শুক্রবার, ৬ মার্চ, ২০০৯

বাচ্চা ভয়ংকর ডাক্তার ভয়ংকর!

(বাঁচতে হলে জানতে হবে টাইপ কথাবার্তা আছে ভেতরে ... বেশি ছোটরা না পড়াই ভাল)

আমার বিবাহিত জীবন প্রায় ছয় বছর ছুঁই ছুঁই করছে। বাচ্চা কাচ্চা নেয়ার কোন রকম অবকাশ পাই নাই এর মধ্যে। যখন বিয়ে করি তখন বউয়ের বুয়েট লাইফের ৩য় বর্ষ ... ২১তম বিসিএস-এর কল্যানে আমি কেবল গণপূর্ততে যোগদান করেছি আর ওদিকে পি.এইচ.ডি করার জন্য জাপান সরকারের বৃত্তি হবে হবে করছে। মাত্র চার মাস চাকুরী করেই একা জাপান চলে গেলাম। জাপান থাকাকালীন সময়েও গবেষণার নমুনা সংগ্রহের জন্য গড়ে প্রতি ৩ মাসে একবার করে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে আমার প্রফেসর .... কাজেই দৌড়ের উপরেই ছিলাম। বাংলাদেশে ঘন ঘন আসার ফলে হোম সিকনেস কেটে যেত - এই সুবিধা থাকলেও ঘন ঘন আসার ফলে জাপানে জীবন ধারণ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে জটিলতা দেখা দিত -- একবার তো লম্বা ভ্রমনের কারণে ঠিক সময়মত স্বাক্ষর করতে পারিনি বলে এক মাসের বৃত্তিই পাইনি।

যা হোক, জাপানে আমার বয়স দেড় বছরের মাথায় আমার স্ত্রী তাঁর বুয়েটের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েই চলে এল ... এর আগেও দুই সেমিস্টারের মাঝের বন্ধগুলোতে ৪৫ দিন করে দুইবার বেড়িয়ে গিয়েছিলো। বাকী আড়াই বছরেও বাচ্চা কাচ্চা নেয়ার চিন্তা করি নাই, কারণ আমার পি.এইচ.ডি.'র ঐ ক্রিটিকাল সময়ে এ সংক্রান্ত বিষয়ে সাপোর্ট দিতে তো পারতামই না বরং আমারই অতিরিক্ত সাপোর্ট দরকার ছিল।

দেশে ফেরার পর স্ত্রী আড়াই বছর পড়ালেখাবিহীন কাটানোর পর এখানে বুয়েটেই মাস্টার্স করতে ভর্তি হল। সমস্ত থিওরী কোর্স শেষ .... থিসিসও শেষ হওয়ার পথে। জন্ম নিয়ন্ত্রন বড়ি খেলে বা অন্য কোন ব্যবস্থা নিলে সেটার রাসায়নিক প্রভাব স্ত্রীর দেহে পড়ে তাই, উভয়ের সম্মতিতেই আমার বউ কোনরকম জন্ম নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি নেয়নি .... ইন্টারনেটের কল্যানে স্বাভাবিক নিয়ম আর আমার দিক থেকে প্রোটেকশন নেয়া হয়েছে। এদিকে পরিচিত আত্মীয় স্বজন সবাই কথা বার্তায় ডাক্তার দেখানো, বিভিন্ন জটিলতার কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। আড়ালে হয়তো, আমাদের দুইজনের মধ্যে কে সন্তান নিতে অক্ষম সেই বিষয়েও ফিসফাস আলোচনা চলে!

বউয়ের মাস্টার্স শেষের পথে, চাকুরী করে না .... তাই অনেকটা সামাজিক চাপে বাধ্য হয়েই বাচ্চা নেব বলে ঠিক করলাম কিছুদিন আগে। পরের মাসেই বউএর স্বাভাবিক জীবন ব্যহত হল। স্টিক টেস্টে গর্ভাবস্থা নিশ্চিত হওয়ার পরপরই বমি ইত্যাদি হয়ে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লো। কাজেই নিজের বাসা ছেড়ে মাসাধিককাল যাবৎ শ্বশুর মহাশয়ের অন্ন ধ্বংস করে চলেছি চোখ টিপি । অবস্থা এ্যাত বেশি খারাপ হল যে, পানি খেলেও এক মিনিটের মধ্যে বমি হয়ে বেরিয়ে আসছিলো। শরীরে পানির অভাবে প্রশ্রাব লালচে হয়ে গেল। ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেলাম। এদিকে নিজ বাসার বাইরে থাকার কারণে আমার ঘুম এবং টয়লেট ব্যহত হচ্ছে .... অনুভুতিটা সুখকর নয় .... কিন্তু বাচ্চার জন্য তো সারা জীবনেই কত কিছু ত্যাগ করতে হবে - এই চিন্তায় ওসব পাত্তা দেই না, শ্বশুর বাড়িতে আছি - এই আনন্দে মনটাকে ভরানোর চেষ্টা করি।

সারারাত আর দিন আমি বউয়ের দেখাশোনা করি, সন্ধ্যায় অফিসে যাই (বিকাল ৬টা থেকে ১০টা আমার ক্লাস নিতে হয়) ... ঐ সময় শুধু শাশুড়ি দেখাশোনা করেন। চোখের সামনে বউয়ের অমানুষিক কষ্ট দেখতেও খারাপ লাগে।

খালা শাশুড়ি ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তার, নিজের ক্লিনিকও আছে .... উনি পরামর্শ দিলেন যে গ্রীনরোডের সেন্ট্রাল হাসপাতালে প্রফেসর (ঢাকা মেডিকেল কলেজ) ফারহানা দেওয়ানকে দেখাতে। দেখালাম ... রক্ত পরীক্ষা এবং আলট্রাসনোগ্রাম করালেন। তারপর অতিরিক্ত বমির জন্য একটা ট্যাবলেট আর স্বাভাবিক ফলিক এসিডের জন্য আরেকটা ট্যাবলেটের ব্যবস্থাপত্র দিলেন। ১৪ মি.মি. বাচ্চার ছবি দেখে আমরা খুশি হই ... রিপোর্ট বলে ৬-৮ সপ্তাহের গর্ভাবস্থা, বাচ্চার হার্টবিট নাই; আমাদের হিসেবে যখন টেস্ট করা হয়েছে তখন বাচ্চার ভ্রুণের বয়স সর্বোচ্চ ৪ সপ্তাহ (স্বাভাবিক জন্ম নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলাম বলে ফার্টাইল পিরিওড সম্পর্কে ঠিক ঠাকভাবেই জানি)। ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী সব করলেও অবস্থা একটু ভাল হয়ে আবার খারাপ হতে থাকলো। বউ বারবার বলছে যে তাঁরটা স্পেশাল কেস যেখানে অবস্থা বেশি খারাপ থাকে এবং স্যালাইন নিতে হয়। আমরা (আমি, শাশুড়ি, শ্বশুর ইত্যাদি) এসবে পাত্তা দেই না ... কারণ এ্যাত বড় একজন প্রফেসরকে দেখিয়ে এনেছি ... পরবর্তীতে আরো দুইবার রিপোর্ট করেছি -- এরপরে কথা থাকা উচিত না ... যে ভোগে সে তো সহানুভুতি পাওয়ার জন্য অনেক কথাই বলে।

একমাসে অবস্থা আরো খারাপ হল ... প্রফেসর বললেন যে আরেকবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করাতে, বাচ্চার হার্টবিট এসেছে কি না সেটা নিশ্চিত হতে হবে -- এটাই বড় চিন্তার বিষয়। ওর খালা মেডিসিন থেকে পাশ করলেও স্পেশালাইজেশন হল মানসিক/মাদকাসক্ত চিকিৎসায় -- তাই নিজে আগ বাড়িয়ে মন্তব্য করেন না; কিন্তু ভাগ্নির অবস্থা এবং রিপোর্ট দেখে একটু ভ্রু কুঞ্চিত করলেন। তারপর বললেন যে তুমি একটু গ্লুকোজ খাও ... আর তোমাকে আমার ক্লিনিকের পাশেই আরেকটা ক্লিনিকে গাইনোকোলজিস্ট আছেন তাঁর সাথে পরামর্শ করি, তোমাকে একটু সেখানেও দেখাই। ইস্কাটনের সেই ক্লিনিকে দেখাতে নিয়ে গেল আমার শ্বশুর-শাশুড়ি এবং খালা শাশুড়ি .... উনি (ডাক্তার) দেখেই হলি ফ্যামিলিতে ভর্তি করাতে বললেন। কারণ উনি মূলত হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজ/হাসপাতালের ডাক্তার এবং ঐ ক্লিনিকটা রাস্তার উপরে হওয়াতে শব্দ বেশি।

ক্লাস নেয়া শেষ করে আমি সোজা হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে এসে দেখি হাতে স্যালাইন লাগিয়ে ওকে শুইয়ে রেখেছে, কয়েকটা ইঞ্জেকশনও দিয়েছে স্যালাইনের ঐ পথে (ক্যানোলা)। অবাক হয়ে দেখলাম, ওর সেই অস্বস্তিগুলো নেই। গত কয়েকদিনে রক্ত, প্রস্রাব ইত্যাদি পরীক্ষা নিরীক্ষায় জানা গেল যে, ওর শরীরে গ্লুকোজ, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি মারাত্নক রকম কমে গেছে। বাচ্চা ঠিক আছে ... সাইজে আরেকটু বড় হয়েছে (১৭ মি.মি.) আর হার্টবিট এসেছে।

এখানে যেই জিনিষটি অবাক লাগলো যে, প্রথমবার টেস্টেই কিন্তু ওর রক্তে গ্লুকোজ কম ধরা পড়েছিল। ওটার বিরূদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় আস্তে আস্তে অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। আমার বউয়ের ঐ কথাটাই ঠিক ছিল .... আসলেই ওর স্পেশাল কেস ... এই অবস্থাটার নাম হাইপারেমেসিস(সম্ভবত এরকমই কিছু খটমটে নাম) আর কারণ সম্ভবত:হাইপোগ্লাইসিমিয়া, পরিসংখ্যানগত ভাবে যেটা হাজারে ৫ জন গর্ভবতীর হয়ে থাকে। এই ব্যাপারটা কেন এ্যাত বড় প্রফেসরের চোখ এড়িয়ে গেল সেটাই খালাশাশুড়িকে চিন্তিত করে তুলেছে। মামা শ্বশুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক - মামী শাশুড়ির সূত্রে ওনার ঐ অধ্যাপকের বাসায় পরিচিতি আছে, উনি বললেন সম্ভবত প্রফেসরের বাসায় কিছু ঝামেলা চলছে, তাই একটু অমনোযোগী। আমি খারাপ মানুষ তাই খারাপ চিন্তাটাই আগে মাথায় আসে .... প্রফেসর সাহেব হয়তো চেয়েছিল যে আমার বউয়ের অবস্থা খারাপ হউক... তারপর নিজেরাই সুড়সুড় করে গিয়ে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি হব। কে জানে আসলে কী জন্য এমন করলো‍! এদিকে হলি ফ্যামিলিতে বেশ ভাল যত্ন নিচ্ছে .... এটা কী খালা শাশুড়ির পরিচয়ের সুবাদে, নাকি কেবিনে থাকি বলে ... নাকি হাসপাতালের গুনে সেটা বুঝতে পারি না।

সেন্ট্রাল হাসপাতালে খালা শাশুড়ির পরিচয়ের সূত্র ব্যবহার করি নাই। আর এখানকার সম্পর্কে ধারণাটা এমনিতেই ভাল না -- ব্যস্ত সড়কের উপরে অবস্থিত বলে আর সন্ধ্যায় কনসালটেন্সি রোগী/মেডিকেল প্রমোশন অফিসারদের ভীড়ে এটার যতদুর দেখেছি সেটা বাজারের মত সরগরম মনে হয়েছে। এছাড়া শাশুড়ির কলিগের আত্মীয়ের কাহিনীটাও সুখকর নয়। ঐ কলিগ (যার ছেলে বুয়েটে আমার রুমমেট/ক্লাসমেট ছিল ... ওর সূত্রেই শ্বশুরপক্ষের সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিল) এর আত্মীয়ের ছেলের একটা ফোঁড়া হয়েছিল। হাউ কাউ করে ছেলেকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো। ওখানে ফোঁড়া গালিয়ে দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে .. তারপর ঐ হাতটাকে গলার সাথে ঝুলিয়ে দিয়েছে (হাঁড় ভাঙ্গা রোগীদের যেমন দেয়) ---- এই পর্যন্ত কাহিনীতে কোন সমস্যা ছিল না .... কিন্তু এই কাজের জন্য ১২০০০ টাকা বিলটাই সব কেমন জানি করে দিল (হ্যাঁ ভাই, I repeat: বার হাজার টাকা!!)।

বর্তমানে গত রাত বাদ দিলে (আজ শুক্রবার বলে রাতে শাশুড়ি ছিলেন) চার রাত ধরে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালটাই আমার বাড়ি ঘর। এখানেই থাকি, খাই, ঘুমাই, গোছল করি ... এখান থেকেই সন্ধ্যায় অফিসে যাই (তখন শ্বশুর/শাশুড়ি পাহারা দেয়), অফিস শেষে এখানেই ফেরৎ আসি। বউ-এর রক্তের সমস্ত প্যারামিটারগুলো স্বাভাবিক হয়ে এসেছে .... তারপরেও কিছুটা অসুস্থ আছে। আগামী আরো দুই/এক মাস এমন যাবে, তারপর স্বাভাবিকভাবেই শরীরের হরমোন লেভেল এডজাস্ট হয়ে ঠিক হয়ে যাবে। এখন শরীরের অভাবগুলো স্যালাইন দিয়ে মিটিয়ে দিচ্ছে .... এ অবস্থায় বাসায় গেলে সমস্ত যত্নের মধ্যেও আবার এরকম হবে ... ১০/১২ দিন পর আবার এসে স্যালাইন নিতে হবে --- পরিচিতের মধ্যে দেশে/বিদেশে যারা এইরকম লক্ষণের মধ্য দিয়ে গেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা তাই বলে। ব্যাপারটা অনেকটা ব্যাটারি চার্জ করার মত। একবার রক্তে পুষ্টির চার্জ দিলে এতে ১০/১২ দিন যায়।

বাবা হওয়ার পথটা মোটেও সুখকর নয় .... না জানি সামনে আরো কী কী সইতে হবে। মন খারাপ

(এই লেখাটা গতকাল কেনা HP mini 1001TU নেটবুক কম্পিউটার ব্যবহার করে হাসপাতালে বসে লেখা। ৬ই-মার্চ-২০০৯, শুক্রবার দুপুর আড়াইটা)

সচলায়তনে প্রকাশিত

কোন মন্তব্য নেই: