মঙ্গলবার, ২২ মে, ২০০৭

ফিল্ডওয়র্কে গুরুত্বপূর্ণ তুচ্ছ ব্যাপারসমূহ

বেশ কিছু ছোট ছোট বিষয় মাঝে মাঝে বড় মনে হয়। বেশ কিছুদিন আগে চাপাইনবাবগঞ্জ শহরের কাছে চুনাখালি গ্রামে গেলাম কাজ করতে। মূল কাজ নলকূপের পানির নমূনাসংগ্রহ বা স্যাম্পলিং। ওখানকারই একটা ছোট ছেলে স্বত:প্রনোদিত হয়ে প্রচুর সাহায্য করছিল। অবশ্য আমাদের সাথে কৌতুহলীদ্দপক পদার্থ হিসেবে জাপানী ছাত্র ও প্রফেসর ছিলেন, সাথে ছিল অনেক যন্ত্রপাতি - সুতরাং উৎসাহি দর্শকের অভাব ছিল না। যেখানেই যাচ্ছিলাম, মোটামুটি একটা মিছিল সহযোগেই যাচ্ছিলাম। যা হোক, আমাদের গ্রুপের একদল, মানে দুই জন, একজায়গায় বসে ফিল্ডকিটের সাহায্যে পানির আর্সেনিক পরীক্ষা করছিল। আর অপরদল, আমরা ঘুরে ঘুরে পানি সংগ্রহ করে কিছু অংশ পাঠিয়ে দিচ্ছিলাম সেখানে - ঐ ছেলেটি বার বার যাওয়া আসা করে স্যাম্পলগুলি দিয়ে আসছিল। আমরা অন্য সব পরীক্ষা করছিলাম আর চাপকলগুলির জি.পি.এস. অবস্থানও রেকর্ড করছিলাম।

যা হোক, দু-দিনের কাজ শেষে প্রফেসর বললেন যে ছেলেটিকে কিছু টাকা দিবেন। যথারীতি ছেলেটাকে গাড়ীতে তুলে সবার আড়ালে টাকা দেয়া হল - যেন সে টাকা নিচ্ছে এটা লোকজন দেখলে সে লজ্জা না পায়। ক্ষুদ্র যে ব্যাপারটি আমি খেয়াল করলাম, সেটা হল টাকাটা যতদুর সম্ভব ছোট নোটে দিলাম (১০-২০ টাকার নোট): কারণ ঐ ছেলেটা টাকা পেয়েছে এটা অনেকেরই গাত্রদাহের কারণ হতে পারে। অপরদিকে, যখন ও কোন দোকানে কিছু কিনতে যাবে, বড় নোট দিলে অবধারিতভাবেই প্রশ্ন এসে যেতে পারে, এ্যাত টাকা সে কই পেল। তারপর কথাটা ছড়িয়ে যাবে, যেটা অনেকক্ষেত্রেই ছেলেটির ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই ছোট নোট -- ব্যাপারটা অতি তুচ্ছ হলেও আমার কাছে জরুরী মনে হয়েছিল। আবার, যেই ব্যক্তি আমাদের সাহায্য করেন, তাঁকে টাকা দেয়ার সময় বলতাম চলেন একটু পানি খাওয়ান, আপনার কূয়ার পানি আমার খুব ভালো লাগে -- বলে বাসার ভেতরে গিয়ে, সবার থেকে আড়ালে টাকা দেয়া হত।

আরেকটি ব্যাপার। আমাদের ফিল্ড ট্যূরগুলির একটা বৈশিষ্ট হল, প্রায় প্রতিটি জায়গাতেই একটা স্থায়ী রেফারেন্স মানুষ থাকেন। কারণ আমরা মূলত আর্সেনিক দূরীকরণের যন্ত্র স্থাপনের পর সেগুলো মনিটরিং বা মেইনটেনেন্সের কাজেই যেতাম। এর আগে যতবারই কোথাও ফিল্ডট্যুরে যাওয়া হত, দুপুরের খাবার দোকান থেকে আনিয়ে নেয়া হত। তারপর সেইসকল গুরুপাক আর পচা তেলের খাবার খেত সবাই ... অবশ্য তেল এড়ানোর জন্য রুটি, ডিমভাজি বা সিঙ্গারাও খাওয়া হত। ঠিক করলাম যে, যেখানে যাচ্ছি, সেখানেই খাওয়ার আয়োজন করতে হবে। যেইখানে যাই, ওখানেরই একজনের বাসায় খাই, বিনিময়ে হোটেলে খেলে যেমন টাকা খরচ হত সেটা দিয়ে দেই। অনেকগুলো সুবিধা তাতে, প্রথমত: দোকানে কি পাওয়া গেল না গেল তা নিয়ে চিন্তার কারণ নাই; রান্নার উপাদানের মান নিয়ন্ত্রত; টাকাটার প্রবাহ কার্যক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকল; ঘনিষ্ঠতা বাড়ল; ওখানে সাময়িক হলেও একটা কর্মসংস্থান হল। অফিসের মোটামুটি সকলেই ব্যাপারটা সমর্থন করল ... .. কিন্তু আগে থেকে কেউই এই নিয়ে নিজ থেকে কিছু বলেনি। অভিজ্ঞ সমাজ-বিজ্ঞানীদের (সোশাল সায়েন্স থেকে পাশ করে রিসার্চার হিসেবে সহকর্মী) সাথে আমার ফিল্ডে চাকরী করার পূর্ব অভিজ্ঞতাই কি এই ধরনের সামাজিক সমাধান খুঁজে বের করার জন্য দায়ী ? -- হতে পারে.. ... অভিজ্ঞতা তাই এ্যাত মূল্যবান।

কোন মন্তব্য নেই: