ন্যাড়া পাহাড়, উপত্যকার মাঝে মাঝে সবুজ ছোপের লোকালয়
দেখলে মনে হয় মাটি ফুঁড়ে কাঁত হয়ে বের হয়ে এসেছে
কোনোদিন হয়ত ঐ দুরের বরফের নদীর কাছে যাওয়ার সুযোগ হবে না
এখানেও ঝুলন্ত সেতু!
দুরের ঐ গ্রামের নাম কাগবেনী। এটা উত্তর ও দক্ষিন জমসমের যোগাযোগের কৌশলগতভাবে একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এই সরু জায়গাটা ছাড়া এপাশ থেকে ওপাশে (তিব্বত বর্ডার) যাওয়া আসার আর কোনো পথ নাই।
কাগবেনী দেখে খুব একটা কিছু মনে হয় নাই। যদিও এটা ঐতিহাসিকভাবে, কৌশলগত, অবস্থানগত এবং ধর্মীয় দৃ্ষ্টিকোন থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই জায়গা নিয়ে মুভিও তৈরী হয়েছে বলে উইকিতে পড়েছি।
কাগবেনী
বামে পেছনের ঐ পাহাড় বিদেশীদের জন্য যাওয়া নিষেধ। ধর্মীয় বিষয়। প্রচন্ড বাতাস এইখানে।
উপত্যকাটির উত্তর আর দক্ষিনের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়েছে এই সরু অংশ দিয়ে।
প্রচন্ড বাতাসে এই সেতুর উপরে ছবি তোলা। সেতুর ঐ পাশে যাওয়া নিষেধ।
কাগবেনী সেলফী পয়েন্ট নামে একটা জায়গা পাহাড়ের উঁচুতে মুক্তিনাথের পথে (যেটাতে প্রবেশ করতে ২০ রুপী খরচ করতে হয়) তবে এর বাউন্ডারী দেয়ালের ভেতরে টয়লেট আর দোকানও রয়েছে। চা-চিপস টাইপের জিনিষপাতি পাওয়া যায়। ঘোড়ায় চড়া যায়। এখানে থেকে নিচের কাগবেনী এবং আশে পাশের জায়গার দূর্ধর্ষ একটা দৃশ্য দেখা যায়।
কাগবেনী সেলফি পয়েন্টের সামনে। পুরা নেপালে সবচেয়ে জোরে বাতাস পেয়েছি এখনে। ভৌগলিক কারণেই এখানে বাতাস
নিচে কাগবেনী দেখা যাচ্ছে। সাহস করে কিনারায় গিয়ে ছবি তুলতে পারিনি। তবে ভয়ের কারণ উচ্চতা নয়; মনে হচ্ছিল প্রচন্ড বাতাসে হাত থেকে ক্যামেরা উড়িয়ে নিয়ে যাবে। ডানদিকের ঐপাশে খাড়া অংশগুলো হয়তো গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মত দেখতে।
দুরে নিচের দিকে যে রেখাগুলো দেখা যাচ্ছে ওগুলো রাস্তা। মাঝে মৃদূ ঢালের মত জায়গার ঠিক মাঝখানে একটা খাড়া ফাঁটল দেখা যাচ্ছে যেটা সম্ভবত একটা নদী - এটার ছবি তুলে রাখলাম প্রচন্ড কৌতুহল থেকে।
পরে অবশ্য গুগল ম্যাপের স্যাটেলাইট ইমেজ থেকে জায়গাটা খাড়া উপর থেকেও দেখা যায়
দুরে ভেড়ার পাল দেখা যাচ্ছে। এই পথটা মৃদূ ঢাল হলেও বামে অনেক নিচু। তবে সামনের ক্লিপের মত বাঁকটা ঘুরে একটু আগালেই লোকালয়। মুক্তিনাথ খুব কাছে - ২০~২৫ মিনিটের পথ গাড়িতে।
খাড়া পাহাড় আর টেবলটপ পাহাড় দেখা যাচ্ছে। এদিকেই তিব্বত - আরো ১০০ কিলোমিটার উত্তরে।
অবশেষে মুক্তিনাথে পৌছালাম। তবে এখানে গাড়িটাকে ছোট্ট পাড়ার মত শহরের বাইরে এক জায়গায় রেখে ১০ মিনিট হেঁটে আসতে হয়েছে। কারণ মেইন রাস্তায় আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেনেজ পাইপ বসানো হচ্ছে (তখন অবশ্য সেটা জানতাম না)। বিকল্প যেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলাম সেটা ধুলা-ধুসরিত, তাই সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৬টা পর্যন্ত ওপথে গাড়ি চলাচল করে না। ঠিক করা হল, ৬টার পর গাড়ি মূল লাগেজ সহ আসবে, আর আমরা এখন হোটেলে চেক ইন করে ফেলবো। হালকা হ্যান্ড লাগেজ নিয়ে হেঁটে আসতে হাপিয়ে গিয়েছিলাম রীতিমত -- তবে পরে বুঝেছি সেটা ছিল উচ্চতায় অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে - হাইপোক্সিয়া বলে এরকম সমস্যা হলে। এই জায়গার উচ্চতা ৩৭০০ মিটারের বেশি।
খাওয়া দাওয়া শেষে একটু হেঁটে দেখতে বের হলাম। হোটেল থেকে বের হয়ে ৫ মিনিট হাঁটলেই মুক্তিনাথ মন্দিরে ওঠার এই গেটের দেখা পাওয়া যায়।
ভর সন্ধ্যায় পাহাড়ে আলো ছায়ার খেলা
আমাদের হোটেলের নাম হোটেল গ্র্যান্ড শাম্বালা। ভেতরের আয়োজন খুবই সাধারণ। যতটুকু না হলেই নয়। এটা একটা তীর্থস্থান, আর তীর্থযাত্রীদের কথা মাথায় রেখেই এগুলো বানিয়েছে - আমাদের মত টুরিস্টের জন্য নয়।
২৭-জুন-২০২৩
ভোরবেলা উঠে রুমের জানালা থেকে এমন দৃশ্য দেখা গেল। অসাধারণ ভিউ কিন্তু মাঝে অপরিকল্পিত বিল্ডিং থাকাতে সেই ভিউটার বারটা বাজিয়ে দিয়েছে। দৃশ্যের একেবারে বামের চূড়াটার নাম ধউলাগিরি, উচ্চতা ৮১৬৭ মিটার!
নিচে যেই সাদা মেঘগুলো দেখা যাচ্ছে সেগুলো একটু পরেই ঘুম ভেঙ্গে উঠে চুড়াগুলোকে ঢেকে ফেলবে ...
সত্যি আমাদের রুমের জানালার দৃশ্য ওগুলো। তবে জানালার গ্লাস খুলে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ঐ ছবিগুলো তুলতে হয়েছে।
হোটেল গ্রান্ড শাম্বালা'র সকালের নাস্তা
এইবার সপরিবারে মুক্তিনাথ মন্দিরে যাত্রা। দুরের ঐ বাড়িঘরগুলোর মাঝেই আমাদের হোটেল। মাঝ বরাবর একটু বামে ধউলাগিরির চূড়াটা (৮১৬৭ মিটার) সাদা মেঘের উপরে দেখা যাচ্ছে। আমরা ইতিমধ্যেই দুই তৃতীয়াংশ সিড়ি বেয়ে উঠে পড়েছি। অক্সিজেন স্বল্পতা ভালভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। সিড়িগুলোও তিন ধাপ পর পর বিশ্রামের জায়গা নিয়ে তৈরী করা হচ্ছে (রেলিংএর কাজ চলছিল)।
কিন্তু ভেতরে প্রবেশের পরও সিড়ি আর শেষ হয় না। তবে বেশ সবুজ চারপাশ। মনে হয় রিভেন্ডেলে (Rivendell) এসেছি। এটাতেও চমৎকার পানির প্রবহমান ঝরনা রয়েছে মন্দিরের ভেতর দিয়েই।
মন্দির থেকে অদুরেই শাক্যমূনী বৌদ্ধমূর্তি। যেন এখানে বসে সামনের অসাধারণ দৃশ্য দেখছেন।
ফেরার পথে আমাদের নেপালী ট্যূর অপারেটরের সাথে দেখা হয়ে গেল। উনারা এখন উঠতেছিলেন। আমরা নেমে গাড়ি নিয়ে ফেরত যাব।
এই দম্পতি সেই কাঠমুন্ডু থেকেই আমাদের সাথে সাথে ঘুরছেন। মানে একই পথে কিন্তু আলাদা গাড়িতে, আলাদা আলাদা জায়গায় - আশেপাশেই। রাতে রাতে কিংবা ব্রেকফাস্টের সময়ে দেখা হয়। গতকাল ওনাদের টার্গেট ছিল কাগবেনী থেকে আপার-মুসতাংএ ৫৫০০ মিটার উচ্চতায় যাবেন। কিন্তু পথে সন্ধ্যাবেলায় চা খেতে থেমে উনি টের পেলেন যে কাপ ধরতে গিয়ে ওনার হাত কাঁপছে। তাই হাইপোক্সিয়া (অক্সিজেনের অভাবজনিত লক্ষণ) হওয়ার আশংকায় তখনই গাড়ি ঘুরিয়ে আবার মুক্তিনাথে চলে এসেছেন রাত প্রায় সাড়ে দশটায়।
গতকাল এখানে আসার আগে পরিকল্পনা ছিল মুক্তিনাথে ২ রাত থাকবো। কিন্তু বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে এখানে বেশি সময় থাকার সাহস হল না - কারণ উচ্চতায় বাতাসে অক্সিজেন স্বল্পতা। তাছাড়া এখানে দেখার মতও আর কোনো জায়গা নাই। এদিকে ড্রাইভার সাহেবও বলছেন পথে ল্যান্ডস্লাইডের ঝুঁকি আছে, তাই আজকেই যতদুর পারি এগিয়ে রাতটা তাতোপানি নামক জায়গায় থাকা যায়। এতে ল্যান্ডস্লাইডে রাস্তা আটকে যাওয়ার অর্ধেক ঝুঁকি এড়ানো যাবে। ভিডিও নিচে:
ভিডিও #৬
ফেরত যাওয়া শুরু হল। তবে ভ্রমণের আনন্দ এখনও অনেক বাকী। সবগুলো প্রকাশিত পর্বের লিংক এই পাতার একেবারে শুরুতে দেয়া আছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন