শুক্রবার, ২ জানুয়ারী, ২০১৫

পহেলা জানুয়ারীর ঘোরাঘুরি (২০১৫)

অফিস ছুটি বেশ কয়েকদিন। যদিও ছুটিটা নামকাওয়াস্তে - কারণ বাসায় বসে বসে অফিসের কাজই করতে হচ্ছে অবিরত (পরীক্ষার খাতা দেখা)। বাচ্চার স্কুলও বন্ধ -- এক মাসেরও বেশি লম্বা ছুটিতে বাসায় থেকে থেকে ওরও খারাপ লাগে। তাই ঠিক করলাম একটু বাইরে থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসা যাক। ১লা জানুয়ারী দিনটা মেঘলা হলেও তেমন ঠান্ডা ছিলো না, বরং ঘুরাঘুরি করার জন্য দারুন একটা না-গরম, না-ঠান্ডা আবহাওয়া ছিল। রেডি হয়ে বের হতে হতে বিকাল। বাসার গেট থেকে বেরুতেই রিকশা পেলাম। সেটাতে করে গেলাম চারুকলা ইনস্টিটিউট। মেয়ে তো রিকশায় উঠে মা-কে বলছে, "জানো ওটার পাশে মিউজিয়াম আছে, তোমাকে দেখাবো"। মা তো অবাক, ও জানলো কি করে! কারণ গত ডিসেম্বরেই ওদের স্কুল থেকে মিউজিয়ামে নিয়ে এসেছিলো; তো সেদিন আমি ওখান থেকে ওকে নিয়ে চারুকলার বাইরে দিয়ে দেখিয়ে নিয়ে এসেছিলাম, আর এবার যাওয়ার সময় বলেছিলাম।
চারুকলার সামনে নেমেই চুড়িওয়ালা মহিলার শ-দুয়েক টাকার বিক্রি হল (থ্যাংকস টু মাই ওয়াইফ)। শহরে এপার্টমেন্টে থাকা বাচ্চারা অনেকটা ফার্মের খাঁচায় বড় হওয়া মুরগীর মত। এতটুকু প্রকৃতি, গাছপালা, ছাড়া-কুকুর পেয়ে সে অভিভূত। হৈ হৈ করে দৌড়ে বেড়াতে লাগলো এদিক থেকে সেদিক। একটা পাথর দেখে চিৎকার -- বাবা বাবা দেখো একটা পাথর!! উপরের ছবিটা চরুকলা ইনস্টিটিউটের দক্ষিন দেয়াল ঘেষে থাকা একটা বাচ্চাদের অংকন শেখানোর স্কুল। বউ মহা খুশি, কারণ তাঁর কাপড়ের রঙের সাথে ম্যাচ করা রঙে দেয়াল টইটুম্বুর। ছাদের উপরে বড়ই গাছ, আর পেছনে কলা গাছ সব মিলিয়ে দৃশ্যটা বেশ চমৎকার লাগছিলো।
জানিনা কে এই নোটিশটা লাগিয়েছে, কেন লাগিয়েছে। তবে এটা দেখলেই এর গোড়ায় দাঁড়িয়ে ছবি তোলার একটা ইচ্ছা জেগে উঠবে মানুষের -- এই ভেবে যে "বাপরে! দশ টাকা দেয়া লাগবে --- কি না কি!" যা হোক, দাঁড়িয়ে বানানটা ঠিক নাই ;) ।
মেয়ে পোজ দেয়া শিখেছে বেশ ভালই!
ইয়ে, এটার ব্যাখ্যা ট্যাখ্যা নিজের মত বুঝে নেন। মেয়েকে খালি বলেছি একজন মা এক হাতে কলস আরেক হাতে বাচ্চাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ক্ষুদিপানা, কচুরীপানা তুলে নিয়ে মেয়ের হাতে দিলাম। দাড়ির মত শেকড় দেখিয়ে বলেছি যে আমাদের টবে যেই গাছগুলো আছে ওগুলোরও নিচে মাটিতে এমন শেকড় আছে।
ছবি তুলতে কোনো আপত্তি নাই ...
বের হতেই চাচ্ছিলো না। জোর করেই বের করতে হল। এরপর বউয়ের পরিকল্পনা ছিল সেন্ট্রাল লাইব্রেরীতে ঢুকবে। কিন্তু আমার মনে হল, মেয়ের ভাল লেগেছে গাছপালা -- ঐ লাইব্রেরীতে সে হয়তো মজা পাবে না। তাই রাস্তা পার হয়ে অন্যপাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকলাম। ঢুকেই মনে হল খাবারের স্ট্রিট-মার্কেটে ঢুকেছি। গাছপালা আছে ঠিকই কিন্তু দুইপাশে অনেকগুলো স্ট্রিটফুডের দোকান। ওগুলো খেয়েও মানুষ সুস্থভাবে বেঁচে থাকে -- এই বিষয়টা আমাকে মানুষের সক্ষমতা সম্পর্কে বেশ ভাবায়।
হাঁটতে হাঁটতে পেছনে বউ গজর গজর করছে --- "এই মানুষটার রুচি আর ভাল হল না। কোথায় লাইব্রেরী যাব, তা না ধুলা বালুর মধ্যে নিয়ে এসেছে"। আমি একটু কনফিউজড (কারণ বউ তো আমিই পছন্দ করেছিলাম, আর আমাকে পছন্দ করেছিলো ও) আর না শোনার ভান করে হন হন করে সামনে আগাতে থাকলাম। কারণ মাঝে স্বাধীনতা স্তম্ভতে কখনো যাইনি; অন্যেরা গিয়ে ছবি দেয়, নেটে ছবি দেখি, কিন্তু নিজে কখনো যাইনি। আজ দেখেই যাব। ওয়াকওয়ে ছেড়ে ধুলাবালি, ছোট ওয়াল- এসবের উপর দিয়ে হাঁটতে পেরে মেয়ে মহা খুশি। এমন করতে করতে সামনে একটা শিখা জ্বলছে এমন জায়গায় পৌঁছুলাম। ডানে তাকাতেই চমৎকার চত্বর, গাছগুলো সাইজ মত কাটা। পরিচ্ছন্ন অবস্থায় দেখলে বিদেশ মনে হবে। তবে আমরা তো আর সভ্য হইনি, তাই এসব জায়গায় মোটরসাইকেল তুলে দেই ডাঁটে।
কাঙ্খিত স্বাধীনতা স্তম্ভে পৌঁছে সকলের মন নিমেষেই ভাল হয়ে গেল। অসাধারণ একটা দৃশ্য! যদিও নিচে মানুষজন, মটরসাইকেল, সাইকেল আর ঠোঙ্গা দিয়ে ময়লা করে ফেলেছে, কিন্তু ঢাকা শহরে এমন ভাবে চোখের সামনে খোলা আকাশ + দিগন্তে গাছ ইদানিং কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তার উপর আকাশে মেঘের সাজটাও অদ্ভুদ সুন্দর লাগছিলো।
মেয়ে অবশ্য ক্লান্ত, আমার বা ওর মায়ের শরীরে হেলান দেয়ার চেষ্টা করছে, তাই কোলে নিলাম। ব্যাগে ওর খাদ্য (বিরাটাকার চকলেট) ছিলো। পাশে বসে সেগুলো খেয়ে আবার ফুল চার্জে চাঙ্গা হয়ে গেল। এই ফাঁকে আমি অদ্ভুদ সুন্দর আকাশে আলোছায়াগুলো ক্যামেরায় ধরার চেষ্টা করতে লাগলাম।

উপরের দৃশ্যটা দেখে ভুলবেন না। ক্যামেরার চোখ একটু নিচু করে তুলতেই এমন দেখাবে। পরিচ্ছন্ন থাকলে অবশ্য এটাও অসাধারণ একটা দৃশ্য হত।

আকাশ দেখার বিলাসিতা।
ক্যামেরায় চোখে দেখা সৌন্দর্য আর রঙ ধরা যায় না। এরকম সময়ে ভাল ক্যামেরার জন্য আফসোস লাগে কিছুটা।
সভ্য হওয়ার আগেই সভ্যতা চাপিয়ে দিলে যা হয় আর কি! এখানে কিছুদুর পর পর স্থানের স্থাপত্যের সাথে মানানসই ডিজাইনে ওয়েস্ট বিন দেয়া উচিত বলে মনে হয়। আর প্রতি ঘন্টায় যদি ময়লা কুড়ানো টোকাই নিয়োগ দেয়া হয়, তাহলে এটা অসাধারণ সুন্দর একটা জায়গা হতে পারে। পরিচ্ছন্ন জায়গা দেখলে এমনিতেই বাকীরা সেটাতে ময়লা-ঠোঙ্গা ইত্যাদি ফেলতে দ্বিধা বোধ করবে, ডাস্টবিন খুঁজে ময়লা ফেলবে। ফলে পরবর্তীতে পরিচ্ছন্ন কর্মীগণ অন্য কাজেও সময় দিতে পারবেন।



শুধু ময়লাই না, জায়গায় জায়গায় ছাই দেখে বোঝা যাচ্ছে শীতে এখানে আগুনও জ্বালিয়েছে!!
ফেরত আসার সময়ে দুয়েকটা ছবি না তুললেই না। মুশকিল হল যখনই নীলিয়াকে পেছনে শিশুপার্ক দেখালাম, ও বলে "যেতে চাই"; ভেতরে মানুষ গিজগিজ করছে, প্রতিটা রাইডের সামনে লম্বা লাইন দেখে আমার ওখানে যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো না, কিন্তু যার জন্য বেড়াতে বের হওয়া সে-ই যখন আগ্রহী তখন আর কী করা! প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। কাজেই অন্যপাশ দিয়ে (ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের /রমনার গেটের দিকে) বের হয়ে একটা রিকশা চড়ে সময় আর এনার্জি সংরক্ষণ করে দ্রুত শিশুপার্কে আসলাম।
লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে যখন নীলিয়া আর ওর মা রাইডে চড়ছিলো, আমি তখন একটা ছাউনির মধ্যে বসে বসে অপেক্ষায় পপকর্ন চিবাচ্ছিলাম। একসময় ফোন দিয়ে বলে, যে নীলিয়া ট্রেনে চড়বেই - তাই ওরা লাইনে দাঁড়িয়েছে। লাইন এ্যাতটাই লম্বা যে ওদের সুযোগ আসার আগে অন্তত ৬-৭ রাউন্ড পার হয়ে যাবে। আমিও ওপাশে গেলাম। তারপর ওর মা বললো, "তোমার নিশ্চয়ই আমার মত হাইটফোবিয়া নাই -- তাহলে যাও - আমি লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি তুমি মেয়েকে নাগরদোলায় চড়াও"। নাগরদোলায় চড়ার আগ পর্যন্ত ভালই ছিলাম। তারপর উচ্চতার ব্যাপারটা ভুলে থাকার জন্য মেয়েকে দুরে অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে আলো ছড়ানো স্বাধীনতা স্তম্ভ দেখাচ্ছিলাম। মেয়ে তো ভয় পাওয়ার মত বড় হয়নি, কাজেই ও আমাকে মাঝে মাঝে অভয় দিচ্ছিলো!!
ওখান থেকে আসার পরও অনেক সময় লাগবে ট্রেনে উঠতে। তাই ওকে নিয়ে নিচু জায়গাটায় (শুকনা পুকুরের মত) নামলাম, উঠলাম; একজায়গায় বসে পপকর্ন খাওয়ালাম। যা হোক অপেক্ষার পালা শেষে একসময় ওরা ট্রেনেও ঘুরে এল। ওর মায়ের সামনে লাইনে যেই হুজুর দাঁড়িয়ে ছিল, লাইন শেষ হওয়ার আগে আগে তার দলবল - বোরখাপড়া মহিলা, আন্ডা-বাচ্চার দল, আল্ট্রা-মডার্ন পোশাকের ছেলে মেয়ের দল মিলে গোটা ১৫ জন যোগ দিয়েছিলো!!
ট্রেন থেকে নামার পর বললাম "চলো পেছন দিক থেকে আলোকজ্জ্বল স্তম্ভটা দেখে তারপর বের হই"। যাওয়ার পথে দোলনা, ঢেকি (সী-সঅ), স্লিপার দেখে ওগুলোতে ওঠার কোর্সও কমপ্লিট করলো নীলিয়া! তারপর আরো একটা টিকিট থাকাতে আর লাইন না থাকাতে ফুলের মত ঘুরে যে রাইডটা সেটাতে উঠলো (এটা আজ ২য় বার); হয়তো "আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী" রাইডটাতেও আবার উঠতে মন চাচ্ছিলো। কিন্তু আমরা বের হয়ে আসলাম।
ভ্রমন শেষ করলাম খাওয়া দাওয়া দিয়ে। গেট থেকে বের হয়ে বেশ খানিকটা প্রাকৃতিক ফুটপাথ (মানে হাঁটার সময় খানা-খন্দ, ভেজা, ধুলা সব মিলিয়ে মনে হবে প্রাকৃতিক পাহাড় পর্বত দিয়ে হাঁটছেন) হেঁটে শাহবাগে এসে রিকশা নিয়ে বাসার কাছের জিনজিয়ান। রিকশায় মোটামুটি অবসন্ন হয়ে আমার ঘাড়ে মাথা ছেড়ে ঘুমালেও, এখানে এসেই নীলিয়া এদের বাচ্চাদের খেলার সেকশনে মহানন্দে আরেক দফা খেলাধুলা করলো। এমনকি খাওয়া দাওয়া শেষেও বের হওয়ার আগে মিনিট দশেক খেলার পর মোটামুটি অনিচ্ছা সত্ত্বেও বের হয়ে এসেছিলো।
সব মিলিয়ে নীলিয়ার জন্য দিনটা স্মরনীয় হয়ে থাকবে মনে হয়। কারণ ভোরে উঠে রাত থেকে আকাশ ফর্সা হয়ে সকাল হওয়া দেখেছে (অবশ্য ভোরে উঠেছিলো কাশতে কাশতে); তারপর যতক্ষন পেরেছে কার্টুন দেখে ড্রইংরুমেই ঘুমিয়েছিলো দুপুর পর্যন্ত। তারপরে তো ফ্রেশ হয়ে এই ঘোরাঘুরি।

কোন মন্তব্য নেই: