শনিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০০৯

ভুল চর্চার দেশ

বাংলাদেশের আয়তন আসলে কত? --- ১ লক্ষ ৪৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার ... আরে না না ১ লক্ষ ৪৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার। আয়তন আরো বাড়ছে কারণ বঙ্গোপসাগরে নাকি বিরাট চর জেগে উঠছে। আবার কেউ কেউ ভাবেন যে, চর/ভূমি জাগবে না কারণ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সমূদ্রের পানির গভীরতাও বাড়ছে।

এরকম নানা রকম তথ্যে চারপাশ ভরপুর। আমরা দিনকে দিন এতে অভ্যস্থ হয়ে উঠছি। কিন্তু কেউ কি ভাবে না যে বর্গকিলোমিটার হল ক্ষেত্রফলের একক - এটাকে আয়তন বলা হচ্ছে কেন? যত্রতত্র এরকম ভুল প্রয়োগ দেখি -- এই রিকশা যাবে নাকি? - এর একটা উদাহরণ। আর পথে প্রান্তরে ভুল বানানের ছড়াছড়িতো আছেই .... জাতিকে জাতী লিখে এর যে জাত মেরে দেয়া হচ্ছে সেদিকে কারও কি নজর আছে! কিংবা ফটোস্ট্যাট, পোস্ট, মাস্টার ইত্যাদিতে ষ-ত্ব বিধানের তোয়াক্কা না করে ষ ব্যবহারও আছে। সবচেয়ে খারাপ লাগে যে এ্যাত এ্যাত ভুল বিষয়ে মিডিয়াতে কোনরকম উচ্চবাচ্য নাই দেখে। সবাই কি ভুলের বিজ্ঞাপনমূল্যের কথা ভেবে এসব মেনে নিচ্ছে?

ভুলের বিজ্ঞাপনমূল্য: একটি মুদি দোকানের বাইরে ভুল বানান আর ব্যাকরণে দোকানের পণ্যের প্রচুর বিজ্ঞাপন দেখে একজন সদাশয় ব্যক্তি দোকানদারকে বিষয়টি অবহিত করলেন এবং সঠিক বানান ও ব্যাকরণগুলোও জানিয়ে দিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরেও বাইরের ওগুলোর কোনো পরিবর্তন করা হয়নি দেখে ভেতরে গিয়ে রাগান্বিত ভাবে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। উত্তরে দোকানি জানালেন যে, এই ভুলগুলো ইচ্ছাকৃত। কারণ এই ভুল বানান-টানান দেখে ক্রেতারা ভাবে যে ভেতরের লোকটা বোকাসোকা ...কাজেই এখান থেকে সুবিধা আদায় করা যাবে। ভুল বানানে বিজ্ঞাপন দেয়ার পর থেকে তাই বিক্রি বাট্টাও বেড়ে গিয়েছে। B-)

এছাড়াও ভুলগুলোর সপক্ষে রয়েছে নানা রকম যুক্তি (!) -- ভাষা পরিবর্তনশীল, এর সাথে এ সংক্রান্ত রীতিনীতিও পরিবর্তনশীল। সুতরাং "দেশের আয়তন" বলা ঠিকই আছে। একই ভাবে, রিকশা এবং এর চালকও সমার্থক। আবার কেউ কেউ বলতে পারেন - মিয়া তোমার সমস্যা কী? হুদাই তেনা প্যাঁচাও ক্যা? পছন্দ নাইলে ফুট - এ্যাত প্যাচালের দর্কার কী?

কিছুদিন জাপানে থাকার ভাগ্য হয়েছিল (সেটা সৌভাগ্য না দূর্ভাগ্য সেই তর্কে না যাই ...)। যেখানেই গিয়েছি বিষ্মিত হয়েছিলাম ওদের সাফল্যে। আমাদের মত একই রকম হাত-পা ওয়ালা মানুষ হওয়া সত্বেও ২য় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত বিধ্বস্ত একটা জাতি কীভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে সেটা কল্পনা করতেও কষ্ট হত। জাপানে প্রবাসী কোন বাঙালি ইউরোপ, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া - কোথাও গিয়েই শান্তি পায় না। পৃথিবীর কোথাও জাপানের মত এ্যাত পরিচ্ছন্ন, এফিসিয়েন্ট এবং সাহায্যপ্রবণ সিস্টেম নাই বলেই শুনেছি। জাপানের এই ঈর্ষনীয় দক্ষতা বইয়ের মলাটের মত বাইরের আবরণ হতে পারে - সে ব্যাপারে অন্য কোথাও অন্য সময়ে তর্ক হতে পারে। আমার অবাক লাগতো যে ওরা পারলে আমরা পারি না কেন?

যতই দিন যায় ততই বুঝতে পারি যে জাপানিদের সাথে আমাদের এটিচ্যুডগত বিরাট তফাত রয়েছে। যারা "দ্যা লাস্ট সামুরাই" সিনেমাটা দেখেছেন তাঁরা খেয়াল করবেন যে টম ক্রুজের একটা ডায়লগ ছিল - এরা খুবই পারফেকশনিস্ট। আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় সেই কথার সত্যতা খুঁজে পাই - জাপানিদের মুখে তুলে খাওয়ানো রীতির সমস্যা নিয়ে একটা ব্লগও লিখেছিলাম একসময়। ছোটবেলা থেকেই একজন জাপানী শিশুকে কষ্টসহিষ্ণু এবং পরিশ্রমী করে গড়ে তোলা হয়। তাদের মানসিকতাটাও খুব চমৎকার - এর পেছনে চারিদিকের পরিবেশেরও ভূমিকা রয়েছে বলে মনে হয়। কারণ অন্য অসভ্য দেশ থেকে আগত লোকজনও ওখানে সভ্য হয়ে চলার চেষ্টা করে ... আবার সভ্য জাপানীরাও বাংলাদেশে এলে অনেকক্ষেত্রেই অসভ্যতা করে।

ওরা যেখানে একটা জিনিষ সঠিকভাবে করার জন্য বার বার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে সেখানে আমরা কোনরকমে দায়সারা গোছের কাজ করেই ক্ষান্ত দেই। একজন বাড়ির মালিক যদি ঘরের কোনো কাজ করে তাহলে অনেক যত্ন নিয়ে করে, কিন্তু একজন চাকর দায়সারা গোছের করে ... কারণ এটা তাঁর নিজের সম্পত্তি না। প্রায় দুইশ বছর ইংরেজদের গোলামী করে আমাদের এটিচ্যূডে সেই চাকরের মানসিকতা গেঁথে গেছে বলেই মনে হয়। সেজন্যই দায়সারা গোছের কথা বলি। ভুল জানা সত্বেও ঠিকটা বলার গরজ দেখাই না .... .... । এই চর্চা শুধু ভাষাতেই সীমাবদ্ধ না - এটা জাতীয় চরিত্র হয়ে গেছে। রাজনীতি বলুন, নির্মান শিল্প বলুন, ব্যাবসা বলুন ... সব জায়গাতেই এই চর্চা।

কোন পত্রিকাকেও দেখলাম না দেশের ক্ষেত্রফল লিখতে .... ইংরেজি area শব্দের বাংলা ক্ষেত্রফল কিংবা এলাকা হলেই শোভন হয়। কিন্তু আয়তন কথাটার ইংরেজি হল volume - যেটা দৈর্ঘ্য * প্রস্থ * উচ্চতা নির্দেশ করে। প্রতিনিয়ত তাই দেশের আয়তন ১ লক্ষ ৪৪/৪৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার শুনলে এটাকে দৈর্ঘ্য * প্রস্থ * ভুলের চর্চা করার মাথা নীচু আত্মমর্যাদাহীন গোলাম জাতির অভ্যাস - বলেই মনে হয়।

এই দেশটির জন্মই হয়েছিল ভাষাকে কেন্দ্র করে - দেশের নামটা দেখলে তা-ই মনে হয়। সামনেই (আগামীকাল থেকেই) ফেব্রুযারী মাস। লোক দেখানো বাংলা ভাষা প্রেম চর্চা শুরু হয়ে যাবে কাল থেকেই। কিন্তু তারপরেও কি কেউ দায়সারা ভাব বাদ দিয়ে দায়িত্ব নিয়ে সঠিক কাজ করবে?

(সচলায়তনে প্রকাশিত)

কোন মন্তব্য নেই: