বুধবার, ১১ এপ্রিল, ২০০৭

সুইজারল্যান্ডের এক কোনা ভ্রমনের বিশাল অভিজ্ঞতাঃ পর্ব-৩ (যাত্রা হল শুরু)

(....পূর্বের পর্ব হতে চলমান)

কোনরকম ঝুট ঝামেলা ছাড়াই চেক ইন করলাম। আমার ফ্লাইট ছিল বিমানে ঢাকা থেকে মুম্বাই, তারপর ৫ ঘন্টা ট্রানজিট, আর তারপর সুইস এয়ারে মুম্বাই থেকে যুরিখ। ঝামেলা পাকাল ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ। অযথা হয়রানী করল, ঘুষ দাবী করল। এটা আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ .... ভয় পাইছিলাম; ঘুষ দিলাম, সাথে দিলাম একগাদা গালাগালি (মনে মনে অবশ্য)। পরের ছোট্ট ঝামেলা স্টীলের কাটাচামচ .... ঐটা ফেলে দিতে হল বোর্ডিঙের সিকিউরিটি চেকিঙের সময়।

প্লেন টেক অফ করার সময় তো অবস্থা যায় যায় .... ... প্রথমেই দেখাল কিভাবে সীট বেল্ট বাঁধতে হয়, তারপর জরুরী অবস্থায় করণীয় – ভয় লাগা শুরু করল..... এ্যাত কিছু দেখাইতেছে কেন? বিপদ কি আবশ্যম্ভাবী? তারপর টেকঅফের জন্য বাতি নিভায় দিল; আশেপাশের সহযাত্রীরা দেখলাম বিকারহীন; ওনাদের দেখে মনে সাহস নিয়ে বসে থাকলাম। রানওয়ের মাথা থেকে যখন ছিলা মুক্ত তীরের মত ছুটা শুরু করল প্লেনটা তখন যে কিরকম অনুভুতি হয়েছিল বোঝানো মুশকিল ..... প্রথমবার রোলার কোস্টারে চড়ার মত (তখনো একবারও চড়িনি)।

বিমানে কি যে খাওয়াইছিল মনে নাই এখন। তবে যে জিনিসটা অবাক করেছিল সেটা হল সীটের সাইজ .... তেমন একটা আরামদায়ক না ... টিভি বিজ্ঞাপনগুলাতে যেরকম দেখায় তার সাথে মিল নাই একটুও! তাছাড়া আছে গোঁ গোঁ বিরক্তিকর একটা শব্দ। জানালা দিয়ে বাইরে কেমন দেখায় দেখতে খুব ইচ্ছা করছিল কিন্তু আমার সীটটা ছিল মাঝের দিকে.... জানালা থেকে অনেক দুরে।

সময়মত মুম্বাই পৌছালাম। ল্যান্ড করার সময় আরেকবার আতঙ্কিত হলাম। প্লেন থেকে নেমে বোর্ডিং ব্রীজ থেকে করিডোরে পা রাখা মাত্র দেখলাম একজন সুন্দরী এয়ারপোর্ট স্টাফ সুইস এয়ার সুইস এয়ার বলে ডাকছে .... মিরপুর, গুলিস্থান বাসের হেলপার/ কন্ডাকটরদের সাথে এর কোন তুলনা চলে না। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম যে, আমি সুইস এয়ারের যাত্রী। আমাকে বলল ওনাকে ফলো করতে .... আর জিজ্ঞেস করে জানলাম আমিই একমাত্র যাত্রী বিমান থেকে সুইস এয়ারে যাব – আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম এই আশায় যে কোন দেশী সহযাত্রী পাইলে একটু ভাল লাগত এই আশায়। যা হোক ঐ মহিলাকে দেখে অন্ততপক্ষে এটুকু আশ্বস্ত হলাম যে, আমি একেবারে অবহেলিত না । এখন বুঝতেছি যে, এয়ার টিকিট আনার সময় আমার আনকোরা পাসপোর্ট দেখে সুইস এয়ারের ট্রাভেল এজেন্ট “সাহায্য দরকার, প্রথমবার আকাশপথে ভ্রমনকারীঁ” - এ ধরনের একটা অনুরোধ করে রেখেছিলেন।

এয়ারপোর্ট স্টাফের সাথে একটা লম্বা করিডোর দিয়ে হেটে চলছি তো চলছিই..... বামপাশে গ্লাস প্যানেল, প্লেন, রানওয়ে আর অন্যান্য জিনিস দেখা যাচ্ছে, আর ডান পাশে দেয়াল। হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যাথা হয়ে গেল ........... শেষ পর্যন্ত ট্রানজিট লাউঞ্জ নামক একটা জায়গায় এসে পৌছালাম। ওখানের ট্রান্সফার ডেস্কের স্টাফকে গিয়ে এই মহিলা স্টাফ কি জানি বলল; আমার হাতে একটা খাওয়ার কুপন ধরায় দিয়ে বলল রাত ৮টা থেকে ১১টার (?) মধ্যে পাশের রেস্টুরেন্ট থেকে ডিনার করে নিতে আর সময়মত পরবর্তী প্লেনে চড়তে। তারপর এ্যাতবড় লাউঞ্জে যাত্রী হিসেবে আমি একা - আর ট্রান্সফার ডেস্কে একজন কর্মকর্তা ।

৫ ঘন্টা যাত্রাবিরতি ছিল .... .... তার মধ্যে ঐ রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে এসেছি (যতদুর মনে পড়ে, বুফে সিস্টেম ছিল).... ... বাকী সময়টা যে কি বিরক্ত লাগছিল: বলার মত না। যা হোক, নির্দিষ্ট সময়ে পরবর্তী প্লেনে চড়লাম। এবারও সীট মাঝখানের দিকে তবে চলাচলের রাস্তার সাথে (আইল সিট)। আগেরটা ছিল ৩ কি সাড়ে ৩ ঘন্টার যাত্রা.... আর এটা সম্ভবত ৭ ঘন্টার। কি যে বিরক্তিকর। একে তো সীট আটোঁসাটো, গোঁ গোঁ শব্দ (ফ্লাই এমিরেটস-এর বিজ্ঞাপনওয়ালারা যে কি বিরাট মিথ্যূক!) তার উপর গোদের উপর বিষফোঁড়া হিসেবে খারাপ আবহাওয়া, টার্বুলেন্স .... .... মনে হল ঢাকা-উত্তরবঙ্গের বাসও এত ঝাকায় না (সীটও এর চেয়ে আরামের)-- শালার প্লেন ভ্রমন! আধো অন্ধকারে দেখলাম কেউ কেউ এর মধ্যে ঘুমাচ্ছে ... .... আমি মাঝে মাঝে হাটছি, একটা বন্ধ এক্সিট দরজার সামনে দাড়িয়ে, মাঝখানের জানালার মত জায়গা দিয়ে বাইরেটা দেখছি মাঝে মাঝে। আকাশের উপরটা অদ্ভুদ রকম মায়াবী। প্লেনের নীচে বিরাট একটা মেঘের সমুদ্র, উপরে চাঁদ, চারিদিকে জোৎস্না।

আরো কিছু পরে ঝাকুনি থেমে গেল, কিন্তু বিরক্তিকর শব্দটা থামল না। সামনের একটা স্ক্রীনে প্লেনের যাত্রাপথের মানচিত্র, আর তার মাঝে আমাদের অবস্থান জানান দিচ্ছে। একসময় খেয়াল করলাম ইরানের উপর দিয়ে যাচ্ছি, নীচে পাহাড়। কৌতুহলি হয়ে গেলাম সেই জানালায় (এক্সিট ডোর)। আবার বিমোহিত হলাম: পরিষ্কার আকাশের নীচে চাঁদের আলোয় প্লাবিত প্রান্তর.... ... ধুসর লালচে (রাতে কেন যে লালচে দেখাচ্ছিল কে জানে) ন্যাড়া পাহাড়ী অঞ্চল দেখা যাচ্ছে। ধারনা ছিল পাহাড় হলে তো জঙ্গল থাকবে; কিন্তু এটা ন্যাড়া দেখাচ্ছে কেন? মনের মধ্যে যুক্তি হাতড়াচ্ছিলাম... .... একেই তো রাত, আসল রঙ যে সবুজ না তা নিশ্চিত করে বোঝা সম্ভব না, তার উপর প্লেন উড়ছে প্রায় ১০ কি.মি. উচ্চতায় ... হতে পারে এটা কি আফগানিস্থান বা তার আশেপাশে; কারণ, র‌্যাম্বো সিনেমার একটা পর্বে আফগানিস্থানের রূক্ষ প্রান্তর আর ন্যাড়া পাহাড় দেখাইছিল... আর ইরান তো আফগানিস্থানের পাশেই; কাজেই ন্যাড়া হওয়া অসম্ভব নয় --- কতক্ষন দাড়িয়ে দেখেছি জানি না, কিন্তু পাহাড়ী অঞ্চল আর শেষ হল না। ... ... প্লেন কি এ্যাত আস্তে চলে... তাই হবে হয়ত, আকাশের মাঝে ছোট ছোট প্লেন তো আস্তেই যেতে দেখি!! আবার এসে বসলাম... ... একসময় মনে হয় তন্দ্রা মত এসেছিল।


(.... চলবে)

কোন মন্তব্য নেই: