গণপরিবহণ নিয়ে ...
কোনটা চাই:
ধরুন একজন ব্যক্তি টঙ্গি থেকে মতিঝিল নিয়মিত অফিস করেন; আরও ধরুন গাড়িতে/বাসে যাওয়া আর আসাতে ৪৫ মিনিটও লাগতে পারে, আবার কপাল খারাপ থাকলে আড়াই ঘন্টাও লাগতে পারে, তাহলে তিনি ৯টার অফিস ধরার জন্য কখন রওনা দিবেন? কিংবা আগামী পরশুদিন একজনের সাথে সকাল ১০টায় মিটিং করার সময় ঠিক করে নিশ্চিন্ত মনে রওয়ানা দিতে পারবেন কি না?এবার ধরা যাক সেই ব্যক্তির কাছে আরেকটি বিকল্প আছে, যেটাতে উনি জানেন যে এই পথটা ট্রেনে যাওয়া যায়, আর এভাবে গেলে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা, একটু হাঁটা সব মিলিয়ে ঠিক এক ঘন্টা ১৫ মিনিট লাগবে যেটাতে সর্বোচ্চ ৫ মিনিট কম বেশি হতে পারে। তাহলে পরিস্থিতিটা কী দাঁড়াবে? উনি কি ৪৫ মিনিটে পৌঁছানোর চান্স নেয়ার জন্য গাড়িতে আসতে বেশি পছন্দ করবেন (ধরা খেলে আড়াই ঘন্টা লাগবে ৫০-৫০ চান্স) নাকি নিশ্চিত ভাবে সোয়া এক ঘন্টার ট্রেনযাত্রা বেছে নিবেন?
.
.
.
.
এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হলে মানুষ যেটা চায় সেটা হল সময়ের নিশ্চয়তা। বিশেষ করে সেই যাত্রাটা যদি অফিস/স্কুল /কলেজ ইত্যাদিতে যাওয়া আসার মত নিয়মিত যাত্রার অংশ হয় তাহলে এই নিশ্চয়তার বিষয়টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। একই রাস্তা যেতে কোনদিন ৩০ মিনিট আর কোনদিন ৩ ঘন্টা লাগলে সেই আয়োজনের উপর নির্ভর করে কোন কাজের পরিকল্পনা করা যায় না। প্রতিদিনই যদি সেই একই রাস্তায় ঠিক দেড় ঘন্টা লাগে, তাও সেটা অনিশ্চয়তার চেয়ে ভাল। অন্ততপক্ষে সেই দেড় ঘন্টার জন্যও পরিকল্পনা করা যায় (যেমন: গাড়িতে/ট্রেনে/ট্রামে/বাসে ঘুমিয়ে নেয়া, জরুরী ফোনালাপ সেরে নেয়া, গান শোনা, নিউজপেপার পড়া, গল্পের বই পড়া, পডকাস্ট শোনা ইত্যাদি)। কাজেই সময়ের সাপেক্ষে নির্ভরযোগ্য যাতায়াত ব্যবস্থা মানুষকে অনিশ্চয়তার হাত থেকে স্বস্তি দিতে পারে।
এ তো গেল যাত্রীর পক্ষের কথা। এবার আসা যাক সার্ভিস প্রোভাইডার বা সেবাদানকারীর কথায় …
সমস্যা কোথায়:
ব্যক্তি মালিকানায় যখন যাতায়াত সিস্টেম থাকে তখন তাঁদের লক্ষ্য থাকে সর্বোচ্চ লাভ করা। কাজেই লিজ সিস্টেমে ড্রাইভার নিজ উদ্যোগে আর বেতনভোগী সিস্টেমে মালিকের নির্দেশেই সব সিট না ভরলে গাড়ি ছাড়বে না। আবার অন্যকেও আগে যেতে দেবে না, কারণ তাহলে যাত্রী হারাবে। ফলাফল রাস্তায় গাড়ি বাঁকা করে থামাবে, অন্য গাড়িকে ব্লক করবে, তৈরী হবে ঘন্টার পর ঘন্টা স্থায়ী ইতর যানজট। তৈরী হবে সেই অনিশ্চিত, সময়-অনির্ভরযোগ্য যাতায়াত সিস্টেম। এই ফল অবধারিত; বাস মালিক পক্ষকে লাভ করতে চাওয়ার জন্য দোষারোপ করে এটার সমাধান করা যাবে না। যদি জোর করে তাদের সময় মত বাস ছাড়তে বাধ্য করা হয়, তাহলে অনেক সময় খালি গাড়ি নিয়ে তাঁদের বেশ কিছু পথ যেতে হতে পারে, ফলে হয়তো লাভ তো দুরের কথা, চলাচলের খরচই উঠবে না।তাহলে দেখা যাচ্ছে আমরা যেই সিস্টেম চাই সেটা অর্থনৈতীকভাবে টেকসই নয়। আবার অর্থনৈতীক ভাবে টেকসই করতে চাইলে সেই নির্ভরযোগ্য সিস্টেম সম্ভব নয়। আসলেই কি তাই?
সমাধান আছে:
যদি ব্যক্তির লাভের বদলে সামগ্রীক লাভের দিকে তাকাই তাহলে হয়তো সমাধানের জায়গাটা চোখে পড়বে। যেই জায়গায় কোনো পাবলিক যাতায়াত সিস্টেম নাই আর যে জায়গায় আছে তাদের তুলনা করলে এলাকা দু'টির অর্থনৈতীক সমৃদ্ধির মধ্যে চোখে পড়ার মত পার্থক্য থাকবে। একটা এলাকার সাথে যদি অন্য এলাকাগুলোর চমৎকার নির্ভরযোগ্য যাতায়াত ব্যবস্থা থাকে তাহলে সেই এলাকাটি সকলের জন্য আকর্ষনীয় হয়ে উঠে। খুচরা বিক্রেয়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যেমন সেখানে আসতে চাইবে, তেমন মানুষজনও বসবাস করার জন্য সেখানে থাকতে চাইবে। ফলে সেই এলাকার জমির দাম বাড়বে, বাসা ভাড়া বাড়বে। চাহিদার উপর ভিত্তি করে সেখানে চমৎকার সব অবকাঠামো গড়ে উঠবে। এই সব মিলিয়ে সেখান থেকে স্থানীয় প্রশাসন তথা সরকারের আয়ও বৃদ্ধি পাবে। কাজেই সামগ্রীক ভাবে যে উন্নয়ন সেটার ফলে কোনো বাস/টেম্পু/ট্যাক্সি মালিকের সরাসরি তেমন লাভ হয় না, কিন্তু প্রশাসনের আয় বৃদ্ধি পায় উল্লেখযোগ্য পরিমানে।সংক্ষেপে: উন্নয়নের ভিত্তি হচ্ছে চমৎকার নির্ভরযোগ্য যাতায়াত ব্যবস্থা - যেটাতে যাত্রী আসুক বা না-আসুক, সময় মত বাস/টেম্পু/ট্যাক্সি চলতে হবে। কিন্তু এটাতে ব্যক্তি মালিকানাধীন বাস/টেম্পু/ট্যাক্সি মালিকের লাভ নাই, বরং ক্ষতি। কিন্তু এই সিস্টেমে লাভ তো হচ্ছে … কার? প্রশাসনের/সিটি কর্পোরেশনের ….
আর এজন্যই দেখা যায় পৃথিবীর সকল উন্নত শহরে সরাসরি বাসের/ট্রেনের খরচ না উঠলেও ভর্তূকী দিয়ে সময়-নির্ভরযোগ্য যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করছে প্রশাসন। কারণ প্রশাসনই এখানে অর্থনৈতীকভাবে লাভবান হয়, ব্যক্তি মালিকানার বাস/টেম্পু মালিক নয়।
–
২টি মন্তব্য:
Very nice post.
খুব প্রাসঙ্গিক লেখা। - ধন্যবাদ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন