Legal responsibility)
-- নিজের সিদ্ধান্ত এবং কাজের দায়ভার গ্রহণ করা
-- কাজের বিধিমালা এবং কার্যপ্রণালী বোঝা এবং মেনে চলা
-- সৎ এবং বিশ্বাসী
-- পেশাদারীত্ব ও পরিপক্কতার সাথে কাজ করা

উপসংহার

উপরে তালিকা আকারে যেই বৈশিষ্টাবলীর কথা লেখা হল সেটা দেখে কেউ নিজের ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করে সেটার উন্নয়ন করলে আশা করা যায় নিয়োগযোগ্যতার দিকে আরও এগিয়ে যাবে। আমি নিজেও এই তালিকা থেকে উপকৃত হয়েছি - বুঝতে পেরেছি আমার সমস্যাগুলো (আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চোখে) কী? আর সমস্যা বুঝতে পারলে সেটা সমাধান করার পথ বের করা সহজ হয়ে যায়।

খেয়াল করে দেখুন, আমাদের যে মাঝে মাঝে রিকমেন্ডেশন লেটার নিতে/দিতে হয়, সেখানে আসলে এই soft skillগুলোকেই হাইলাইট করা হয় যেন দুরে থাকা সম্ভাব্য সুপারভাইজার কাছ থেকে না দেখেই প্রার্থী সম্পর্কে একটা ভাল আইডিয়া পায়। বিয়ে-শাদী'র সময়ে বা পরেও আমরা পরিচিত সার্কেলে বৈবাহিক সূত্রে নতুন আসা মানুষের এই soft skillগুলো নিয়ে বেশ আলোচনা করি বলে মনে হয়। কাজেই এই দক্ষতাগুলোর প্রয়‌োজনীয়তা শুধু চাকুরীক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়।


ইন্টারনেটে সার্চ করলে এই বিষয়ে প্রচুর লেখা পাওয়া যায়। কোথাও কোথাও আরও সংক্ষেপে সুন্দরভাবে বিষয়গুলো উপস্থাপন করা হয়েছে। তাই কৌতুহলী হয়ে খুঁজলে আরও চমৎকার তথ্যবহুল লেখা পাবেন নিঃসন্দেহে।

তথ্যসূত্র:

১। International Summit on Employability and Soft Skills, 2017.
২। গুগল আংকেল
৩। https://www.careerwise.mnscu.edu/careers/employability-skills.html

শনিবার, ১৮ মার্চ, ২০১৭

এই প্রজন্মের সমস্যাটা কী?

১।
কিছুদিন আগে ঠিক এই ইংরেজি শিরোনামে একটা বক্তব্যের ভিডিও দেখেছিলাম (লিংক শেষে)। অসাধারণ এই বিশ্লেষনটা আমি পরে পরিচিত অনেক জনকেই দেখিয়েছি। এই বক্তব্য যিনি দিয়েছেন তাঁর নাম Simon O. Sinek – একজন ব্রিটিশ-আমেরিকান লেখক এবং মোটিভেশনাল বক্তা (জন্মসাল: ১৯৭৩)। তাঁর লেখা তিনটা বই আছে। আচ্ছা এবার মূল বিষয়ে ফেরত আসি: এইখানে তাঁর বক্তব্যের একটা কাছাকাছি বাংলা দেয়ার চেষ্টা করছি কারণ: মনে হয়েছে যাদের দেখার সুযোগ হয়নি বা ইংরেজিতে সমস্যা তাঁরা এই বিশ্লেষনটা জানুক।

২।
এবার আসি সংক্ষেপে সাইমন ভাইয়ের বিশ্লেষনটিতে:
বর্তমানের যে প্রজন্ম অর্থাৎ ৮৪ সাল বা এর পরে যাদের জন্ম তাঁদের চারটা বৈশিষ্ট আছে যা আগের প্রজন্মগুলো থেকে সম্পুর্ন আলাদা। এঁদের নামে অনেক অভিযোগ – এরা নবাবজাদা মানসিকতার; এদেরকে ম্যানেজ করা কঠিন; এরা আত্নকেন্দ্রীক; লক্ষ্যহীন; অলস ইত্যাদি।

এঁদেরকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়: জীবনে কী হতে চাও? এঁদের জবাব হবে - আমি একটা মহৎ কাজ করতে চাই; সবার জীবনে প্রভাব ফেলতে চাই (বিখ্যাত?), ফাও খেতে চাই ইত্যাদি। কিন্তু তাঁরা যা চায় সেগুলো দেয়া হলে, এমনকি ফ্রী খাইতে দিয়েও তাদেরকে খুশি করা যায় না দেখা যায় কিছু একটা বাকী আছে। এরকম হওয়ার পেছনে চারটি মূল কারণ বের করেছেন তিনি।

প্রথম কারণ হল ভুলভাবে বাচ্চা লালন-পালন। এদের বেশিরভাগের বাবা-মাগণ ছোটকাল থেকে এঁদেরকে বার বার বলেছে যে তাঁরা স্পেশাল; বলেছে যে তোমরা যা হতে চাও তাই হতে পারবে - ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এমন যে শুধুমাত্র চাইলেই হবে; কিন্তু এর জন্য যে শর্তগুলো পূরণ করতে হবে সে ব্যাপারে কিছুই বলে না। এদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে কারণ এমন নয় যে এরা এর যোগ্য (মানে রেজাল্ট এ্যাত ভাল যে উচ্চতর ডিগ্রী করানো যায়), কারণ হল এটা এঁদের বাবা-মা’ চায় তাই। কেউ কেউ ক্লাসে এ গ্রেড পেয়ে এসেছে - যোগ্যতার কারণে নয়, বরং এই কারণে যে শিক্ষক এঁদের অতি নাক-গলানো স্বভাবের বাবা-মা’কে এড়াতে চায়। কেউ কেউ এমনকি ক্লাসে দেরিতে আসার জন্যও পুরষ্কার পায় – কাজেই যা হয় তা হল যারা সত্যিই পরিশ্রম করে তারা নিজেদেরকে বঞ্চিত মনে করে - পরিশ্রম করার আগ্রহ কমে যায়। আর যে শেষে আসার জন্য পুরষ্কার পায় সে একটু বিব্রত বোধ করে - কারণ সে জানে সে পুরষ্কারের যোগ্য না; তাই হীনমন্যতায় ভোগে। কিন্তু এই গ্রুপের পোলাপানগুলো যখন বাস্তব জীবনে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে এঁরা দেখে - তাঁরা ম‌োটেও স্পেশাল নয়; মামা-চাচার লবিং ছাড়া প্রমোশন পাচ্ছে না; দেরিতে বা শেষে আসার জন্য কোন পুরষ্কার নাই; আর শুধুমাত্র চাচ্ছে বলেই কোন কিছু পাওয়া যায় না – ফলে মুহুর্তেই তার নিজেকে নিয়ে গড়া স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়। ফলে একটা পুরা প্রজন্ম, তাদের পূর্বসূরীদের চেয়ে অনেক বেশি হীনমন্যতা নিয়ে বড় হচ্ছে।

৩।
দ্বিতীয় কারণ হল বাধাহীনভাবে সামাজিক মাধ্যম যথা ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া। লোক-দেখানি ভাব নিতে এগুলোর জুড়ি নাই। অসাধারণ জীবন যাপনের একটা ভূয়া ভাব নেয়া যায় সেখানে, যদিও যে চরম ভাব নিচ্ছে আদতে হয়তো তাঁর মন খারাপ। ফলে এখানে ঘুরলে মনে হয় সবাই কী দারুন জীবন যাপন করছে, আর তাদের কথাবার্তা দেখলে মনে হয় জীবনে তাঁরা সব সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে যা বাস্তবের পুরা বিপরীত। আরেকজনের কাজ কারবার দেখলে মনে হয় আমারও এমনই করতে হবে - কিন্তু আদতে সেরকম হওয়া বা করা সম্ভব না। ফলে হীনমন্যতায় ভোগা একটা প্রজন্ম আরো বেশি হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে - যদিও এতে তাঁদের কোন দোষ ছিল না।

একজনের হয়ত কিচ্ছু করার নাই, বা ভাল লাগছে না - তাই মেসেঞ্জারে গ্রুপকে লিখলো “হাই ...”। একটু পরেই আবার মেসেজ চেক করে দেখে দশটা রেসপন্স এসেছে …. “হাই”, “হাই”, “হাই”, “হাই” … … … … … । এতে আসলে কী হল!? মনে হল কিছুই না, কিন্তু আসলে এটাতে প্রথম ব্যক্তির বেশ ভাল লাগলো। এই যে ভাল লাগা, এই অনুভুতিটার পেছনে একটা হরমোন কাজ করে - যেটার নাম হল ডোপামিন। এজন্যই আমরা বার বার চেক করি, কয়টা লাইক পড়লো, কয়টা রেসপন্স আসলো ইত্যাদি। অর্থাৎ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের ডোপামিন নিঃসরণ ঘটাতে সাহায্য করে। তবে জেনে রাখা ভাল, এই সামাজিক যোগাযোগের ডিজিটাল মাধ্যম ছাড়া আরো অনেক যে যে জিনিষগুলো আমাদের ড‌‌োপামিন নিঃসরণ ঘটায় সেগুলোর মধ্যে আছে – সিগারেট, মদ, জুয়া এবং অন্যান্য মাদক দ্রব্য। অর্থাৎ মাদকতার আনন্দ যে ডোপামিনে, যা আসক্তি সৃষ্টি করে - ঠিক সেই একই রকম আসক্তি এই সামাজিক মাধ্যম সৃষ্টি করে। ছোটরা যেন অবুঝের মত আক্রান্ত না হয়ে পড়ে সেজন্য বিদেশে মদ, সিগারেট কিনতে এবং জুয়া খেলতে বয়সের বিধিনিষেধ আছে - দোকানে নির্দিষ্ট বয়েসের কমবয়সী কেউ সেগুলো কিনতেই পারে না; অথচ একই রকম আসক্তিদায়ক সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে বাচ্চাদের কোনো বাধা নাই। এর মানে হল অনেকটা এরকম: একজন কিশ‌োরকে বা বালককে নিজের সিগারেট প্যাকেটে/মদের ভাণ্ডারে বাধাহীন অধিকার দেয়া।

৪।
কাজেই এই প্রজন্ম বিশেষত কৈশ‌োরের মানসিক পরিবর্তনের সময়ে যখন বিভিন্ন সামাজিক ও মানসিক চাপ সামলাতে খাবি খায় তখন তাঁদের সামনে এরকম একটা নেশাদ্রব্য দিয়ে দেয়া হচ্ছে সেই চাপ ভুলে থাকার জন্য। সেই আবেগ মানসিক চাপ ইত্যাদি সামলাতে যখন বাবা-মা কিংবা বন্ধুদের সাহায্য দরকার ছিল, তখন তাঁরা নেশার সাহায্য নেয় – নেশা মানে এই সামাজিক মাধ্যম – ফেসবুক ইত্যাদি। আর এই ব্যাপারটা যখন তাঁদের মাথায় গেঁথে যায়, তখন জীবনের যে কোন পর্যায়ে সামাজিক, অর্থনৈতীক কিংবা পেশাগত চাপ সামলাতে তাঁরা কোন বন্ধু বা গুরুজনের কাছে সাহায্য চাওয়ার বদলে নেশার বোতল তথা ফেসবুক টাইপের জিনিষপাতি খুলে বসে। আর এ-তো জানা কথাই, নেশা কখনই দীর্ঘমেয়াদে ভাল কিছু করতে পারে না; এটা জীবন ধ্বংসকারী একটা বস্তু।

আর এই আসক্তির কারণে দেখা যায়, এই প্রজন্মের বড় একটা অংশ সত্যিকারের বন্ধুত্ব, গভীর সম্পর্কের অর্থই বোঝে না। তাদের বন্ধুত্বগুলো ভাসা ভাসা; যে বন্ধুর উপর নির্ভর করা যায় না – আর এমনও হতে পারে যে মজা শেষে তাকে খুব সহজেই আনফ্রেন্ড করে দিতে পারে। বাস্তব জীবনে ঝগড়া, মারামারি, মান অভিমানে যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার কথা সেরকম গভীর বন্ধুত্ব হওয়ার মত সুযোগই তাদের হয়না। বন্ধু তৈরীর যে পথ, যে কৌশল: সেটা শেখারই কোন সুয‌োগ তারা পায় না। আর ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন চাপ সামলাতে নেশাতে ডুবে যাওয়া ছাড়া তাদের উপায়ও থাকে না।

নেশার যে দ্রব্যগুলো - সেগুলো কিন্তু অতিরিক্ত ব্যবহারেই নেশা হয়। বুঝে শুনে সীমিত পরিসরে নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে সেগুলো কিন্তু আনন্দের উৎস হতে পারে। কিন্তু এই সময়ে যেটা হচ্ছে ২৪ ঘন্টাই সেলফোনের প্রভাবে নেশাগ্রস্থ থাকছে একটা প্রজন্ম। আরেকজনের দিকে মাথা তুলে তাকানোর পর্যন্ত সময় নাই। খুব জরুরী দুই একটা কথার বাইরে যে কেমন আছেন, মুরগী ডিম পারছে কি না, কিংবা বাসায় মশার উপদ্রব – বন্ধুত্ব বা পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক তৈরীর শুরুতে জরুরী এই জাতীয় নির্দোষ আলাপচারিতা করার মত সময় বা দক্ষতা তাদের থাকেনা। বন্ধুদের সাথে খেতে বসে যদি সেদিকে মনযোগ না দিয়ে আরেকজনের সাথে ফোনে চ্যাট করতে থাকে কেউ – তাহলে সেটা অবশ্যই একটা নেশা, একটা সিরিয়াস সমস্যা। একটা অফিসিয়াল মিটিংএ যদি মনোযোগটা ফোনের মেসেজে বেশি থাকতে হয়, তাহলে সেটা সমস্যা। ঘুম থেকে উঠে পাশে শুয়ে থাকা প্রিয়জনের খবর নেয়ার আগে যদি ফোনের মেসেজ চেক করে কেউ – তাহলে সেটা নেশা – অবশ্যই একটা সমস্যা।

কাজেই দেখা যাচ্ছে, আমাদের একটা প্রজন্ম গড়ে উঠছে যাদের আত্মসম্মানবোধ গড়ে উঠতে দেয়া হয়নি; আরও দেখা যাচ্ছে চাপ সামলানোর টেকনিকগুলো শেখার সুযোগ আমরা তাদেরকে দেই নাই – নেশাগ্রস্থ হওয়াটা কোন টেকনিক হতে পারে না।

৫।
এবার আসা যাক তৃতীয় কারণে (যেটার সমস্যাটা হল অসহিষ্ণুতা) – তাৎক্ষনিকভাবে চাহিদা মিটে যাওয়ার অভ্যাস। বর্তমান ডিজিটাল যুগে কেউ কিছু কিনতে চাইলে আয়োজন করে টাকা পয়সা জোগাড় যন্ত্র, হাটের দিন কবে ইত্যাদি খোঁজ নিয়ে সময় করে বাজার/হাটে যেতে হয় না; অনলাইনে তখনি কিনে ফেলতে পারে, টাকা না থাকলে অসুবিধা নাই – কারণ এজন্য ক্রেডিট কার্ড আছে, পেমেন্ট অন ডেলিভারি আছে, ইনস্টলমেন্টের সুবিধা আছে; আর একদিনের মধ্যেই সাধারণত জিনিষটা বাসায় চলে আসে। কেউ সিনেমা দেখতে চাইলে ইউটিউব বা অন্য মিডিয়াতে সাথে সাথে দেখতে পারে, কিংবা পে-চ্যানেলে গিয়েও দেখতে পারে। সিনেমাটা কাছের সিনেমাহলে আছে কি নাই, শো-এর টাইমটেবল, টিকেট আছে কি না – এসব নিয়ে কোন ঝামেলাই নাই। একটা টিভি সিরিজ দেখার ইচ্ছা হলে সাথে সাথেই ইন্টারনেটে সেটা দেখে ফেলা যায়। পরের পর্বের জন্য সপ্তাহের পর সপ্তাহ বা মাসের পর মাস অপেক্ষার ফলে সহিষ্ণুতার যে শিক্ষা সেটার কোন বিষয়ই আর নাই এখন। কেউ কেউ তো আবার এতই অধৈর্য যে, মাঝের পর্ব বাদ দিয়ে একেবারে সিজনের শেষ পর্ব দেখে ফেলে।

এমনকি, কাউকে প্রপোজ করাটাও এখন এঁরা শিখতে পারে না। কিভাবে হাত ঘষে ঢোক গিলে বোকা বোকা কথা শুরু করবে ডিজিটাল যুগে এধরণের সামাজিকতা শেখারও প্রয়‌োজন নাই। ডেটিং সাইটে গিয়ে শুধু ক্লিক করলেই সব ঠিক। এই যুগে যাই চাওয়া হয়, সাথে সাথে পাওয়া যায়, শুধুমাত্র যা পাওয়া যায়না সেটা হল – পেশাদারিত্ব আর গভীর সম্পর্ক। কারণ, এগুলোর জন্য কোন অ্যাপ নাই। এগুলোর অর্জন হয় ধীরগতির, আঁকাবাঁকা, বন্ধুর পথে – যা পেরোতে দরকার ধৈর্য আর একাগ্রতা। কিন্তু এই প্রজন্মের এই অর্জনগুলোর জন্য যে প্রশিক্ষণের দরকার ছিল তা হয়নি। কর্মস্থলে গিয়ে এরা হতাশ হয়, গভীর সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হয় / পিছিয়ে যায়: কারণ ধৈর্য ধরে সফলতার জন্য অপেক্ষা আর লেগে থাকা, তিল তিল করে সফলতার ভিত্তি গড়ে তোলা বা কোন বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য দীর্ঘমেয়াদী চর্চা - এ ধরণের কোন প্রশিক্ষণই বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় এরা পায় না। ব্যাপারটা অনেকটা পর্বতের গোড়ায় দাঁড়িয়ে থেকে চূড়াতে যাওয়ার কামনার মত – এঁরা শুধু চূড়া দেখে আর সরাসরি সিরিয়ালের শেষ পর্ব দেখার মত স্টাইলে সেখানে যেতে চায়। কিন্তু বাস্তব তো এমন নয়: এর জন্য পাহাড় ডিঙানোর পরিশ্রম, ধৈর্য, পরিকল্পনা, দক্ষতা এইসব দরকারী বিষয়গুলোর কোন ধারণাই এদের মধ্যে থাকে না। ফলাফল আরো বেশি হতাশা, হীনমন্যতা।

এইসব কারণে হতে পারে যে সমাজে আত্মহত্যা, মাদকাসক্তির হার বেড়ে যাবে। ডিপ্রেশনের কারণে পড়ালেখা ছেড়ে দেয়ার হার বেড়ে যাবে। মন্দের ভাল হিসেবে সবচেয়ে ভাল যেটা হতে পারে, তা হল: পুরা সমাজের একটা বড় অংশ রোবটের মত একঘেয়ে একটা জীবন পার করবে কিন্তু কখনই জীবনের আনন্দঘন দিকগুলো সেভাবে উপভোগ করতে পারবে না। কখনই তাদের মধ্যে জীবনবোধের গভীরতা কিংবা পরিপূর্ণতার অনুভূতি আসবে না।

৬।
শেষ বা চতূর্থ পয়েন্টটা হল পরিবেশ। কর্পোরেট কালচারেও সবকিছু স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্য নিয়ে করা হয়। এঁরা যে নতুন কর্মী যোগ দিয়েছে তার কোন উন্নয়ন হল কি না সেটা মোটেও ভাবে না বরং নিজেদের স্বল্পমেয়াদী অর্জনের লক্ষ্য ঠিক আছে কি না সেটা নিয়েই চিন্তিত। এটা এমনই একটা পরিবেশ যেটা তাঁদের আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে মোটেই সাহায্য করছে না। এই কর্পোরেট পরিবেশ তাদেরকে পারস্পরিক আস্থা, বন্ধুত্ব স্থাপনের যে কৌশল তা শিখতে সাহায্য করছে না। অসহিষ্ণুতা থেকে বেরিয়ে আসতে যে প্রশিক্ষণ বা ট্রেনিং দরকার – ধৈর্যধারণ এবং দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যস্থির করে সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়ার – সেটার কোন ক্ষেত্র সৃষ্টি করছে না এই কর্পোরেট সংস্কৃতি। যে ধরণের অর্জনগুলো করতে বছরের পর বছর ধৈর্য ধরে এক লক্ষ্যে কাজ করতে হয় এবং সেটা অর্জনের পর যে আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়, সেটা অনুভব করার কোন সুযোগই তাদেরকে এখানে দেয়া হয় না। এসব কারণে দিনকে দিন তারা আরও হতাশ হয়ে যায়, মনে করতে থাকে তাঁদের কোন যোগ্যতাই নাই।
বাব-মা’র ভুল, সমাজ-ব্যবস্থার ভুলের ফলে এই প্রজন্ম ক্রমেই আত্মকেন্দ্রীক, অসহিষ্ণু এবং অসামাজিক হয়ে যাচ্ছে – অথচ তার দায় কেউ নিতে রাজি হয় না। … … … …

৭।
সাইমন ভাইয়ের বিশ্লেষনের পরিপ্রেক্ষিতের সাথে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত হয়তো পুরাপুরি মিলবে না। কিন্তু কিছুটা শিক্ষনীয় চিন্তা-জাগানিয়া বিশ্লেষনী দৃষ্টিভঙ্গি যে সেখানে আছে - সেটাও অস্বীকার করা যাবে না। এই যে আমাদের পোলাপানগুলোকে না চাইতেই গণহারে উচ্চতম জিপিএ দিয়ে পাশ করিয়ে দেয়া হচ্ছে সেটার দীর্ঘমেয়াদে প্রায় একই রকম খারাপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করার কথা। কারণ এতে যাঁরা সত্যিকারের পড়াশোনা করতো তাঁরা নিরুৎসাহিত হচ্ছে। তেল আর ঘি’য়ের যখন একই মূল্যায়ন হবে তখন কেন কষ্ট করে ঘি উৎপাদন করবে কেউ? আর এই না চাইতেই পাওয়ার ফলে তাঁদের অবচেতন মনে এমন ধারণা পাকাপোক্ত হয়ে গেছে যে এই ডিগ্রীগুলো ছেলের হাতের মোয়া, সহজলভ্য বস্তু - যা না চাইতেই পাওয়া যায়। এর জন্য পরিশ্রম, অধ্যবসায় এসবের কোন প্রয়োজন নাই। শুধু আসবো যাবো, ফূর্তি করবো, ফেসবুকিং করবো, চকচকে ক্যাম্পাসে ফ্যাশন করে ছবি তুলবো – কয়দিন পর প্রসেসের কারণে ডিগ্রী এমনিই পাওয়া যাবে।

জানি, উচ্চশিক্ষার কিছু জায়গায় এই চর্চাটাই চলছে। কিন্তু অবচেতন মনে হীনমন্যতা ঢুকে আত্মসম্মানবোধহীন যে প্রজন্ম আমরা তৈরী করছি তাতে করে সমস্যা বাড়তেই থাকবে। কর্মক্ষেত্রে এঁদের বড় অংশ শুধু খাবি খাবে। কোত্থাও টিকতে পারবে কি না জানিনা, তবে হতাশা বাড়তেই থাকবে।

==
ইউটিউবে সাইমন ভাইয়ের ভিডিও লিংক