শুক্রবার, ৭ নভেম্বর, ২০০৮

আইজাক আসিমভের ফাউন্ডেশন

আইজাক আসিমভ (১৯২০-১৯৯২) নামে আমেরিকান-ইহুদী একজন বায়োকেমিস্ট্রির প্রফেসর ফাউন্ডেশন নামক একটা বিখ্যাত সায়েন্স ফিকশন লিখেন। উইকিপিডিয়ায় Issac Asimov শিরোনামে খুঁজলেই এই প্রতিভাবান বিজ্ঞান লেখকের কীর্তি জানতে পারবেন। অধুনা আই.রোবট সিনেমাটাও ওনার গল্প।

ফাউন্ডেশন এত জনপ্রিয় হয় যে, এটার অনেকগুলো সিকুয়েল বেরিয়েছে। একটা সায়েন্স ফিকশন হওয়া সত্ত্বেও এটার কাহিনী (বাংলা অনুবাদ) আমার মনে দাগ কেটে গিয়েছিল ভিন্ন কারণে। প্রতিটি লেখকের মনেই একটি বক্তব্য থাকে যেটা প্রকাশ করার জন্য উনি বেছে নেন একটি কাহিনী, যেখানে কাহিনীর পরতে পরতে তাঁর দর্শনটা বিকাশ লাভ করে। সায়েন্স ফিকশনের লেখক এ জন্য বেছে নেন কাল্পনিক একটা জগত, অনেকটা রূপকথার মতই। আমাদের ধর্মগ্রন্থগুলোর মধ্যেও অনেক দর্শন রূপক গল্পের আকারে প্রকাশিত হয়েছে, যেটা না বুঝে অনেকেই সারফেসের অর্থ নিয়ে লম্ফঝম্ফ করেন দেখা যায়।

ফাউন্ডেশনের প্রায় ৪০০ বছর বিস্তৃত এই কাহিনীতে একদল অত্যন্ত প্রতিভাবান বিজ্ঞানীকে প্রচলিত শাসকদের বিরোধীতা করায় গ্যালাক্সীর প্রান্তে একটি বিবর্ন গ্রহে নির্বাসন দেয়া হয়। গ্রহটিতে খনিজ পদার্থের আকাল ... ফলে বিজ্ঞানীরা বাধ্য হয়েই এমন সব জিনিষপাতি আবিষ্কার করেন যেগুলো কম রিসোর্স ব্যবহার করে তৈরী হয়। যেমন- প্রচলিত দুই তলা ভবনের সমান নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরের ক্ষমতা ওরা হাতের তালুতে এঁটে যায় - এমন আকারের যন্ত্রে নিয়ে আসেন।

এই গ্রহের প্রতিবেশি ৩টি গ্রহগুলোও গ্যালাক্সীর কেন্দ্র থেকে বহুদুরে হওয়াতে অনুন্নত (অজ পাড়া গাঁ)। চমৎকার কাহিনীর মধ্যে দেখা যায় যে বিজ্ঞানীদের গ্রহ থেকে অন্য গ্রহগুলোতে প্রযুক্তির পণ্য সরবরাহ করা হয় - কিন্তু বলা হয় যে ওগুলো দেবতাদের গ্রহ থেকে এসেছে ঐশ্বরিক শক্তি নিয়ে। লোকজনও সেগুলো বিশ্বাস করে, এদের নিযুক্ত ধর্মনেতারা সেই ধর্মের বাণী ছড়ায়, শাসকরা প্রযুক্তির সুবিধা একটু বেশি পায়। মাঝে মাঝে ধর্ম নেতাদের সর্বোচ্চ সম্মান জানানোর জন্য দেবতাদের গ্রহে এনে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। একবার তাঁদের গ্রহ দখল করতে পাঠানো যুদ্ধজাহাজ (স্পেস-শাটল)ও সেটার চালক ফিরিয়ে নিয়ে উল্টা নিজেদের উপর আক্রমন করে .... কারণ সেটার চালকও ছিল দেবতাদের গ্রহে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, আর সেই স্পেসশাটলটাও দেবতাদের গ্রহেই মেরামত করে দেয়া হয়েছিল। আক্রমণের নির্দেশ পেয়ে শাটলের ক্যাপ্টেন অবাক হয়ে যায়, বিদ্রোহ করে .... যেই দেবতারা তাঁকে এ্যাত সম্মান খ্যাতি দিয়েছে, রাজা কিনা তাদেরই আক্রমণ করতে বলে! কাহিনী এগোতে থাকে। এভাবে সফলভাবে অন্য গ্রহগুলোর মধ্যে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে রেখে চলেছিল প্রায় একশতক।

এরপর, উন্নত প্রযুক্তিতে তৈরী দূর্দান্ত দ্রব্যগুলো বাণিজ্যিক ভাবে বিভিন্ন দুরবর্তী গ্রহে এবং কেন্দ্রে অবস্থিত শাসকগোষ্ঠির কাছাকাছি জায়গাতেও বিভিন্ন রিসোর্সের বিনিময়ে বিক্রি শুরু করে। যেমন, জ্বলজ্বল করে তিনমাস জ্বলবে এমন পুতির মালার বা আংটির বিনিময়ে সোনা বা অন্য দামী খনিজ দ্রব্য ইত্যাদি নিয়ে আসা শুরু হয়। এই ব্যবসায়ীরা এতই শক্তিশালী হয়ে উঠে যে এক পর্যায়ে বিজ্ঞানী গ্রহের শাসনক্ষমতাও এদের হাতে চলে আসে। বিভিন্ন কুট কৌশলে এরা অন্য গ্রহ থেকে সম্পদ নিজেদের গ্রহে আনা শুরু করে। কাহিনী এমন পর্যায়েই শেষ হয়ে যায়।

এই কাহিনীতে রূপকের মাধ্যমে একটা দারুন দর্শন তুলে ধরেছেন লেখক। সেটা হল এই দুনিয়ার রাজনীতি কীভাবে চলে তার সরলীকৃত চিত্র বা মূলনীতি। পেশিশক্তি দিয়ে দখলের যুগ শেষ হওয়ার পর নিয়ন্ত্রণ ও শোষণের অস্ত্র বা উপায় ছিল ধর্ম। ধর্ম আনুগত্য আনে .. ফলে অনেক বেশি অনায্য সুবিধা আদায় করা সহজ হয়। পরবর্তী পর্যায়ে এটার বদলে শোষনের মূল শক্তি হয়ে যায় বাণিজ্য। কাহিনীটার দর্শনটা বুঝলে অনেকগুলো জিনিষ মনের মধ্যে ফকফকা হয়ে যায়।

আমরাও দেখে আসছি যে ধর্মকে শোষণের বা নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসতে .... ইউরোপে চার্চের ক্ষমতা ছিল অসাধারণ, যে কোন ফতোয়া চার্চ থেকে বের হলে সেটা সকলে অন্ধ বিশ্বাসে পালন করতো। শাসকরা চার্চ নিয়ন্ত্রণ করতো /করে। দ্যভিঞ্চিকোড সিনেমায় চার্চের একজন ধর্মোন্মাদ খুনি ছিল (সাদা চুল) ... ওর ভয়ংকর পতিত অবস্থা দেখলে মনে হয় বাংলাদেশর এরকম ধর্মোন্মাদ কর্মীরাও এর ব্যতিক্রম নয়।

ধর্ম মানুষকে উন্নত সত্ত্বার কাছে সারেন্ডার করতে শিখায়, বিনা প্রশ্নে কমান্ড পালন করতে শিখায়। নিয়ন্ত্রন করার জন্য এটা খুবই জরুরী। তাই বিনাবাক্য ব্যয়ে বা যৌক্তিকতার প্রশ্ন করাকে ইদানিং ধর্মে নিরূৎসাহিত করা হয়। নিরূৎসাহিত হয় জ্ঞান চর্চা। ইবনে সিনার যুগে সম্ভবত ধর্মকে নিয়ন্ত্রনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়নি। তাই তখন ছিল জ্ঞানচর্চা ... আর এখন যে কোন আবিষ্কারের পরে - ওটা ১৪০০ বছর আগেই কোরআনে বলা আছে বলে পাশ কাটানোর চেষ্টা দেখা যায়; তারপর ঐ তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হলে হুজুরদের টিকিটিও দেখা যায় না। জ্ঞানচর্চা করলে যে মানুষ নত হবে না ... তাই জ্ঞান চর্চা এখন নিষিদ্ধ। কোন প্রশ্ন করা যাবে না - এটাই এখন ধর্মের চর্চা।

বিনাবাক্য ব্যয়ে নির্দেশ পালন শিখায় আর কোথায়? সেটা সেনাবাহিনীতে। তাই নিয়ন্ত্রন করতে চাইলে ধর্ম আর সেনাবাহিনীর উপর সওয়ার হওয়াই সবচেয়ে সুবিধাজনক। জানেন তো, দেশের রাজনীতিতে বেসিক এই কৌশলগুলোই সফলভাবে প্রয়োগ করে জামাত। অন্য দলগুলো যখন পেশীশক্তি আর আদর্শের কথা বলে, জামাত তখন পেশীশক্তির পাশাপাশি ধর্মের আনুগত্যও দখলে নেয়ার চেষ্টা করেছে, সফলও হয়েছে অনেকদুর। তাইতো মুক্তচিন্তা নিরূৎসাহিত হয়, মওদুদী হাদিস নিয়ে প্রশ্ন করা নাজায়েজ হয়।

উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠিগুলোর মত শুধু প্রাথমিক দুটো উপায়েই খেলছে না সকলে। শেষ এবং সবচেয়ে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করছে বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো - অসম বাণিজ্য করে, IMF, WTO ইত্যাদি বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংগঠন করে কীভাবে শোষন করছে সেটা অন্য কিছু বিশ্লেষনে দেখেছেন, বিশেষ করে দিনমজুর ভাইয়ের বিশ্লেষনটা খুবই চমৎকার মনে হয়েছে।

তাই দেশের অবস্থায় ঘুরে ফিরে ফাউন্ডেশনের কাহিনীরই সফল মঞ্চায়ন বলে মনে হয়। শুধু সেখানে কামিয়াবীরা ছিল নায়ক, আর এখানে ভিলেন।

(সচলায়তনে প্রকাশিত)

২টি মন্তব্য:

Rafi বলেছেন...

(অফ টপিক মন্তব্য)ভাইয়া, আমার ব্লগে ঢুঁ মারার জন্যে ধন্যবাদ। পরিচিত হতে পারলে খুশি হবো।

Andalib Bin Haque বলেছেন...

আসিমভের ফাউন্ডেশন আসলেই একটা সার্বকালীন, সার্বজনীন রচনা।

আমিও এর-সাথে প্রায় সবকিছুর মিল পাই।

ভালো লাগলো আমার মতোই কেউ কেউ মিল পায় দেখে।