মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০০৮

নববর্ষে নন্দন পার্কে ধরা খাওয়া

আজ ২রা বৈশাখ ১৪১৫। (১৫ই এপ্রিল ২০০৮) .... শুভ নববর্ষে আমি আর আমার স্ত্রী পরিকল্পনা করেছিলাম যে ঢাকার অদুরে অবস্থিত নন্দন পার্কে বেড়াতে যাব। গত সপ্তাহের বৃহষ্পতিবারের পত্রিকায় নন্দন পার্কে নববর্ষ উপলক্ষে কী কী জানি সঙ্গিতানুষ্ঠান হবে তার বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। বাস কোত্থেকে ছাড়ে সেটাও দেয়া ছিল। ৩১শে চৈত্রের দিন বিজ্ঞাপনের ফোন নম্বরে ফোন করে জানলাম যে নন্দন পার্ক খুলবে সকাল ১০টায়; অনুষ্ঠান শুরু হবে ১২:৩০শে; চলবে রাত ৮:৩০ পর্যন্ত; প্রতি ১০ মিনিট পর পর নন্দন পার্কগামী বাস পাওয়া যায়। ইন্টারনেটে নন্দন পার্কের কোন ওয়েবসাইট খুঁজে পেলাম না, কিন্তু একজনের একটা ব্লগে এটার উপরে সচিত্র বর্ণনাও পেয়ে গেলাম।

যা হোক, বিজ্ঞাপনে দেয়া বাস ছাড়ার ঠিকানাগুলো থেকে বাসার কাছে কলাবাগানটাকেই সবচেয়ে সুবিধাজনক মনে হল। তাই নববর্ষের সকাল ১০টার দিকে রিক্সায় চড়ে বসলাম কলাবাগান যাওয়ার জন্য। ধানমন্ডি ১০নং এর মাথায় নামলেই কলাবাগান বাসস্ট্যান্ড, কিন্তু ভুল করে ধানমন্ডি ৩২ (নতুন ১১) নং-এ চলে গিয়েছিলাম। আজকে সরকারী ছুটি; রাস্তায়, বিশেষ করে ধানমন্ডি লেকের আশে পাশে উৎসবমুখর পরিবেশে, গরমে ক্লান্ত সুবেশী মানুষ গিজগিজ করছে। মিরপুর রোডে আজকে দেখি রিক্সা চলতে দিচ্ছে, তাই মেইন রাস্তা ধরেই আবার কলাবাগান ফেরত আসলাম। বউ তার শাড়ী সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে, তারপরও ওভারব্রীজ দিয়ে রাস্তা পার হয়ে বাস কাউন্টারগুলোর দিকে গেলাম। ওখানে একটু জিজ্ঞেস করতেই জানলাম, নন্দনের বাস এখান থেকে ছাড়ে না, আসাদ গেট থেকে ছাড়ে! নন্দনের ফোন নম্বরে ফোন করে সেটা নিশ্চিত হলাম এবং একটা রিক্সা দিয়ে প্রধান সড়ক দিয়েই আসাদ গেট আসলাম।

ভেবেছিলাম হানিফ নামক বাসে যাব। কিন্তু সুপার সার্ভিস নামক বাস আগে আসাতে ওটারই টিকিট কেটে উঠলাম (৩০টাকা/প্রতিজন)। বাসে ভীষন ভীড় ছিল; ভীড়ে কোনমতে বউ দাড়ালো, আমি ওর পাশেই বাসের সিড়িতে। সম্ভবত শ্যামলী পর্যন্ত আসার পর পাশে বসা একজন যাত্রী নামাতে ওখানে ও বসল, আমি পাশে দাঁড়িয়ে সাভার পর্যন্ত। সাভার থেকে ওর পাশেই বসার জায়গা পেলাম, কিন্তু ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকায় যানজটের কারণে আটকে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। এর পর সামনের সিটে বসা মহিলা যাত্রী জানালা দিয়ে বমি করলেন, কিছু অংশ হয়ত উড়ে এসে আমাদের গায়েও পড়ল নাকি! পেছনের বাচ্চা তার আগে বাসের ভেতরে হাটার জায়গাতেই বমি করেছে। যা হোক, অবশেষে দুপুর ১২টার দিকে নন্দন পার্কে পৌঁছালাম।

পার্কিংএর জায়গাটা ধুলি ধুসরিত ... বিভিন্ন প্রকার গাড়ি প্রবেশ করাতে আমাদের ধুলার গোসল (মুরগী যেভাবে বালু ছিটিয়ে করে) হয়ে গেল একদফা। টিকেট কাউন্টারে দারুন ভীড়। সারিবদ্ধভাবে টিকিট কিনতে দাঁড়িয়ে পরলাম। কিছু ভদ্রবেশী লোক লাইন ছাড়াই পাশ থেকে টিকিট কেনার জন্য কাউন্টারের দিকে বিরক্তিকর ভাবে হাত ঢুকিয়ে দিচ্ছে। যা হোক কোন রকম গুতাগুতি ছাড়াই প্রায় কাউন্টারের কাছে পৌছে গেলাম ... আমার সামনে মাত্র একজন লোক, পেছনে অনেক - এমন সময়ে টিকিট বিক্রয়কারী কর্মী সবগুটিয়ে চলে গেলেন - কাস্টমার কেয়ারের প্রথম নমুনা পেলাম। যা হোক পাশের লাইনের কাউন্টারে তখন আমরাও অভদ্রের মত হাত বাড়িয়ে ঐ লাইনের অন্যদেরকে দূঃখপ্রকাশ করে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে টিকেট নিলাম।

টিকেটের তিন রকম (সম্ভবত) অপশন ছিল। ২৫০ টাকায় ওয়াটার ওয়র্ল্ড ও ড্রাই পার্কসহ সব রাইড সহ প্রবেশ। ১৫০ টাকায় ড্রাই পার্কের সব রাইড সহ প্রবেশ। ৯০ টাকায় শুধু প্রবেশ। আমাদের মধ্যে পানিতে নামার কোন ইচ্ছা ছিল না; ইচ্ছা একটু ঘোরাঘুরি করা আর গানের প্রোগ্রাম দেখা, তাছাড়া রাইডগুলোর টিকিট যেহেতু ভেতরেও পাওয়া যায় তাই শুধু প্রবেশ নিলাম।

ঢুকেই আশা করেছিলাম যে একটা ম্যাপ পাব যেখানে বিভিন্ন রাইডের অবস্থান দেখানো থাকবে। মীরপুরের চিড়িয়াখানায় ওরকম আছে; জাপানে ডিজনিল্যান্ড, ডিজনিসী, ইউনিভার্সাল স্টুডিও - এসব জায়গাতেও ছিল। এমনকি ছোটখাট পর্যটনের জায়গাতেও টিকিটের সাথে মানচিত্র ও তথ্যবহুল কাগজ দেয়। সামনে বামদিকে চমৎকার ফোয়ারা দেখা যাচ্ছে, ডানদিকে প্যাডেল নৌকা আর রোপওয়ে দেখা যাচ্ছে ... আমরা ভাবলাম, প্রথমে খেয়ে নেই তারপর ভরাপেটে ঘোরাঘুরি করতে ভাল লাগবে, গানের অনুষ্ঠান দেখতেও ভাল লাগবে।

ডানদিকে একটা খাবারের স্টল দেখে এগিয়ে গেলাম। বাইরের খাবার/পানীয় আনা নিষেধ, কাজেই খেতে চাইলে দর্শনার্থীরা এখানে খাবার কিনতে বাধ্য। যা হোক, খাবার আনতে দিলে আমরা আবার সভ্যতার ধার না ধেরে এখানে পিকনিক করতে বসে যেতে পারি ... কাজেই নিয়ম ঠিকই আছে। খাবারের স্টল থেকেও লাইন ধরে কিনতে হচ্ছে, সবাইকে মূল্য পরিশোধের রিসিট দিচ্ছে। কিন্তু মেনুতে লেখা পছন্দের খাবারটা এখানে নাই, তাই ভাবলাম অন্যদিকের খাদ্যের দোকানে দেখি। অনিশ্চিতভাবে একদিকে হাঁটা শুরু করলাম।

মাথার উপরে বৈশাখের প্রথম সূর্য অকৃপনভাবে নিজের শক্তিমত্তা প্রকাশ করছে। গাছপালার আড়ালে দাড়ানো একজন নিরাপত্তারক্ষীকে জিজ্ঞেস করে জানলাম অন্যদিকে আরও খাবারের স্টল আছে। পানির পাশ দিয়ে হেঁটে অন্যপাশে আসতেই গরমে হাসফাস অবস্থা ... ওদিকে স্টেজে কারা যেন গান করছে ... ঘোষনা দিল যে জনপ্রিয় বাউল শিল্পী অমুক, কিন্তু আমি নিশ্চিত জীবনে এঁর নাম শুনিনি। এইপাশে ওয়াটার ওয়র্ল্ডের জন্য দেখি আলাদা বাউন্ডারী, আমাদের ঢুকতে হলে আবার ১৫০ টাকা দিয়ে টিকেট কিনতে হবে। ৯০ টাকার প্রবেশ অর্থ যে রাইডে চড়া ছাড়া সেটা জানতাম, কিন্তু ওয়াটার ওয়র্ল্ডে তো প্রবেশ করা যায় না - রাইড পরের ব্যাপার। যা হোক, সম্ভবত ঐ টিকিট কেনার পর ভেতরের সব রাইড ফ্রী এবং কোন টিকিট চেক হয় না .. .. তাই এই অবস্থা। গরমে, ঐদিকের পানির আশেপাশে যেতে খুব ইচ্ছা করছিল ... কিন্তু ওখানে সবাই সাঁতার/পানিতে দাপাদাপির মুডে .... .... তাই আর গেলাম না।

এটার প্রবেশপথের পাশেই একটা খাবারের দোকান, পছন্দের ডিশও পেলাম (খাসী-খিচুড়ী ১১৮ টাকা/প্যাকেট)। ড্রিংকস সহ দুইজন দুটা নিলাম। আশেপাশে তিনটা ছোট টেবল সব দর্শনার্থীরা দখল করে রেখেছে ... ... তাদের কাছে খাবার নাই, শুধুই বসে আছে। এদেরকে সরার কথা বলে লাভ নাই ... ... অত বোধশক্তি থাকলে এখানে বসতই না - জাপানিদের মত ভব্যতাজ্ঞান এখানে আশা করা বোকামী, সেটা পরস্পরকে মনে করিয়ে দিলাম ... ... তারপর বিরক্ত মনে স্টেজের পাশে একটা গাছের তলায় ঘাস-মাটির উপরে বসলাম।

সাউন্ড সিস্টেমে সেই বাউল চায়ের স্টল মার্কা গান করে যাচ্ছে। কিছু দর্শকও সামনে বসে শুনছে। এর মধ্যে ঘামতে ঘামতে আমি খেলাম, বউ খেতে পারল না ... ... বাসের সামনের মহিলার করা বমির কণা নাকি ওর শাড়িতে পড়েছে .. ওটা মনে করে গা ঘিনঘিন করছে, তাই।

আমার খাওয়া শেষ হওয়ার পর বাউল মশায়ও গান শেষ করলেন। চারিদিকে শুধু দলবেধে গিজগিজ করে আসা মানুষের কোলাহল .. .. গান থামাতে বেশ ভাল লাগতে শুরু করল, গরমও একটু কম কম মনে হল। ভাবলাম অন্য দিকটা একটু ঘুরে দেখি। মাঠে ঘাস ছিল কিন্তু পায়েচলা পথটার যেই অংশ পাকা না, সেগুলো লাল ধুলা (ইটের গুড়া) দিয়ে ভরা - হাটলে ধুলা উড়বেই।

একটা রোলার কোস্টারের মত দেখতে তবে কম উঁচা রাইডের পাশ দিয়ে গেটের দিকে আসলাম। ওখানে (গেট দিয়ে ঢুকলে বাম দিকে পড়বে) একটা ঘুরন্ত রাইড আছে .... বড় একটা প্লেটের উপর ৩/৪ সিটের গোল গোল বসার জায়গা ... বড় প্লেটটাও ঘোরে, ওর উপরে বসার জায়গাগুলোও ঘোরে .... কী ভয়ংকর! এর পর আরেকটা গোল রাইড। ছোট একটা ট্রেন/গাড়ি যেটা কেন্দ্রের সাথে দুইটা ধাতব বাহু দিয়ে যুক্ত, আনুমানিক ১০ ফুট ব্যাসার্ধের গোলাকার পথে কয়েক চক্কর দেয়। গাড়ীটায় জোড়া জোড়া করে ৬ জোড়া মানুষ বসতে পারেন .. আর চলার সময় ঘোড়ার মত লাফাতে থাকে। এই রাইডটায় লোকজন দারুন মজা পাচ্ছে মনে হল।

এর পর একটা জায়গায় স্বাভাবিক উঁচুতে তিনটা বাস্কেটবলের রিং লাগনো, নির্দিষ্ট দুর থেকে বাস্কেট করতে হবে - সুযোগ ৩ বার ..... ... লাইন ধরে কমবয়সী ছেলেরা ওটাতে বল ছুড়ছে। ওটা পার হলে ডানদিকে বাচ্চাদের গাড়ী, একটা পাকা জায়গায় কিছুক্ষণ সচল থাকে। আর বামদিকে স্লাইডার। অনেক উঁচু (৫০/৬০ ফুটের বেশিই হবে বোধহয়) থেকে একটা টিউবের ভেলার মত নিয়ে পানিওয়ালা স্লিপার দিয়ে নিচে স্লাইড করে নামে। দুইটা পথ আছে, একটা সোজা আরেকটা একটু প্যাচানো। পুরুষ, মহিলা, বাচ্চারা ওটাতে চড়ছে ... ...

ভাবলাম, উল্টাদিকে অবস্থিত প্যাডেল নৌকা এবং রোপওয়েতে চড়ি গিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে এদিকে আসলাম, দুইটাতেই বেশ বড় লাইন। বউএর পা ছড়ে গেছে স্যান্ডেল দিয়ে। তাই ফেরৎ চলে যাবে বলল। গেট দিয়ে বের হয়ে আসলাম .. .. এ্যাত দুরে এখানে সম্ভবত আর আসবো না কখনই।

অনেক লোক এসেছিল। কাজেই বাস/ক্যাব/ত্রিচক্রযানের (সি.এন.জি.র) অভাব নাই। গাড়ী পার্কিং পেরিয়ে মেইন রাস্তা পর্যন্ত হেঁটে কালো ক্যাব ঠিক করলাম। দুপুর ২টার সময় ওখান থেকে রাস্তা বেশ ফাকাই পেয়েছিলাম ... গাবতলী ব্রীজ পর্যন্ত মিটারে ২৫৫ টাকা উঠেছিল - সিটি-লিমিটের বাইরের ঐ অংশের ভাড়াটুকু দ্বিগুণ দিয়েছিলাম।

সেন্ট্রাল রোডের বাসায় নামার সময় দুইজনের শরীরই ধুলাবালিতে কিচকিচ করছে বলে আবিষ্কার করলাম। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরা ভ্রমনটাতেই ধরা খাইছি বলে মনে হল।

কোন মন্তব্য নেই: