স্মার্ট ফোন কি আসলেই দরকার
স্মার্টফোন নিয়ে আগ্রহ আছে, কিন্তু অতগুলো টাকা খরচের আগে ভালভাবে জেনে
নেয়া দরকার, তাই প্রায়ই বিভিন্ন ফোনের রিভিউ পড়ি। রিভিউগুলোতে টেকনিক্যাল
দিকগুলো বেশ বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। তবে সেই তথ্যগুলো আমার সিদ্ধান্ত
গ্রহণকে প্রভাবিত করতে পারেন না -- কারণ আমার নিজের আসলে কতটুকু এই
অতিরিক্ত স্মার্ট-চাহিদাগুলো আছে (চাহিদা = যার জন্য খরচ করা যায়,
অর্থনীতির ভাষায়) তা ঠিকমত বুঝতে পারিনা। তাই ভাবলাম লিখে ফেলি -- বুঝতে
সুবিধা হবে এতে। এখানে লিখিত পুরা বক্তব্যই ব্যক্তিগত অভিমত, যা সকলের জন্য
সত্য হবে এমন কোনো কথা নাই।
১।
প্রথমবার যখন বসুন্ধরা সিটি শপিংএর নিচের লাউঞ্জে সুবেশী তরুণ তরুণীরা স্যামসাং গ্যালাক্সি নোট-২ ডিসপ্লে করছিলো তখন এর ৬২হাজার টাকা দাম দেখে ভীমড়ি খেয়েছিলাম। তখন টিভিতেও এটার একটা বিজ্ঞাপন দেখাতো। একজন লোক এই ফোনের মধ্যে একটা টাওয়ারের ছবি/স্কেচ এঁকে ফেললো। পরবর্তীতে স্মার্টফোনের আরো অনেক বিজ্ঞাপন দেখেছি -- একজনের বার্থডে, বন্ধু ছবি তুললো। আরেকজন আরেকটা ছবি তুলে এডিট করে মাথায় কি জানি একটা বসিয়ে দিলো -- হৈ হুল্লোড়। আমি জানি যে শখের দাম লাখ টাকা, কিন্তু তাই বলে ছবি তুলে হৈ-হুল্লোড় করার জন্য এ্যাত টাকা! অনেক পরিবারের একমাসের খরচের চেয়ে বেশি, একটা মোটামুটি ভাল মানের ল্যাপটপের চেয়ে বেশি। আমি খেটে খাওয়া মানুষ। প্রতিটা টাকা ইনকাম করতে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয় -- এটা অবশ্য অনেকের জন্যই সত্য। তবে বিজ্ঞাপনে দেখানো ছবি তুলে যাঁরা এডিট করে হৈ-হুল্লোড় করে ওরা নির্ঘাৎ নিজেরা ইনকাম করে না -- এই রকম একটা বয়স শ্রেণীকেই দেখিয়েছে।
২। দাম:
একটা ল্যাপটপ কিনেছিলাম। দাম প্রায় এই ফোনের সমানই। এটা দিয়ে কাজ করে এক বছরের মধ্যেই আমার রেগুলার ইনকামের বাইরে এর দাম উশুল করা ইনকাম যোগ করতে পেরেছি। কিন্তু আমার মাথায় কোনক্রমেই আসছে না যে এই ফোন দিয়ে কিভাবে সেইরকম প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানো সম্ভব। হ্যাঁ আমার ইমিডিয়েট ছোটভাইয়ের একটা এই জিনিষ আছে (পরবর্তীতে দাম কমার পর কেনা) সেটা তাঁর অনেক কাজেও লাগে -- কারণ তাঁকে সবসময় অফিসিয়াল কারণেই অনলাইন কাজের সুপারভাইজার হিসেবে কানেক্টেড থাকতে হত; মোটরসাইকেল চালিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যায়, তাই জিপিএসটাও প্রায়ই কাজে লাগে। এখন স্মার্টফোনের দাম আরও কমে এসেছে - যাকে বলে একেবারে নাগালের মধ্যে। এমনকি নামী মেকারের বেশি দামীগুলোও শূণ্য সুদের ১২ কিস্তিতে কেনা যায় -- অর্থাৎ পকেটে এই মুহুর্তে টাকা না থাকলেও সমস্যা নাই। এইতো সেদিন দোকানে লেটেস্ট গ্যালাক্সি এস ৪ মিনি দেখলাম ৪২,৫০০ টাকা - যা ক্রেডিট কার্ডে ১২ কিস্তিতে কেনা যায়।
৩। মাল্টিমিডিয়া:
এবার আসি মাল্টিমিডিয়া ব্যাপারে। স্মার্ট ফোটগুলোতে মাল্টিমিডিয়া সাপোর্ট যেমন গান, রেডিও শোনা, মুভি দেখা যায় বলে জানি। ব্যক্তিগত ভাবে আমার গান বা রেডিও শোনা অথবা সিনেমা দেখার তেমন কোনো শখ বা অভ্যাস নাই। আমার কোনো এমপিথ্রি প্লেয়ার নাই, কম্পুতে তেমন গান নাই (পাইরেসী এভয়ড করার জন্য), মুভি দেখার টাইম নাই। তার মানে এই না যে এগুলো কী জিনিষ আমি জানি না। এক সময় ওয়াকম্যান, ডিস্কম্যান (জাপান থেকে সবচেয়ে ভাল কোয়ালিটিরটা কিনেছিলাম) বিস্তর চালিয়ে শরীর মনে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী সেই বিষয়ের হরমোনগুলো শেষ। রাস্তায় চলার সময়তো কখনই কানে ওয়াকম্যান দিতাম না -- কারণ চারপাশের শব্দগুলোই আমার কাছে বেশি ইন্টারেস্টিং লেগেছে সর্বদা। মুভি রেন্টালে ১০০০ ইয়েনে ১ সপ্তাহের জন্য ৫ মুভি করে নিয়ে আসতাম; এমনও সময় গেছে রিলিজের পর পরই অনেক বেশি খরচে লর্ড অব দ্যা রিং-এর তিন পর্ব ১ রাতে দেখে ফেরত দিতে হয়েছিলো; বছরে চারবার করে দেশে আসার সময়ে ফ্লাইটগুলো আর লম্বা ট্রানজিট মুভি দেখেই কাটতো। তবে কোনক্রমেই সেগুলো দেখার হার এখনকার পাইরেসি করে নামানো মুভিফ্রিকদের মত ছিল না। ইদানিং হয়তো বছরে গড়ে ১২টা মুভি দেখা হয় -- যার অর্ধেক সিনেপ্লেক্সে আর অর্ধেক মুভি চ্যানেলে। কম্পিউটারে মুভি দেখাটা আমি চরম অপছন্দ করি, কারণ এই যন্ত্রটা আমার কাজের জিনিষ - বিনোদনের জিনিষ নয়। তবে কম্পিউটারে অকাজ খুব একটা কম করি তা নয় -- যেমন এই লেখাটাও কম্পিউটারে বসেই লেখা। মোদ্দা কথা হল একেই মুভি দেখার মত সেরকম নিরবিচ্ছিন্ন অবসর থাকে না, আরেকদিকে আমি কম্পিউটার কিংবা এর চেয়েও ছোট স্ক্রিনে মুভি দেখি না, দেখবো বলেও মনে হয় না - আর এ্যাত মুভি পাব কোথায় (লিগাল)। তাই স্মার্ট ফোনের এই ফীচারটা খুব একটা কাজে লাগবে না। আবার দেখা যাবে, এখানে হয়তো কার্টুন চালিয়ে কাজের সময়ে কন্যা এটা বেদখল করে রেখেছে!
৪। গেমস:
গেমসের কথা মনে পড়লে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। রাতের পর রাত গেম খেলে নির্ঘুম কাটিয়ে পরদিন ক্লাসে গিয়ে ঢুলেছি, আর এখন -- গেম খেলার সময় বের করা ... ... অসম্ভব! আমার ধারণা স্মার্ট ফোনের গেমগুলোই একটা জেনারেশনের কাছে এটাকে জনপ্রিয় করেছে। আমার একেবারে ছোট সহোদর, ১১ বছরের ছোট -- যে কিনা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বিভাগীয় প্রধান - গেম খেলার জন্য তার আর তার বেস্ট হাফের আলাদা মেশিন!! হুমম -- ঐ বয়সে আমিও খেলেছি। গেমের সেই পর্বগুলো পার হয়ে আসা আমার মত আধবুড়ার জন্য যেটা খুব একটা আকর্ষনীয় না।
৫। ক্যামেরা:
হ্যাঁ স্মার্ট ফোনের এই জিনিষটা আমি মিস করি প্রায়ই। পেশাগত কারণেই বিভিন্ন মূহুর্তের ছবি বা ভিডিও ক্লিপ তুলতে ইচ্ছা হয় - যা পরবর্তীতে প্রেজেন্টেশন তৈরীতে কাজে লাগবে। কিন্তু পকেটে ফোন, থুক্কু, ক্যামেরা না থাকায় সেটা হয় না। কিংবা হঠাৎ দেখা একটা তথ্যও ছবি তুলে সংরক্ষণ করা যায়। তবে এখানেও কিন্তু আছে -- ক্যামেরার ছবি আর ফোনের ছবিতে বেশ পার্থক্য আছে, বিশেষত কম আলোতে। আমার বেশি পিক্সেল দরকার নাই -- কারণ আমার মনিটর কিংবা প্রেজেন্টেশনে অত রেজুলুশনের ডিসপ্লে থাকে না --- কিন্তু স্পষ্ট ছবির দরকার আছে। যেমন এই মূহুর্তে আমার ল্যাপটপের ডিসপ্লে ১২৮০x৮০০=১০২৪০০০ পিক্সেল অর্থাৎ মাত্র ১.০২ মেগাপিক্সেল। এর চেয়ে বড় ছবি তুললে সেটাকে আসলে এই রেজুলুশনে কমিয়ে নিয়েই দেখতে হবে। আমার পুরাতন ক্যানন পাওয়ার শট দিয়ে যা তোলা যেত সেটাই যথেষ্ট। এখন ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা, ফোনের চেয়ে ভাল অপশন বলে মনে হয়। ঐ টাকা দিয়ে একটা মোটামুটি ভাল ক্যামেরা কেনা যায়, তবে সেই ক্যামেরাটা ফোনের মত সবসময় পকেটে থাকবে না -- এটা ফোনের পক্ষে একটা ভাল পয়েন্ট।
৬। জিপিএস:
স্মার্ট ফোন কেনার ঝোঁকটা উঠেছিলো মূলত এর জিপিএস সুবিধার জন্য। পেশাগত কারণে মাঝে মাঝেই আমাকে জিপিএস (GIS সম্পর্কিত) ব্যবহার করতে হয়। এটা না থাকার কারণে সার্ভেয়ার অন্য কারো সাহায্য ছাড়া বেশ কিছু কাজ করতে পারি না। বিসিএস কম্পিউটার সিটিতে খোঁজ নিয়ে জেনেছি একটা হ্যান্ডহেল্ড জিপিএস মেশিনের দাম ১৩ হাজার টাকার মত। কিন্তু স্মার্ট ফোনের জিপিএসে একই সাথে গুগল আর্থ আর ম্যাপের সুবিধা আছে যা গারমিনের (Garmin) হ্যান্ডহেল্ড জিপিএস মেশিনে নাই। অনেকবার ভেবেছি একটা জিপিএস মেশিনের বিকল্প হিসেবে কমদামের একটা অ্যানড্রয়েড কিনে রাখবো কিন্তু একটু খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি ১৩ হাজারের জিপিএস মেশিনের বদলে কম (৬-১০ হাজার) বা কাছাকাছি দামের স্মার্ট ফোনের জিপিএসগুলো বছরখানেকের বেশি কাজ করে না। তবে, আমার ছোট ভাইয়ের ফোনটার বয়স হচ্ছে -- ও নিয়মিত জিপিএস ব্যবহার করে; এখন পর্যন্ত ওটার পারফর্মেন্স ভাল (দামও অবশ্য সেইরকম)।
৭। অ্যাপস, সার্ভে, অটোক্যাড:
এই অ্যাপসগুলো বেশ কাজের জিনিষ হয়ে উঠে মাঝে মাঝে। একটা অ্যাপ আছে যা দিয়ে কোন বস্তুর দুরত্ব আর উচ্চতা মাপা যায়। এটা আসলে সিম্পল ত্রিকোনমিতি ব্যবহার করে, আর এর সঠিকতা ব্যবহারকারীর দক্ষতার উপর নির্ভর করে। এই জিনিষ মাঝে মাঝে কারো কাজে লাগবে নিশ্চিত ভাবেই। আরেকটা অ্যাপ আছে যেটা দিয়ে অটোক্যাডের ফাইল খুলে এডিট করা যায়। যারা ফিল্ডে কাজ করেন তাঁদের জন্য এটা একটা কাজের অ্যাপ নিঃসন্দেহে। আমার অটোক্যাডের মত দামী সফটওয়্যার ব্যবহারের সামর্থ নাই (প্রায় ৪০০০ ইউএস ডলার দাম) - কাজেই এটা কাজে লাগবে বলে মনে হয় না।
৮। কানেক্টিভিটি:
ইন্টারনেট ইউটিলিটিগুলো তথা আরেক লেভেলের কানেক্টিভিটি স্মার্টফোনগুলোকে অনেকের জন্যই আবশ্যম্ভাবী বস্তুতে পরিণত করেছে। গাড়িতে জ্যামে বসে থাকার সময় পেপার, ফেসবুক, ইমেইল পড়া, ইমেইল বা মেসেজ আসা মাত্র নোটিফিকেশন পাওয়া ইত্যাদি খুব ব্যস্ত মানুষের সময়ের আরো দক্ষ ব্যবহারে সহায়তা করে। ব্যক্তিগত ভাবে নিজেকে অ্যাত ব্যস্ত মনে করি না, আর সাথে সাথে জবাব না দিলে ব্যবসা ছুটে যাবে -- এমন কোনো কাজও আমি করি না; আর সত্যিকথা বলতে কি, কয়েকদিন পেপার না পড়লেও আমার কিছু এসে যায় না। ফেসবুক, ইমেইল দিনে একবার চেক করাই যথেষ্ট -- তারপরেও রাস্তার বা যাত্রাপথটুকু বাদ দিলে বাসা এবং অফিসে সর্বদাই নেট কানেক্টেড থাকি। তাই আলাদা করে কানেক্টিভিটি আমার কাছে কতটুকু কাজে আসবে সেই বিষয়ে সন্দিহান।
কেউ মনে করতে পারেন কানেক্টিভিটি বাড়লে খারাপ কী? ব্যাপার হল, এর জন্য খরচের ব্যাপার জড়িত। সাধারণ ফোনের খরচের পাশাপাশি এখন আবার নেটের বিল দেয়া লাগবে। এজন্য নিশ্চয়ই বাসার মডেম ফেলে দেয়া যাবে না -- ওটার খরচও থাকবে। আমাকে একজন বুদ্ধি দিল যে নেট নেয়ার দরকার নাই, বাসা আর অফিসে ওয়াইফাই থাকলে সেখানে এটা ব্যবহার করা যাবে ফ্রী। আরে বাবা, বাসা আর অফিসে তো নেট আছেই! বরং আবার ওয়াই ফাই রাউটার কিনতে হবে বাসার জন্য!
যা হোক, গতকাল নেটে একটা মজার আর্টিকেল পড়লাম। সেখানে একজন লোক তার আইফোন দূর্ঘটনাবশতঃ ভেঙ্গে যাওয়ার পর ভাবলো এক মাস সাধারণ প্রস্তর যুগের ফোন ব্যবহার করে দেখি তো কেমন লাগে! ঐ লোক সেই স্মার্টফোনের শুরু থেকেই মডেল পরিবর্তন করে করে স্মার্টফোন ব্যবহার করছিল এ্যাতদিন। ওনার কিছু নতুন উপলব্ধি হল -- আপাতত আর স্মার্টফোনে ফেরত যাবেন না বলে ঠিক করেছেন। (http://lifehacker.com/5978637/why-im-glad-my-smartphone-broke)
সবশেষে মনে হয়, ইদানিংকার হাফপ্যান্ট মোল্লা টাইপের হুজুররা আঙ্গুর ফল টক আঙ্গুর ফল টক বলে বলে নিজেরে প্রবোধ দিয়ে হাদিস কোরান ঝাড়ে আর এদিকে আবার ঐশ্বরিয়া নিয়ে হা-হুতাশ মার্কা পোস্ট-স্ট্যাটাস দেয় --- আমার এই লেখাটাও সেই টাইপেরই হয়ে গেল বোধহয়।
(সচলায়তনে প্রকাশিত)
১।
প্রথমবার যখন বসুন্ধরা সিটি শপিংএর নিচের লাউঞ্জে সুবেশী তরুণ তরুণীরা স্যামসাং গ্যালাক্সি নোট-২ ডিসপ্লে করছিলো তখন এর ৬২হাজার টাকা দাম দেখে ভীমড়ি খেয়েছিলাম। তখন টিভিতেও এটার একটা বিজ্ঞাপন দেখাতো। একজন লোক এই ফোনের মধ্যে একটা টাওয়ারের ছবি/স্কেচ এঁকে ফেললো। পরবর্তীতে স্মার্টফোনের আরো অনেক বিজ্ঞাপন দেখেছি -- একজনের বার্থডে, বন্ধু ছবি তুললো। আরেকজন আরেকটা ছবি তুলে এডিট করে মাথায় কি জানি একটা বসিয়ে দিলো -- হৈ হুল্লোড়। আমি জানি যে শখের দাম লাখ টাকা, কিন্তু তাই বলে ছবি তুলে হৈ-হুল্লোড় করার জন্য এ্যাত টাকা! অনেক পরিবারের একমাসের খরচের চেয়ে বেশি, একটা মোটামুটি ভাল মানের ল্যাপটপের চেয়ে বেশি। আমি খেটে খাওয়া মানুষ। প্রতিটা টাকা ইনকাম করতে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয় -- এটা অবশ্য অনেকের জন্যই সত্য। তবে বিজ্ঞাপনে দেখানো ছবি তুলে যাঁরা এডিট করে হৈ-হুল্লোড় করে ওরা নির্ঘাৎ নিজেরা ইনকাম করে না -- এই রকম একটা বয়স শ্রেণীকেই দেখিয়েছে।
২। দাম:
একটা ল্যাপটপ কিনেছিলাম। দাম প্রায় এই ফোনের সমানই। এটা দিয়ে কাজ করে এক বছরের মধ্যেই আমার রেগুলার ইনকামের বাইরে এর দাম উশুল করা ইনকাম যোগ করতে পেরেছি। কিন্তু আমার মাথায় কোনক্রমেই আসছে না যে এই ফোন দিয়ে কিভাবে সেইরকম প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানো সম্ভব। হ্যাঁ আমার ইমিডিয়েট ছোটভাইয়ের একটা এই জিনিষ আছে (পরবর্তীতে দাম কমার পর কেনা) সেটা তাঁর অনেক কাজেও লাগে -- কারণ তাঁকে সবসময় অফিসিয়াল কারণেই অনলাইন কাজের সুপারভাইজার হিসেবে কানেক্টেড থাকতে হত; মোটরসাইকেল চালিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যায়, তাই জিপিএসটাও প্রায়ই কাজে লাগে। এখন স্মার্টফোনের দাম আরও কমে এসেছে - যাকে বলে একেবারে নাগালের মধ্যে। এমনকি নামী মেকারের বেশি দামীগুলোও শূণ্য সুদের ১২ কিস্তিতে কেনা যায় -- অর্থাৎ পকেটে এই মুহুর্তে টাকা না থাকলেও সমস্যা নাই। এইতো সেদিন দোকানে লেটেস্ট গ্যালাক্সি এস ৪ মিনি দেখলাম ৪২,৫০০ টাকা - যা ক্রেডিট কার্ডে ১২ কিস্তিতে কেনা যায়।
৩। মাল্টিমিডিয়া:
এবার আসি মাল্টিমিডিয়া ব্যাপারে। স্মার্ট ফোটগুলোতে মাল্টিমিডিয়া সাপোর্ট যেমন গান, রেডিও শোনা, মুভি দেখা যায় বলে জানি। ব্যক্তিগত ভাবে আমার গান বা রেডিও শোনা অথবা সিনেমা দেখার তেমন কোনো শখ বা অভ্যাস নাই। আমার কোনো এমপিথ্রি প্লেয়ার নাই, কম্পুতে তেমন গান নাই (পাইরেসী এভয়ড করার জন্য), মুভি দেখার টাইম নাই। তার মানে এই না যে এগুলো কী জিনিষ আমি জানি না। এক সময় ওয়াকম্যান, ডিস্কম্যান (জাপান থেকে সবচেয়ে ভাল কোয়ালিটিরটা কিনেছিলাম) বিস্তর চালিয়ে শরীর মনে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী সেই বিষয়ের হরমোনগুলো শেষ। রাস্তায় চলার সময়তো কখনই কানে ওয়াকম্যান দিতাম না -- কারণ চারপাশের শব্দগুলোই আমার কাছে বেশি ইন্টারেস্টিং লেগেছে সর্বদা। মুভি রেন্টালে ১০০০ ইয়েনে ১ সপ্তাহের জন্য ৫ মুভি করে নিয়ে আসতাম; এমনও সময় গেছে রিলিজের পর পরই অনেক বেশি খরচে লর্ড অব দ্যা রিং-এর তিন পর্ব ১ রাতে দেখে ফেরত দিতে হয়েছিলো; বছরে চারবার করে দেশে আসার সময়ে ফ্লাইটগুলো আর লম্বা ট্রানজিট মুভি দেখেই কাটতো। তবে কোনক্রমেই সেগুলো দেখার হার এখনকার পাইরেসি করে নামানো মুভিফ্রিকদের মত ছিল না। ইদানিং হয়তো বছরে গড়ে ১২টা মুভি দেখা হয় -- যার অর্ধেক সিনেপ্লেক্সে আর অর্ধেক মুভি চ্যানেলে। কম্পিউটারে মুভি দেখাটা আমি চরম অপছন্দ করি, কারণ এই যন্ত্রটা আমার কাজের জিনিষ - বিনোদনের জিনিষ নয়। তবে কম্পিউটারে অকাজ খুব একটা কম করি তা নয় -- যেমন এই লেখাটাও কম্পিউটারে বসেই লেখা। মোদ্দা কথা হল একেই মুভি দেখার মত সেরকম নিরবিচ্ছিন্ন অবসর থাকে না, আরেকদিকে আমি কম্পিউটার কিংবা এর চেয়েও ছোট স্ক্রিনে মুভি দেখি না, দেখবো বলেও মনে হয় না - আর এ্যাত মুভি পাব কোথায় (লিগাল)। তাই স্মার্ট ফোনের এই ফীচারটা খুব একটা কাজে লাগবে না। আবার দেখা যাবে, এখানে হয়তো কার্টুন চালিয়ে কাজের সময়ে কন্যা এটা বেদখল করে রেখেছে!
৪। গেমস:
গেমসের কথা মনে পড়লে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। রাতের পর রাত গেম খেলে নির্ঘুম কাটিয়ে পরদিন ক্লাসে গিয়ে ঢুলেছি, আর এখন -- গেম খেলার সময় বের করা ... ... অসম্ভব! আমার ধারণা স্মার্ট ফোনের গেমগুলোই একটা জেনারেশনের কাছে এটাকে জনপ্রিয় করেছে। আমার একেবারে ছোট সহোদর, ১১ বছরের ছোট -- যে কিনা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বিভাগীয় প্রধান - গেম খেলার জন্য তার আর তার বেস্ট হাফের আলাদা মেশিন!! হুমম -- ঐ বয়সে আমিও খেলেছি। গেমের সেই পর্বগুলো পার হয়ে আসা আমার মত আধবুড়ার জন্য যেটা খুব একটা আকর্ষনীয় না।
৫। ক্যামেরা:
হ্যাঁ স্মার্ট ফোনের এই জিনিষটা আমি মিস করি প্রায়ই। পেশাগত কারণেই বিভিন্ন মূহুর্তের ছবি বা ভিডিও ক্লিপ তুলতে ইচ্ছা হয় - যা পরবর্তীতে প্রেজেন্টেশন তৈরীতে কাজে লাগবে। কিন্তু পকেটে ফোন, থুক্কু, ক্যামেরা না থাকায় সেটা হয় না। কিংবা হঠাৎ দেখা একটা তথ্যও ছবি তুলে সংরক্ষণ করা যায়। তবে এখানেও কিন্তু আছে -- ক্যামেরার ছবি আর ফোনের ছবিতে বেশ পার্থক্য আছে, বিশেষত কম আলোতে। আমার বেশি পিক্সেল দরকার নাই -- কারণ আমার মনিটর কিংবা প্রেজেন্টেশনে অত রেজুলুশনের ডিসপ্লে থাকে না --- কিন্তু স্পষ্ট ছবির দরকার আছে। যেমন এই মূহুর্তে আমার ল্যাপটপের ডিসপ্লে ১২৮০x৮০০=১০২৪০০০ পিক্সেল অর্থাৎ মাত্র ১.০২ মেগাপিক্সেল। এর চেয়ে বড় ছবি তুললে সেটাকে আসলে এই রেজুলুশনে কমিয়ে নিয়েই দেখতে হবে। আমার পুরাতন ক্যানন পাওয়ার শট দিয়ে যা তোলা যেত সেটাই যথেষ্ট। এখন ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা, ফোনের চেয়ে ভাল অপশন বলে মনে হয়। ঐ টাকা দিয়ে একটা মোটামুটি ভাল ক্যামেরা কেনা যায়, তবে সেই ক্যামেরাটা ফোনের মত সবসময় পকেটে থাকবে না -- এটা ফোনের পক্ষে একটা ভাল পয়েন্ট।
৬। জিপিএস:
স্মার্ট ফোন কেনার ঝোঁকটা উঠেছিলো মূলত এর জিপিএস সুবিধার জন্য। পেশাগত কারণে মাঝে মাঝেই আমাকে জিপিএস (GIS সম্পর্কিত) ব্যবহার করতে হয়। এটা না থাকার কারণে সার্ভেয়ার অন্য কারো সাহায্য ছাড়া বেশ কিছু কাজ করতে পারি না। বিসিএস কম্পিউটার সিটিতে খোঁজ নিয়ে জেনেছি একটা হ্যান্ডহেল্ড জিপিএস মেশিনের দাম ১৩ হাজার টাকার মত। কিন্তু স্মার্ট ফোনের জিপিএসে একই সাথে গুগল আর্থ আর ম্যাপের সুবিধা আছে যা গারমিনের (Garmin) হ্যান্ডহেল্ড জিপিএস মেশিনে নাই। অনেকবার ভেবেছি একটা জিপিএস মেশিনের বিকল্প হিসেবে কমদামের একটা অ্যানড্রয়েড কিনে রাখবো কিন্তু একটু খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি ১৩ হাজারের জিপিএস মেশিনের বদলে কম (৬-১০ হাজার) বা কাছাকাছি দামের স্মার্ট ফোনের জিপিএসগুলো বছরখানেকের বেশি কাজ করে না। তবে, আমার ছোট ভাইয়ের ফোনটার বয়স হচ্ছে -- ও নিয়মিত জিপিএস ব্যবহার করে; এখন পর্যন্ত ওটার পারফর্মেন্স ভাল (দামও অবশ্য সেইরকম)।
৭। অ্যাপস, সার্ভে, অটোক্যাড:
এই অ্যাপসগুলো বেশ কাজের জিনিষ হয়ে উঠে মাঝে মাঝে। একটা অ্যাপ আছে যা দিয়ে কোন বস্তুর দুরত্ব আর উচ্চতা মাপা যায়। এটা আসলে সিম্পল ত্রিকোনমিতি ব্যবহার করে, আর এর সঠিকতা ব্যবহারকারীর দক্ষতার উপর নির্ভর করে। এই জিনিষ মাঝে মাঝে কারো কাজে লাগবে নিশ্চিত ভাবেই। আরেকটা অ্যাপ আছে যেটা দিয়ে অটোক্যাডের ফাইল খুলে এডিট করা যায়। যারা ফিল্ডে কাজ করেন তাঁদের জন্য এটা একটা কাজের অ্যাপ নিঃসন্দেহে। আমার অটোক্যাডের মত দামী সফটওয়্যার ব্যবহারের সামর্থ নাই (প্রায় ৪০০০ ইউএস ডলার দাম) - কাজেই এটা কাজে লাগবে বলে মনে হয় না।
৮। কানেক্টিভিটি:
ইন্টারনেট ইউটিলিটিগুলো তথা আরেক লেভেলের কানেক্টিভিটি স্মার্টফোনগুলোকে অনেকের জন্যই আবশ্যম্ভাবী বস্তুতে পরিণত করেছে। গাড়িতে জ্যামে বসে থাকার সময় পেপার, ফেসবুক, ইমেইল পড়া, ইমেইল বা মেসেজ আসা মাত্র নোটিফিকেশন পাওয়া ইত্যাদি খুব ব্যস্ত মানুষের সময়ের আরো দক্ষ ব্যবহারে সহায়তা করে। ব্যক্তিগত ভাবে নিজেকে অ্যাত ব্যস্ত মনে করি না, আর সাথে সাথে জবাব না দিলে ব্যবসা ছুটে যাবে -- এমন কোনো কাজও আমি করি না; আর সত্যিকথা বলতে কি, কয়েকদিন পেপার না পড়লেও আমার কিছু এসে যায় না। ফেসবুক, ইমেইল দিনে একবার চেক করাই যথেষ্ট -- তারপরেও রাস্তার বা যাত্রাপথটুকু বাদ দিলে বাসা এবং অফিসে সর্বদাই নেট কানেক্টেড থাকি। তাই আলাদা করে কানেক্টিভিটি আমার কাছে কতটুকু কাজে আসবে সেই বিষয়ে সন্দিহান।
কেউ মনে করতে পারেন কানেক্টিভিটি বাড়লে খারাপ কী? ব্যাপার হল, এর জন্য খরচের ব্যাপার জড়িত। সাধারণ ফোনের খরচের পাশাপাশি এখন আবার নেটের বিল দেয়া লাগবে। এজন্য নিশ্চয়ই বাসার মডেম ফেলে দেয়া যাবে না -- ওটার খরচও থাকবে। আমাকে একজন বুদ্ধি দিল যে নেট নেয়ার দরকার নাই, বাসা আর অফিসে ওয়াইফাই থাকলে সেখানে এটা ব্যবহার করা যাবে ফ্রী। আরে বাবা, বাসা আর অফিসে তো নেট আছেই! বরং আবার ওয়াই ফাই রাউটার কিনতে হবে বাসার জন্য!
যা হোক, গতকাল নেটে একটা মজার আর্টিকেল পড়লাম। সেখানে একজন লোক তার আইফোন দূর্ঘটনাবশতঃ ভেঙ্গে যাওয়ার পর ভাবলো এক মাস সাধারণ প্রস্তর যুগের ফোন ব্যবহার করে দেখি তো কেমন লাগে! ঐ লোক সেই স্মার্টফোনের শুরু থেকেই মডেল পরিবর্তন করে করে স্মার্টফোন ব্যবহার করছিল এ্যাতদিন। ওনার কিছু নতুন উপলব্ধি হল -- আপাতত আর স্মার্টফোনে ফেরত যাবেন না বলে ঠিক করেছেন। (http://lifehacker.com/5978637/why-im-glad-my-smartphone-broke)
সবশেষে মনে হয়, ইদানিংকার হাফপ্যান্ট মোল্লা টাইপের হুজুররা আঙ্গুর ফল টক আঙ্গুর ফল টক বলে বলে নিজেরে প্রবোধ দিয়ে হাদিস কোরান ঝাড়ে আর এদিকে আবার ঐশ্বরিয়া নিয়ে হা-হুতাশ মার্কা পোস্ট-স্ট্যাটাস দেয় --- আমার এই লেখাটাও সেই টাইপেরই হয়ে গেল বোধহয়।
(সচলায়তনে প্রকাশিত)
৩টি মন্তব্য:
অনেক ধন্যবাদ ! বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে অনেক সময় বিলাসিতার স্রোতে গা ভাসানো ছাড়া এ অন্য কিছু নয় !
Tender business bangladesh dhaka bid auction purchase sales bangla.
স্মার্ট ফোন দরকার নেই সেটা বললে ভুল হবে। আধুনিক যুগের সাথে তাল মেলাতে এটা দরকার তবে কেউ কেউ এর সুবিধা ব্যাবহার করে অপরাধ করছে এটাও অস্বীকার করা মুশকিল। :)
প্রযুক্তির গুরুত্ব অস্বীকার করা যাবে না। সবকিছুর ভালো খারাপ দিক থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন