শ্রোতার বিবর্তন
এখন দেশ থেকে দুরে থাকি। দেশের গান টাটকা শুনতে পারি না, আর জানিওনা যে কোন কোন নতুন গায়ক/গায়িকা/ব্যান্ড আসছে, ঝড় তুলছে। ভরসা ইন্টারনেট। তাছাড়া গত ৩ বছরে প্রায় ১২ বার দেশে গিয়েছি গবেষণার স্যাম্পলিং এর কাজে, প্রতিবারই কিছু এম.পি.থ্রী বা ভিডিও সিডি/ডিভিডি নিয়ে এসেছি। আরও এনেছি বেশ কিছু ক্যাসেট - যে গাড়ীটা ব্যবহার করি, ওটা বেশ পুরানো মডেল। শুধু ক্যাসেট প্লেয়ার আছে। এখন অবশ্য সিডি প্লেয়ার থেকে সেখানে গান বাজানোর একটা সিস্টেম করেছি। তাই গানের প্রবল অভাব অনুভব করি না।
বিবর্তন বলতে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন বুঝায়। আমি শ্রোতা হিসেবে আমার পছন্দের বিবর্তনকে ক্রোনোলজিকাল অর্ডারে দিলাম।
আম্মার কাছে গল্প শুনেছি... যখন গ্যাদা বাচ্চা ছিলাম তখন নাকি সেজ চাচা রেডিওতে গান ছেড়ে দিয়ে আমার সামনে এসে লিপসিং করত। আমি হা করে দেখতাম। হয়ত ভাবতাম, আহারে এই লোকটা কত ভাল গান গায় ..... ...
যখন বেশ ছোট ছিলাম: প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম তখন বাসায় গান শুনতো ছোটচাচা। বিভিন্ন রকম হিন্দি গান, নজরুল আর রবীন্দ্র আর অাধুনিক। ওনার গলায় গান শুনে নিজেরও ওভাবে গাইতে ইচ্ছা করত। তখন শুনতাম: আমি চিনি গো চিনি তোমারে....; আমি দুর হতে তোমারে দেখেছি ইত্যাদি গান। ভূপেন হাজারিকা'র গানও ভাল লাগত শুনতে। আবার হেমন্তের ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে... মুখস্থ ছিল।
হাইস্কুলের শেষের দিক ছিল ব্যান্ডের যুগ। ঈদের সালামি দিয়ে শুধু ক্যাসেট কিনতাম ..... চাইম, ফীডব্যাক, উইনিং, ডিফরেন্ট টাচ, অবসকিওর শুনতাম খুব। তারপর হলাম এল.আর.বি'র ভক্ত। সাথে সাথে ইংলিশ রক শুনতাম খুব। তবে সেটার সোর্স ছিল প্রতিদিন দুপুরে রেডিওর ওয়র্ল্ড মিউজিক অনুষ্ঠানটি। দুইটা সিনেমার ট্রেইলার শুনে ওয়র্ল্ড মিউজিক মিস করতাম না বাসায় থাকলে। মূলতঃ সেখান থেকেই বিভিন্ন বিদেশী শিল্পীর গান পছন্দ করা শুরু করলাম।
আব্বার ঝোক ছিল মারেফতি বিষয়ের প্রতি। তাই উনি গিয়ারে থাকলে, ক্যাসেটপ্লেয়ার ফ্রী-পাওয়া যেত না। তখন লালণগীতি এবং অন্যান্য বাউল সংগীত খুব বাজত বাসায়। আবার কখনো ডেকে জোর করে তা শুনানো হত। আশেপাশে শেয়ার করার কাউকে না পেয়ে লালণগীতির মর্মকথা আমাকেই ব্যাখ্যা করে শুনাতো। আমি আব্বার মন রক্ষার্থে সেসব চিরতার পানির মত গিলতাম। অবস্থা এমন দাড়িয়েছিলো যে, মনে লালনগীতি ভীতি ঢুকে গিয়েছিলো। স্কুল থেকে বা খেলা শেষে বাসায় ফেরার সময় দুর থেকে লালন বা বাউল বাজতে শুনলেই, বাসায় ঢোকার সময় বেড়ালের মত নিঃশব্দে ঢুকে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে বাইরে ভেগে যেতাম! বা চুপে চুপে থাকতাম বাসায়।
১৯৯০ সালে এস.এস.সি. পাশ করলাম। এরপর নটরডেম কলেজে ভর্তি হলাম। বাসা মিরপুর ১১তে। প্রতিদিন বাসা টু কলেজ আসা যাওয়া করে আর কলেজের পড়ার চাপে সব সময় আর গান শোনার শক্তি থাকত না। তারপরেও যাওয়া আসার পথে গুলিস্থানের স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে ক্যাসেট কিনেছি মাঝে মাঝে। রেডিওর ওয়র্লড মিউজিকে গান শুনেছিলাম, তাই কিনলাম Def Leppard ব্যান্ডের একটা ক্যাসেট। ভাল কোয়ালিটির ক্যাসেট বলে দাম নিল ৯০ টাকা, যেখানে সাধারণ ক্যাসেটের দাম ছিল ৩৫-৪০ টাকা। গান শুনে তো মুগ্ধ। এরপর একে একে Iron Maiden, Metallica, AC DC কিনলাম। তাছাড়া অন্যান্য পুরানো হেভী মেটাল ব্যান্ডের গানও শুনতাম। পাশাপাশি Rap শুনতেও খারাপ লাগত না তেমন --- তবে সেই ভাল লাগা খুব বেশি স্থায়ী হয়নি; এটা মাঝে মাঝে শুনতে ভালই লাগে।
এরপর বুয়েট লাইফ.... সেখানেও হেভী মেটাল, হার্ড রক। গীটার শেখার চেষ্টা করলাম একবার। ৩ মাস নীলয় দাসের ওখানে ক্লাসও করলাম। তারপর ভাগারাম। ৩য় বর্ষের শেষের দিকে আর ৪র্থ বর্ষে আস্তে আস্তে আবার মান্না দে, কিশোর .. এদের গান শুনা শুরু করলাম। যদিও হেভী মেটাল ভক্তদের ওসব প্যানপ্যানানি ভাল লাগার কথা না, আমার কাহিনীটা একটু অন্যরকম। রূমমেট ও ব্যাচমেট ও ক্লাশমেট আবীর শুনত ঐ গানগুলো। শুনতে শুনতে দেখলাম আমারও ভাল লাগতে শুরু করল। আফটার অল ছোটকালে আমার ছোটচাচাও এই গানগুলো শুনতেন। তাই হয়ত পাশ করার পর প্রেমে পড়তে মন চাইল, চাকরী পেলাম। বিয়ে করলাম।
বিয়ের পর গানের জগতে আরো কিছু যোগ হল। জাগজিৎ সিং-এর গজল; প্রথম দিকে ভাল লাগত না... এখন মন্দ লাগে না। বউয়ের পছন্দে বাপ্পার গান শুনলাম। শুনেই তো হিট ..... আসলে এর আগে টিভিতে দলছুট ব্যান্ডটার পারফর্মেন্স দেখে খুব ভাল লেগেছিল। তাই দলছুটের ভোকালিস্ট দেখে একটা আকর্ষন তো ছিলই। এখন আমি বাপ্পার গানের একজন ভক্ত। তাছাড়া কুমার বিশ্বজিতের গানও এভাবে ভাল লাগায় স্থান করে নিল। রেঁনেঁসা ব্যান্ডটা সবসময়ই ভাল লাগত - বলা হয় নি আগে।
এখন বয়স বাড়ার সাথে সাথে মনের চাহিদা পরিবর্তন হচ্ছে... তাই পছন্দের গানের ব্যাপ্তিও বেড়ে যাচ্ছে। কিছু গান ভাল লাগে মিউজিক কম্পোজিশনের জন্য। কিছু গান ভাল লাগে কথার জন্য। তবে কোন একটা গান ভাল লাগার পেছনে আমার মনে হয় মনের অবস্থাটা সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে। এখানে উল্লেখিত শিল্পী/ব্যান্ড ছাড়াও আরো অনেক গানই আমার পছন্দ; সবগুলো পছন্দ হয়ত লেখাতে আসেনি। এ পর্যন্তই........
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন