শুক্রবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৯

ভুটান ভ্রমণ - ০১

১। ভূমিকা

মানুষজন বেশি পড়তে পছন্দ করে না। তাই যতদুর সম্ভব সংক্ষেপে লিখবো। যাত্রার আয়োজন, খরচাপাতি, পাঁচদিনের সংক্ষিপ্ত ভ্রমণতালিকা, দিন অনুযায়ী ধারাবাহিক ছবি এবং কিছু ভিডিও ক্লিপ থাকবে।
পাঠকের সুবিধার্থে অনুচ্ছেদের নম্বর দিয়ে দেয়া হল।

২। যাত্রার আয়োজন:

এই ভ্রমণের প্রযোজক ও পরিচালক আমার স্ত্রী। কাজেই তথ্যে কিছুটা এদিক সেদিক হয়ে যেতে পারে 😏 - আগেই জানিয়ে রাখলাম; পরে যেন আবার না বলেন .... ...।
ভুটানে যেতে অন অ্যারাইভাল ভিসা; অর্থাৎ আগে থেকে ভিসা নেয়া লাগে না। বিমানে গেলে শুধু পাসপোর্ট থাকলেই চলবে, তবে কখনো হোটেলের ঠিকানা চাইতে পারে।
সপ্তাহে ৩টা ফ্লাইট আছে Drukair এর। আমরা যাওয়ার সময়ে জেট ইঞ্জিনওয়ালা এয়ারবাস ৩১৯ মডেলের বিমানে গিয়েছিলাম (১৬০ সিট ক্যাপাসিটির বিমান), কিন্তু আসার সময়ে পাখাওয়ালা ATR 42-500 (৪৮ সিট ক্যাপাসিটির বিমান)।
ওখানকার নিয়ম হল কোন একজন ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যমে সবকিছু আগে থেকেই বুক করে যেতে হবে। বাংলাদেশের ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যমেই এই ভ্রমন প্যাকেজ নেয়া যায়। এটার মধ্যে থাকা, তিনবেলা খাওয়া, এবং প্রতিদিন গাড়ি, এয়ারপোর্ট পিক-ড্রপ সহ থাকে। এছাড়া ভুটানের সরকারের জন্য ট্যাক্সও থাকে।
ব্যাপক গবেষণা করতে চাইলে এখানে ক্লিক করা যেতে পারে।পিডিএফ গাইড চাইলে এখানে।
একটা বিশেষ ব্যাপার না বললেই নয়। প্রথম টিকেটিং এজেন্টের ট্যূর অপারেটর (ভেন্ডর) ৩ দিনের প্যাকেজ দিয়েছিল। আর যেসব জায়গার তালিকা দিয়েছে তার অনেকগুলোতেই বিশাল প্রবেশ ফী ছিল। এছাড়া আমাদের ফ্লাইট নামবে বিকাল ৫টায় তারপর নিশ্চয়ই বের হতে কিছুটা সময় লাগবে; কিন্তু উনারা সেদিন আবার বিকালে (আফটারনুন) সাইট সি-ইং দিয়ে রেখেছিল ...। এসব দেখে আমাদের আক্কেল গুড়ুম, তাই বউ পাঁচদিনের ভ্রমনসূঁচী দিয়েছে, কোনদিন কোথায় যাবে বলে দিয়েছে, ৩ জায়গার বদলে দুই জায়গায় হোটেল নিয়েছে (কারণ বারবার প্যাকিং আর টানাটানি সহ্য হয় না + কারণ দূরত্ব ২ ঘন্টার ড্রাইভ মাত্র)। আবার প্রথম ভেন্ডর পুনাখা'য় যাওয়ার কথা বেমালুম চেপে গেছে - ওটা দেয়ার কথা বলাতে কোথায় যাবে, দেখার কী আছে কিছুই বলতে পারে না - বলে 'ওখানে গিয়ে কী করবেন, কিছুই তো নাই'। পরবর্তীতে ট্রাভেল এজেন্ট নিজেই নিজের কোম্পানি বাদ দিয়ে drukair থেকে সরাসরি টিকেট আর প্যাকেজ আয়োজন করে দিয়েছিল। সুতরাং ওদের কাছে যাওয়ার আগেই নিজেরা একটু ট্রাভেল ব্লগ বা ভ্লগ (ভিডিও ব্লগ - ইউটিউব জিন্দাবাদ) ঘাঁটাঘাটি করে নেয়া ভাল।

৩। খরচাপাতি:

অন্যদের ব্যাপার জানিনা, আমাদের তিন জনের বিমান ভাড়া ৭৪.৫ হাজার লেগেছিল - সিজন অনুযায়ী এবং কত আগে কাটছেন সেটা অনুযায়ী এটা কম বেশি হবে। আমরা গেলাম অগাস্টে, যাত্রার মাত্র ৩/৪ দিন আগে টিকেট কাটা হয়েছিল।

৫ রাতের মধ্যে তিন রাত থিম্ফুতে আর দুই রাত পারোতে থাকা, তিন বেলার খাওয়া এবং ফুল-টাইম গাড়ি-গাইড সহ তিন জনের মোট ৯০ হাজার পড়েছিল। বাচ্চার জন্য দুই জায়গাতেই আলাদা বেডের কথা বলা ছিল -- তাই সবকিছুতেই ওকে এডাল্ট ধরে (অর্থাৎ ৩ জন এডাল্ট ধরে) হিসাব-কিতাব করা হয়েছিল। খাওয়া-দাওয়ার ডিটেইল পরবর্তীর ছবি সেকশনে আছে।

এর বাইরে স্যূভেনির এবং স্ন্যাকস কিনতে কিছু খরচ হয়েছিল।

৪। ১ম দিন: ঢাকা - পারো - থিম্ফু

বিকাল ৩:৫৫ তে ফ্লাইট। তাই ১:১৫ এর মধ্যে রওয়ানা দিয়েছিলাম। অনেক আগে পৌঁছেছিলমা তাই খুব দ্রুত চেক-ইন হল - একটা কাগজে সই নিল যে লাগেজে কোনরকম ব্যাটারি/পাওয়ার ব্যাংক নাই। ইমিগ্রেশন ঝামেলাবিহীন। বোর্ডিংএর সময়ে জুতা খুলে স্ক্যানারে দিতে হয়েছিল।
ফ্লাইট অন টাইম

একঘন্টার ফ্লাইট হলেও খানাদানা খারাপ দেয় না। শুধু প্যাটিসের মধ্যে মরিচ-মটশুটির একটা পুর ছিল, বানের ভেতরে চিজ দিয়ে ভরা ছিল। ছবিটা অবশ্য আসার সময়ের ফ্লাইটে তোলা।

কেউ ব্যাস্ত খাওয়া দাওয়ার দোকানের ঠিকানা খুঁজতে ...

আর কেউ ব্যাস্ত নিজের ভ্রমণ ডায়েরি লিখতে

পারোতে নেমে সবাই কোথায় ইমিগ্রেশনে দৌড়াবে তা না; ছবি তুলতেই ব্যস্ত। আর তুলবে নাই বা কেন ... ঢাকা থেকে এরকম সবুজ পাহাড়ে ঘেরা জায়গায় গেলে এক ঝটকায় মুগ্ধতা দিয়েই যাত্রা শুরু হবে।
এয়ারপোর্ট
ভিডিও শটও নিলাম কিন্তু অযথাই তাড়াহুড়া করাতে ভাল হয় নাই মোটেও। তারপরেও এটা এক ঝলকে ছবির চেয়ে বেশি তথ্য দিবে


এয়ারপোর্টের ভেতরে
এয়ারপোর্টের ভেতরটাও ছিমছাম, আধুনিক। নির্ঝঞ্ঝাট ইমিগ্রেশন পার হতে ৫ মিনিটও লাগলো না। বের হতেই দেখি বেল্টে লাগেজগুলো থেমে আছে। এরপর ভবন থেকে বের হবার মুখে প্রথমে মোবাইল সিম কার্ডের স্টল, বাইরে নামের প্ল্যাকার্ড হাতে বেশ কিছু ব্যক্তি দাঁড়িয়ে - নিজের নাম দেখে এগিয়ে গিয়ে ইংরেজিতে বললাম হ্যালো আমিই এই লোক, একটু অপেক্ষা কর, ফ্যামিলি সিম কার্ড নিয়েই চলে আসছে। ৩০০ উঁগুলট্রাম (=৩৬০ টাকা) দামে ৩ জিবি এক মাসের সিম নেয়া হল। একটা হোন্ডা স্টেশন ওয়াগনের পেছনে আরামেই লাগেজ এঁটে গেল আর আমরা চমৎকার ঝকঝকে রাস্তা ধরে থিম্ফুর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলাম - বেলা তখন প্রায় সোয়া পাঁচটা। পারো থেকে থিম্ফু ৪৫ কিলোমিটারের মত, যেতে এক থেকে দেড় ঘন্টার মত লাগে।



উপরের ভিডিওতে সম্পুর্ণ সৌন্দর্য তেমন একটা আসেনি, বাঁকগুলোও তেমন হয়তো বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু সামনের সিটে বসে থেকে শেষের দিকে আমার মাথা চক্কর দিচ্ছিলো। কিন্তু পেছনের সিটের দুজন কিন্তু বেশ ফূর্তিতেই ছিল। আমাদের হোটেলটা থিম্ফু শহর পার হয়ে অন্য প্রান্তে ছিল বলে পৌঁছুতে প্রায় পৌণে ছয়টা বেজে গেল। বাইরে তখনও ঝকঝকে উজ্জ্বল। ড্রাইভার সাহেব জানালেন আগামীকালই পুনাখা যাওয়ার জন্য পারমিট করা হয়ে গেছে। কাজেই কালকে সকালেই পুনাখা যেতে হবে। আমরা ভেবেছিলাম একদিন এখানেই ঘুরাঘুরি করে রেস্ট নিয়ে পরের দিন যাব - কিন্তু তা আর হল না।

Pemaling villaতে প্রথমে চমৎকার বড় কাপে দুধ চা-খাওয়ালো - তবে চিনি দেয়নি মনে হয়। আর কিছুই করা লাগলো না, একটা পাসপোর্ট চেয়ে নিল শুধু একটু সময়ের জন্য। রুমের ওয়াইফাই পাসওয়র্ড দিল ব্যাস। তিন তলার রুমটা বিশাল, মাঝে স্ট্যান্ডার্ড বাথরুম রুমটাকে দুইভাগে ভাগ করে ফেলেছে। বামের ভাগে তিনটা বেড, কার্পেট বেছানো অংশে জানালার সামনে দুটি সোফা আর পাঁচ ফুট লম্বা কাঠের টেবল, একপাশে আলমারি, চা বানানোর টেবল-চেয়ার। আর ডানের রুমের অংশে আরো দুটি সোফা, কাঠের টেবল, বিরাট একটা কেবিনেট-কাম টেবল। বড় বড় তিনটা জানালা।

ফ্রেশ হয়ে ডিনারের জন্য নামলাম ৮:১৫তে। টেবিলে খাবার সার্ভ করলো - পাপড়, সাদা ভাত, কাচা আটার রুটি, আলুভর্তা, মুরগীর কারি, মিক্সড ভেজিটেবল, ডাল, পানি। দেশ থেকে এ্যাত দুরে এসে ক‌োথায় নতুন কিছু টেস্ট করবো, তা না - সেই দেশি খাবার দাবারই: বিষয়টা আমাদের ভাল লাগেনি; কিন্তু বাংলাদেশ থেকে প্যাকেজ দিলে নাকি এরকমই মেনু দেয়া থাকে। আর আমাদের লোকজনও সবজায়গায় ভাত ভাত করে - তাই এই অবস্থা। রান্না-বান্না খুবই ভাল ছিল। এ্যাত খাবার খেয়ে শেষ করা সম্ভব ছিল না।

আসল ভ্রমন শুরু হবে পরের দিন থেকে।

৫। ২য় দিন: দোচুলা পাস, পুনাখা

সকালের নাস্তা আর রুমে বসে চা বানিয়ে খাওয়া:
নাস্তা: প্রিয় কর্ণ ফ্লেকস, সাথে আছে কমলার জুস

নাস্তা: তেলে ভাজা পুরী (আমাদের তেল অপছন্দ), আলুর ডাল, ডিম ভাজি, পাউরুটি-টোস্ট, গলানো মাখন, জ্যাম, কলা, তরমুজ

নিজেদের রুমে চা খেতে খেতে বাইরের ঝকঝকে রোদ আর পাহাড় দেখা

অন্য দিকের জানালাতেও পাহাড়

হোটেল থেকে দোচুলা পাস - ৪৫ মিনিটের ড্রাইভ। রাস্তা চরম আঁকা বাঁকা - যথারীতি একপাশে পাহাড় আর আরেকপাশে খাদ। সেখানে পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে এত বড় একটা চত্বর দেখে মনটা খুশি হয়ে যায় নিমিষেই।

দোচুলা পাস

দোচুলা পাস। মেঘের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার অনুভুতি পাহাড়ের ভিউ মিস করার কষ্ট ভুলিয়ে দেয়
দোচুলা পাস: মনে হয় ছাদে দাঁড়িয়ে আছি
এখানেও চমৎকার টয়লেট সুবিধা আছে, অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন - ২০ উঁগুলট্রাম করে নেয়। পরের লক্ষ্য পুনাখা। এখানে থেকে সোয়া এক ঘন্টার পথ। আঁকা বাঁকা পথে শুধু নামতে হবে ... পুনাখার ১০ মিনিট আগে, পথে দুপুরের খাবারের জন্য থামা হল।
পুনাখার পাহাড়গুলো একটু কম খাড়া আর সবুজে ভরা

আঁকা বাঁকা রাস্তার মাঝে মাঝে সমতল দেখলে কেমন জানি আরাম লাগে

সবুজ পাহাড় আর নীল আকাশ

ঐ তো ক্ষেত খামার আর মানুষজনের বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে
একই সাথে সবুজ পাহাড়, আঁকা-বাঁকা রাস্তা, পাহাড়ি নদী, ধাপে ধাপে ধানক্ষেত আর বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে
অবশেষে রেস্টুরেন্টে। এমন জায়গায় বুফে দেখে অবাক! তবে খাবার আহামরি কিছু নয়।

খাবার যাই হোক না কেন, সামনে এমন দৃশ্য থাকলে সবকিছুই অসাধারণ লাগে (খাবার ট্যূর প্যাকেজের সাথে ছিল, কিন্তু ড্রিংকস আর পানি কিনতে হয়েছিল; দুইটা ক্যান কোক আর একটা হাফ লিটার পানির দাম পড়েছে ২৬০ উঁগুলট্রাম)
খাওয়ার পরে হাঁটাহাঁটি। বামের কাঁচঘেরা ভবনটাই সেই রেস্টুরেন্ট



এবার রেস্টুরেন্ট থেকে আবার রাস্তায় গাড়িতে ফিরে যাওয়া। রাস্তার পাশেই কল কল করে ঝরণার মত পানির প্রবাহ
 এরপর লক্ষ্য ঝুলন্ত সেতু
নদীর ডাক কি উপেক্ষা করা যায়। পানি ছুঁতে দৌড়াতে হবেই। নদীর স্থানীয় নাম: মো ছু (ছু মানে নদী)
এই সেই ঝুলন্ত সেতু
সেখানে উঠতে হলেও ট্রেকিং করতে হবে
সেতুতে উঠতে ভয় লাগে নাকি? মোটেই না ...

মাঝ নদীর উপর থেকে ছবি না তুললে হয় নাকি! প্রবল বাতাসে ব্রীজ কিন্তু এদিক সেদিক দুলছে

ঐ যে ডানদিকের রাস্তায় আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আর ঐখান থেকেই পায়ে চলা খাড়া পথে ট্রেক করে উঠতে হয়েছে ব্রীজে
পরের লক্ষ্য পুনাখা জং -- এখানে জং মানে দূর্গ। এখন এটার ভেতরে জেলার প্রশাসনিক অফিস আছে।
পুরা জং এর ছবি, একটা কাঠের ব্রীজ দিয়ে মো ছু (নদী) পার হয়ে ঢুকতে হয়
জং এর সামনের অংশ। দূর্গটি এদিকে মো ছু (নদী) আর ওদিকে ফোঁ ছু (নদী) থাকায় এই নদীদুটির মিলনস্থলে প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত।
হঠাৎ করে দেখে মনে হয় এটা কোন দেশ! গাড়ি পার্কিংএর পর দূর্গের প্রবেশপথ কাঠের ব্রীজের শুরু এই অংশে।
আহ্! বড়ই শান্তির জায়গা
ব্রীজের এলোমেলো বাতাসে মন ভাল হয়ে যাবে নিমিষেই
ওরে বাবা! এখানেও এ্যাত্ত উঁচু!! উপরে উঠার পরিকল্পনা বাদ ...
দূর্গের আরেকটা ভবন
অন্য পাশ থেকে  দেখলে এর বিশালত্ব কিছুটা আঁচ করা যায়
এই সেই কাঠের ব্রীজ (দূর্গের এ পাশ থেকে)
উঁচু দেখে উঠার পরিকল্পনা বাদ দিয়েছিলাম। এটার মাঝখানে দেখি আরোও উঁচু অংশ আছে!!
দূর্গ দেখা শেষে ফেরার পথে
ফেরা পথের শুরুতেই একটু কেক-চিপস-চা খেয়ে নিলাম। চমৎকার ৩ পিস কেক (আমাদের পেস্ট্রির মত), দুই-প্যাকেট চিপস আর ৩ কাপ চা = ২৩০ উঁগুলট্রাম ... এই প্রথম ঢাকার চেয়ে সস্তা মনে হল।
থিম্পুর Pemaling Villaতে ফিরে রাতের খাবার। ওখানকার জন্য দূষ্প্রাপ্য মাছও ম্যানেজ করে ফেলেছে! (আমরা কিন্তু চাইনি)। আমাদের আগের আব্দার রক্ষায় ভুটানি ডিশ বানিয়েছে একটা -- আলুর ঝোল।

পরের অংশ দেখতে ক্লিক করুন: ভুটান ভ্রমণ - ০২

কোন মন্তব্য নেই: