শুক্রবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০০৯

হঠাৎ লিনাক্স নিয়ে পড়লাম কেন!

কেউ কেউ আমার ইদানিং লিনাক্সে মাখামাখি দেখে বিরক্ত হতে পারেন। তাই একটু নিজের অবস্থান পরিষ্কার করার জন্য এই ব্লগর ব্লগর। তবে বলে রাখা ভাল যে একজন নন-টেকি সাধারণ ব্যবহারকারী হিসেবে এইটা একটা অন্ধের হাতি দর্শন টাইপ লেখা।

১.
২১তম বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে গণপূর্ততে যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন ওটা ছেড়ে মাস্টারি করি। প্রধাণ কারণ - অর্থ উপার্জনের জন্য ন্যায়সঙ্গত ভাবে এবং নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার রাস্তা যেখানে খোলা আছে সেখানে অন্যায় পথে আত্মা বিক্রি করার কোনো কারণ দেখি না। ন্যায়সঙ্গত ভাবেই সরকারী বেতনের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বেতন পাই এখানে। একমাত্র কারণ না হলেও প্রায় একই রকম কারণে লিনাক্স ব্যবহার করি: যেখানে ন্যায়সঙ্গত পথে সমস্ত সুবিধাসহ কম্পিউটিং করা যায় সেখানে পাইরেটেড উইন্ডোজ ব্যবহারের কোনো কারণ দেখি না। পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহারে নিজের অজান্তেই মনের গভীরে চৌর্যবৃত্তির গ্লানি প্রবেশ করে মাথা উঁচু করে কথা বলার ক্ষমতা কমে যায়।

২.
কেউ যদি আপনাকে কিছু অন্যায় সুবিধা দেয় তাহলে তাঁদের অন্যায় আব্দারও রাখতে হয়। সুবিধাদাতার অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কন্ঠ মিইয়ে আসে। একই ব্যাপার ঘটে পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহার করলে। আর এই ধরণের মাথা নীচু করা মানসিকতার কারণেই বাইরের শোষক দেশগুলো আমাদের কাছে থেকে অন্যায়ভাবে সম্পদ শোষণ করার সুযোগ পাচ্ছে।

ব্যাপারটা নতুন কিছু না - কোন দলকে কব্জা করতে হলে তাঁদের মধ্যে হীনমন্যতা ঢুকিয়ে দিতে হয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে (ক্রিকেট ইত্যাদি) আসা সাংবাদিকগণ যখন মজা করে বলে যে এখানে সমস্ত সফটওয়্যার সিডি এক ডলারের কম দামে পাওয়া যায় তখন স্বাভাবিকভাবেই লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসে। সুন্দরভাবে হীনমন্যতা চলে আসে -- ফলে অনেকের অনেক অন্যায় আব্দারের প্রতিবাদ করা যায় না।

ব্যক্তিগত ভাবে পাইরেসী ত্যাগ করার পর থেকে মানসিকভাবে শান্তিতে আছি। হীনমন্যতাগুলো খোঁচায় না।

৩.
মানসিক ঐ শান্তি ছাড়াও অপর শান্তি হল কম্পিউটার ভাইরাস মুক্ত থাকার আনন্দ। অন্যেরা চারপাশে ভাইরাসে নাকানি চুবানি খাচ্ছে, আর আমি নিশ্চিন্তে আছি - ব্যাপারটা খুব এনজয় করা যায় (নিষ্ঠুরতার জিনিষটায় মানুষ কেন জানি আনন্দ পায়!)। এমন সময়গুলোতে লিনাক্সের বুট সিডি দিয়ে কলিগদের পিসিগুলো বুট করে ভাইরাসগুলোকে মুছে দেই। এতে কিছুটা উপকার হয়। আর, জরুরী ফাইলগুলো পেনড্রাইভে নিয়ে নেয়। কারণ, আই.টি. সেকশনে অভিযোগ করলে ওদের সহজ সমাধান - ফরম্যাট করে ফ্রেশ ইনস্টল!!

এখানে কয়েকজন আই.টি. নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সচল আছেন। লিনাক্সে ভাইরাসের বেইল নাই কেন - এই ব্যাপারে ওনারা ভাল বলতে পারবেন। (ভুট্টাক্ষেতের পাহারাদার মিস্তরি কোথায়?)

৪.
কেউ বলতে পারেন: মিয়া টেকি ব্যক্তি না হয়েও নিজে করো ভাল কথা, আমাদের কানের কাছে ভ্যাজর ভ্যাজর কর কেনো? এটার উত্তরের কয়েকটা দিক/ডাইমেনশন আছে:

  1. ৪.১
    একটা হল মহাপুরুষদের অনুসরন করার চেষ্টা। ওনারাও সারা জীবন অকাতরে উপদেশ বিতরণ করে গেছেন! তাছাড়া অন্যের বিরক্তি উৎপাদন করতেও উপদেশ দিতে মন্দ লাগে না চোখ টিপি । (১৯৯০ সালে আমাদের স্কুল থেকে শেষ বিদায় অনুষ্ঠানে জনৈক প্রধানশিক্ষকের লেখা "উপদেশ কনিকা" বইখানি হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। এরপর থেকে আর ঐ স্কুলে যাই না শয়তানী হাসি )।
  2. ৪.২
    সেবা। হাতেম তাঈ বিলানোর জন্য টাকা পেয়েছিলো - বিলিয়েছে (পরের ধনে পোদ্দারি)। আমার বিলানোর মত অত টাকা নাই। কিন্তু অন্য একটা সম্পদ আছে - সেটা হল জ্ঞান/শিক্ষা (দয়া করে, ভাব নিচ্ছি বলে ভাববেন না)। কাজেই অন্যের উপকারের জন্য বিতরণ করতে হলে এইটাই করা যেতে পারে।
  3. ৪.৩
    প্রতিবেশি যদি চরম গরীব হয় তবে বাধ্য হয়ে সে আমার জিনিষ চুরি/ডাকাতি করতে পারে (অভাবে স্বভাব নষ্ট)। কিংবা ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করতে পারে। তাই নিজের স্বার্থেই এমন কাজ করা উচিত যাতে নিজের আখের গোছানোর সাথে সাথে আশেপাশের লোকজনেরও উন্নয়ন ঘটে। (আফসোসের কথা হইলো আমাদের নেতারা সেইটা বোঝে না - শুধু নিজেদের আখের গোছানোতে ব্যস্ত থাকে -- জনগণও সময়মত **মারা দিয়ে দেয়। )
    তাই শুধু নিজে পাইরেসী এবং ভাইরাস মুক্ত হলেই যে শান্তি পাব এটা ভাবি না। আশেপাশের লোকজন/বন্ধু/সহকর্মীদেরকেও এই পথে আনার চেষ্টা করি।
  4. ৪.৪
    গরুর দুধ পাইতে হলে, গরুর যত্ন করতে হয়। গরুর ফার্মে দেখবেন গরুকে কত যত্ন করে গোসল দেয়, মশারি টাঙ্গায় ঘুম পাড়ায়। আবার এইদিকে দেখবেন, বাংলাদেশের লোকদের গরিবী দুর করার জন্য অন্য দেশগুলো কত রকম ভাবে সাহায্য করে -- ঘটনা গরুর যত্ন নেয়ার মতই; ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি না করলে বাজার বজায় রাখবে কীভাবে!
    প্রায় একই রকম স্বার্থে অন্যদেরকে লিনাক্সে আসতে বলি। কারণ ব্যবহারকারী বাড়লে বিপদে সাহায্য করার লোক বাড়বে। এখন যেমন উইন্ডোজে কোন সমস্যায় পড়লে আশেপাশের কেউ না কেউ সমাধান দিতে পারে, তেমনি, লিনাক্স ব্যবহারকারী বাড়লে সমস্যা সমাধিত করার জন্য বেশি লোক পাওয়া যাবে।

সুতরাং মোটেও নিঃস্বার্থ ভাবে ভ্যাজর ভ্যাজর করি না। হাসি

৫.
বর্তমানে লিনাক্স কঠিন কোন বিষয় না। গত ৪/৫ বছর থেকে লিনাক্সের ডেভেলপারগণ সহজিয়া ডেস্কটপ বানানোর চেষ্টা শুরু করেছেন। বর্তমানে লিনাক্সের যেই ডিস্ট্রিবিউশনগুলো বাজারে এসেছে সেগুলো খুবই ব্যবহার বান্ধব ।(অপারেটিং সিস্টেমের সাথে অন্য সব জরুরী সফটওয়্যার দিয়ে দেয় বলে এগুলোকে ও.এস. না বলে ডিস্ট্রিবিউশন বা সংক্ষেপে ডিস্ট্রো বলে)। প্রায় সব কাজই উইন্ডোজ বা ম্যাকের মত ক্লিক করে করা যায়। গেম খেলার দিক বাদ দিলে সব দিক দিয়েই এটা ভিস্তা/এক্স.পি.র সমতূল্য। আর ডেভেলপারগণ ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন যে, এই বছরেই এমন নতুন ভার্সন ছাড়বে যেটা ভিস্তা বা ম্যাককে ছাড়িয়ে যাবে অনেকখানি।

আরেকটা কথা জানা দরকার। আমরা না জেনেই কিন্তু লিনাক্স ব্যবহার করছি প্রতিদিন। মোবাইল ফোনগুলোর প্রায় সবগুলোই লিনাক্সে চলে - ওগুলোতে তো আমরা অসুবিধা অনুভব করি না। এছাড়া ছোট ছোট ডিজিটাল যন্ত্রপাতিগুলো সব লিনাক্সে চলে। বেশিরভাগ সুপার কম্পিউটার আর ইন্টারনেট সার্ভার লিনাক্সে চলে। সুতরাং লিনাক্স উড়ে এসে জুড়ে বসা কোনো জিনিষ নয়। শুধুমাত্র ডেস্কটপ পিসির ক্ষেত্রটা বাকি ছিল সেই অঙ্গনে নতুন করে এসেছে।

অফিসে আমার পিসিতে লিনাক্স চলে। এখানে অনায়েসে কাজ করে কয়েকজন কলিগ নিজেদের জন্য লিনাক্স নিয়ে গেছে। আর বাসাতে দুই বছরের বেশি সময় ধরে শুধুমাত্র লিনাক্স ব্যবহার করছি। কম্পিউটারে আমাদের দৈনন্দিন সমস্ত কাজই এটাতে অনায়েসে হয়ে যাচ্ছে (মেইল/ইন্টারনেট, গানশোনা, মুভি/ডিভিডি দেখা, লেখালেখি, হিসাবকিতাব সবই)। যারা প্রোগ্রামিং নিয়ে কাজ করে তারাও লিনাক্সে বেশি শিখতে পারে, কারণ সমস্ত সোর্স কোড উন্মুক্ত।

আর -- লিনাক্স ডেস্কটপ এবং সফটওয়্যারগুলো যে আইনসঙ্গতভাবেই বিনামূল্যে - এটা আপনাদের আগে বলিনি নাকি!

(সচলায়তনে প্রকাশিত)

২টি মন্তব্য:

Fahim Murshed বলেছেন...

অসাধারন। অামি কি কপি করতে পারি?

শামীম বলেছেন...

হ্যাঁ পারো অবশ্যই ... তবে লেখাটার মূল লেখক হিসেবে আমার নামটাও রেখো :)