সাহায্য চাওয়ার বিড়ম্বনা
জাপানীরা খুবই বিনয়ী ও সাহায্যপ্রবণ জাতি। অন্তত জাপানে থাকার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় এরকমই মনে হওয়া স্বাভাবিক। তবে একটু বেশি সময় থাকলে বোঝা যায়, আসলে এরা বাঙালিদের মতই সামজিক। মেকি ভদ্রতা, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, রেষারেষি, অপরের ছিদ্রান্বেষন, গীবত গাওয়া সবই আমাদের মতই। তবে অর্থনৈতিক চাপ মুক্ত সমাজ (বাংলাদেশের তুলনায় তো বটেই) বলে সাধারণভাবে এদের শিষ্টাচার ও আদর্শগত অবস্থান আমাদের চেয়ে বেশি বলেই মনে হয়। - আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে এসব বিচার করার চেষ্টা না করাই ভালো।
প্রথমবার যখন জাপানে আসলাম। বিমান থেকে নামার পর অতি সহজেই ইমিগ্রেশন পার হলাম, আর তারপর কনভেয়ার বেল্ট/ব্যাগেজ সেকশনে গিয়ে দেখি এক তরুনী স্টাফ ইতিমধ্যেই আমার ব্যাগেজ দুইটা সংগ্রহ করে একটা ট্রলিতে তুলে রেখেছে, আর আমি আসতেই এগিয়ে দিল। পরে বুঝেছি যে, আমার ইমিগ্রেশন আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আসার আগেই বেশিরভাগ যাত্রী বের হয়ে গিয়েছিল আর আমার ব্যাগেজ অনাথের মত বেল্টে ঘুরছিল!!
যা হোক এখানে আসার পরে ভাষাগত সমস্যা ছিল প্রচন্ড; এখনও রয়েছে, তবে সমস্যার তীব্রতাটা কিছুটা কমেছে। প্রথম থেকেই যেখানেই সাহায্য চেয়েছি, তারা প্রাণান্ত চেষ্টা করেছে। যেমন, কোন দোকানে জিজ্ঞেস করলাম বস্তুটার ভেতরে কোন প্রাণীজ চর্বি আছে কি না ... ক্যাশ কাউন্টারে না জানলে ম্যানেজারকে ডেকে এনেছে। রাস্তায় কাউকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে, পারলে পৌছিয়ে দেয়। কারো সাথে পরিচিত হলে জিজ্ঞেস করে কোন সমস্যা আছে কি না ইত্যাদি। এ বিষয়ে প্রথম ভিন্নমত শুনলাম এক বড়ভাইয়ের কাছে। আমি এখানে (ইউনিভার্সিটি যে শহরে) আসার পরে উনিই পরিচিত হওয়া প্রথম বাঙালি (পোস্টডক্টরাল রিসার্চার).... আসার একঘন্টার মধ্যেই। প্রচুর সাহায্য করেছিলেন।
আমি আসার প্রায় ছয়মাস পরে আমার বউ এখানে আসল। একেবারে আসা নয়; তখনও লেখাপড়া শেষ হয়নি বলে ছুটিতে বেড়াতে এসেছিল। সেই ভাই আর আমি এয়ারপোর্টে যাব ওকে রিসিভ করতে। উনি আমাকে ইন্টারন্যাশনাল ডর্মিটরির সামনে থেকে ওনার গাড়িতে তুলে নিয়ে যাবেন - এমনই কথা হয়েছিল। আমি অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য্য হয়ে গেলাম কিন্তু ওনার খবর নাই। উনি সময়ের ব্যাপারে খুবই সিনসিয়ার মানুষ। চিন্তা হতে থাকল, কোন দূর্ঘটনায় পড়লেন কি না। উনি থাকতেন সামনের ফ্যামিলি এ্যাপার্টমেন্টে, কিন্তু তখন আসবেন ডিপার্টমেন্ট থেকে। যা হোক উনি এসে পৌছুলেন। ঘটনা কী তা তিনি এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে বললেন। আমার বউকে ওয়েলকাম জানানোর জন্য তিনি ফুল কিনেছিলেন..... এখন ফুলের গোছাটার নিচের দিক মুড়ানোর জন্য উনি কিছু চকচকে কাগজ আছে কি না জানতে চেয়েছিলেন। ব্যাপার হল, উনি জাপানি পারতেন না তেমন। ফলে বলেছিলেন ইংরেজিতে। দোকানের ক্যাশ কাউন্টারের ব্যক্তি সাহায্য করার জন্য সিরিয়াস হয়ে গেলেন.. নিজে বুঝেন না তো কি হয়েছে.. ম্যানেজার আসল... ম্যানেজারও বুঝেন না....কোথায় জানি ফোন করলেন মোবাইল থেকে - সম্ভবত এই কথার মানে জিজ্ঞেস করতে। তারপর বললেন একটু অপেক্ষা কর, ভেতর থেকে অনেক ঘেটে ঘুটে প্রায় দশ মিনিট পরে কিছু রেপিং পেপার আনলেন। ইতিমধ্যে ঐ ভাইয়ের যা দেরী হওয়ার হয়ে গেছে কারণ এয়ারপোর্ট এখান থেকে মাত্র ৬ কি.মি. দুরে! রাস্তার সমস্ত ট্রাফিক সিগন্যালগুলো বিবেচনায় আনলে ওখানে যেতে মোটামুটি ১০ মিনিট লাগে। কাজেই ৫ মিনিট দেরী হওয়া মানেই অর্ধেক পথ পিছিয়ে পড়া, যেটা জোরে চালিয়ে ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব না। -------------- কাজেই সাহায্য চাইতে গিয়ে দেরী হয়ে গেল।
এদিকে হয়েছিল আরেক ব্যাপার। অর্ধেক পথ যেতেই আমার মোবাইলে একটা ফোন আসল। কথা বলে বুঝলাম এয়ারপোর্ট থেকে কোন জাপানি মহিলা.... তারপর উনি আমার বউকে দিলেন। আমি বললাম ৫ মিনিটের মধ্যে আসতেছি... পথে আছি। বাকী কাহিনী ওর (আমার বউ) মুখে শোনা। দুটি মিলিয়ে ঘটনা এমন:
এটা ছিল ওর প্রথম বিমান ভ্রমন। ঢাকা-সিঙ্গাপুর, সিঙ্গাপুর-ওসাকা, ওসাকা-মিয়াজাকি (অভ্যন্তরীন ফ্লাইট)। টিকিট কাটার সময়ই সাহায্যের জন্য অনুরোধ জানানো ছিল --- লেডি ফ্লাইং এলোন, ফ্লাইং ফর দা ফার্স্ট টাইম। কাজেই সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনের স্টাফগণ ওকে প্রতি পদক্ষেপে অতিরিক্ত যত্ন নিয়েছে। এমনকি ওসাকায় নামার পরেও ডোমেস্টিক ফ্লাইটে বোর্ডিংএ বলে দিয়েছে। মিয়াজাকিতে পৌছানোর পরে আমাদেরকে না দেখে ও বসে ছিল অপেক্ষা করার জন্য। ইতিমধ্যে সাহায্যপ্রবণ এয়ারপোর্ট স্টাফের চোখে পড়ে গেল। হয়ত ওদেরও জানা ছিল যে একা এসেছে... তার উপর বিদেশি মহিলা.... এসে জিজ্ঞেস করাতে ও তো লা-জওয়াব ....... কারণ একবর্ণ জাপানি বুঝে না ও। তখন মহিলা স্টাফগণ দৌড়ে গিয়ে খুঁজে আনল একজন স্টাফকে যে ইংরেজি জানে। তারপর ওর কাছে জেনে আমাকে ফোন করল।
সেও আরেক কাহিনী। প্রথমে নাকি ওর কাছে লেখা ফোন নম্বরটা ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি কোড সহ ডায়াল করেছে। ফোন তো যায় না। ও সেটা বুঝতে পেরে এক আঙ্গুল দিয়ে কান্ট্রি কোড ঢেকে রেখে বলল..... এইটা ডায়াল কর। তারপর ফোন আসল!
যে কোন ব্যাপারেই কোন জাপানীর কাছে সাহায্য চাইলেই ওরা খুব সিরিয়াস হয়ে যায়। আগে ব্যাপারটাকে খুব অদ্ভুদ লাগতো। এখন মনে হয়, এই ব্যাপারটায় আমাদের সাথে ওদের খুব মিল। আমরাও দেশে বিশেষত রাজধানী থেকে দুরে কোন বিদেশী দেখলে, কৌতুহলি হয়ে উঠি; আর সাহায্য চাইলে তো জান দিয়ে দেই (অবশ্য সুযোগ নিতে চায় এমন লোকও আছে)।
ইদানিং তাই দোকানে বা কোথাও গেলে পারতপক্ষে জাপানীদের কাছে সাহায্য চাওয়া এড়িয়ে চলি। শপিং-এ মাঝে মাঝেই বউ ঝাড়ি দেয়.... এ্যাত খুজছ কেন... কাউকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয় ... । আমি মাথা নাড়ি...... নাহ্ .....
২টি মন্তব্য:
মজার কাহিনী। আমার ভাই একে বলে "সেবার বিড়ম্বনা"।
রাজশাহীতে প্রথম দিকে এরকম সমস্যায় পড়েছি। কাউকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করতেই ৪/৫ মিনিট ধরে তার বিস্তারিত শুনতে হবে। আবার এমনও হয়েছে পেছন থেকে ডেকে আবারও পরামর্শ দিচ্ছে।
তবে ঢাকার লোকজন খুব কাঠখোট্টা। কিছু জিজ্ঞেস করলে মনে হয় আমার চেয়ে সেই বেশি বিপদে পড়েছে :(।
ভালো লিখেছেন। ধন্যবাদ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন