বৃহস্পতিবার, ২৪ মে, ২০০৭

সাহায্য চাওয়ার বিড়ম্বনা

জাপানীরা খুবই বিনয়ী ও সাহায্যপ্রবণ জাতি। অন্তত জাপানে থাকার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় এরকমই মনে হওয়া স্বাভাবিক। তবে একটু বেশি সময় থাকলে বোঝা যায়, আসলে এরা বাঙালিদের মতই সামজিক। মেকি ভদ্রতা, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, রেষারেষি, অপরের ছিদ্রান্বেষন, গীবত গাওয়া সবই আমাদের মতই। তবে অর্থনৈতিক চাপ মুক্ত সমাজ (বাংলাদেশের তুলনায় তো বটেই) বলে সাধারণভাবে এদের শিষ্টাচার ও আদর্শগত অবস্থান আমাদের চেয়ে বেশি বলেই মনে হয়। - আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে এসব বিচার করার চেষ্টা না করাই ভালো।

প্রথমবার যখন জাপানে আসলাম। বিমান থেকে নামার পর অতি সহজেই ইমিগ্রেশন পার হলাম, আর তারপর কনভেয়ার বেল্ট/ব্যাগেজ সেকশনে গিয়ে দেখি এক তরুনী স্টাফ ইতিমধ্যেই আমার ব্যাগেজ দুইটা সংগ্রহ করে একটা ট্রলিতে তুলে রেখেছে, আর আমি আসতেই এগিয়ে দিল। পরে বুঝেছি যে, আমার ইমিগ্রেশন আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আসার আগেই বেশিরভাগ যাত্রী বের হয়ে গিয়েছিল আর আমার ব্যাগেজ অনাথের মত বেল্টে ঘুরছিল!!

যা হোক এখানে আসার পরে ভাষাগত সমস্যা ছিল প্রচন্ড; এখনও রয়েছে, তবে সমস্যার তীব্রতাটা কিছুটা কমেছে। প্রথম থেকেই যেখানেই সাহায্য চেয়েছি, তারা প্রাণান্ত চেষ্টা করেছে। যেমন, কোন দোকানে জিজ্ঞেস করলাম বস্তুটার ভেতরে কোন প্রাণীজ চর্বি আছে কি না ... ক্যাশ কাউন্টারে না জানলে ম্যানেজারকে ডেকে এনেছে। রাস্তায় কাউকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে, পারলে পৌছিয়ে দেয়। কারো সাথে পরিচিত হলে জিজ্ঞেস করে কোন সমস্যা আছে কি না ইত্যাদি। এ বিষয়ে প্রথম ভিন্নমত শুনলাম এক বড়ভাইয়ের কাছে। আমি এখানে (ইউনিভার্সিটি যে শহরে) আসার পরে উনিই পরিচিত হওয়া প্রথম বাঙালি (পোস্টডক্টরাল রিসার্চার).... আসার একঘন্টার মধ্যেই। প্রচুর সাহায্য করেছিলেন।

আমি আসার প্রায় ছয়মাস পরে আমার বউ এখানে আসল। একেবারে আসা নয়; তখনও লেখাপড়া শেষ হয়নি বলে ছুটিতে বেড়াতে এসেছিল। সেই ভাই আর আমি এয়ারপোর্টে যাব ওকে রিসিভ করতে। উনি আমাকে ইন্টারন্যাশনাল ডর্মিটরির সামনে থেকে ওনার গাড়িতে তুলে নিয়ে যাবেন - এমনই কথা হয়েছিল। আমি অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য্য হয়ে গেলাম কিন্তু ওনার খবর নাই। উনি সময়ের ব্যাপারে খুবই সিনসিয়ার মানুষ। চিন্তা হতে থাকল, কোন দূর্ঘটনায় পড়লেন কি না। উনি থাকতেন সামনের ফ্যামিলি এ্যাপার্টমেন্টে, কিন্তু তখন আসবেন ডিপার্টমেন্ট থেকে। যা হোক উনি এসে পৌছুলেন। ঘটনা কী তা তিনি এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে বললেন। আমার বউকে ওয়েলকাম জানানোর জন্য তিনি ফুল কিনেছিলেন..... এখন ফুলের গোছাটার নিচের দিক মুড়ানোর জন্য উনি কিছু চকচকে কাগজ আছে কি না জানতে চেয়েছিলেন। ব্যাপার হল, উনি জাপানি পারতেন না তেমন। ফলে বলেছিলেন ইংরেজিতে। দোকানের ক্যাশ কাউন্টারের ব্যক্তি সাহায্য করার জন্য সিরিয়াস হয়ে গেলেন.. নিজে বুঝেন না তো কি হয়েছে.. ম্যানেজার আসল... ম্যানেজারও বুঝেন না....কোথায় জানি ফোন করলেন মোবাইল থেকে - সম্ভবত এই কথার মানে জিজ্ঞেস করতে। তারপর বললেন একটু অপেক্ষা কর, ভেতর থেকে অনেক ঘেটে ঘুটে প্রায় দশ মিনিট পরে কিছু রেপিং পেপার আনলেন। ইতিমধ্যে ঐ ভাইয়ের যা দেরী হওয়ার হয়ে গেছে কারণ এয়ারপোর্ট এখান থেকে মাত্র ৬ কি.মি. দুরে! রাস্তার সমস্ত ট্রাফিক সিগন্যালগুলো বিবেচনায় আনলে ওখানে যেতে মোটামুটি ১০ মিনিট লাগে। কাজেই ৫ মিনিট দেরী হওয়া মানেই অর্ধেক পথ পিছিয়ে পড়া, যেটা জোরে চালিয়ে ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব না। -------------- কাজেই সাহায্য চাইতে গিয়ে দেরী হয়ে গেল।

এদিকে হয়েছিল আরেক ব্যাপার। অর্ধেক পথ যেতেই আমার মোবাইলে একটা ফোন আসল। কথা বলে বুঝলাম এয়ারপোর্ট থেকে কোন জাপানি মহিলা.... তারপর উনি আমার বউকে দিলেন। আমি বললাম ৫ মিনিটের মধ্যে আসতেছি... পথে আছি। বাকী কাহিনী ওর (আমার বউ) মুখে শোনা। দুটি মিলিয়ে ঘটনা এমন:
এটা ছিল ওর প্রথম বিমান ভ্রমন। ঢাকা-সিঙ্গাপুর, সিঙ্গাপুর-ওসাকা, ওসাকা-মিয়াজাকি (অভ্যন্তরীন ফ্লাইট)। টিকিট কাটার সময়ই সাহায্যের জন্য অনুরোধ জানানো ছিল --- লেডি ফ্লাইং এলোন, ফ্লাইং ফর দা ফার্স্ট টাইম। কাজেই সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনের স্টাফগণ ওকে প্রতি পদক্ষেপে অতিরিক্ত যত্ন নিয়েছে। এমনকি ওসাকায় নামার পরেও ডোমেস্টিক ফ্লাইটে বোর্ডিংএ বলে দিয়েছে। মিয়াজাকিতে পৌছানোর পরে আমাদেরকে না দেখে ও বসে ছিল অপেক্ষা করার জন্য। ইতিমধ্যে সাহায্যপ্রবণ এয়ারপোর্ট স্টাফের চোখে পড়ে গেল। হয়ত ওদেরও জানা ছিল যে একা এসেছে... তার উপর বিদেশি মহিলা.... এসে জিজ্ঞেস করাতে ও তো লা-জওয়াব ....... কারণ একবর্ণ জাপানি বুঝে না ও। তখন মহিলা স্টাফগণ দৌড়ে গিয়ে খুঁজে আনল একজন স্টাফকে যে ইংরেজি জানে। তারপর ওর কাছে জেনে আমাকে ফোন করল।

সেও আরেক কাহিনী। প্রথমে নাকি ওর কাছে লেখা ফোন নম্বরটা ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি কোড সহ ডায়াল করেছে। ফোন তো যায় না। ও সেটা বুঝতে পেরে এক আঙ্গুল দিয়ে কান্ট্রি কোড ঢেকে রেখে বলল..... এইটা ডায়াল কর। তারপর ফোন আসল!

যে কোন ব্যাপারেই কোন জাপানীর কাছে সাহায্য চাইলেই ওরা খুব সিরিয়াস হয়ে যায়। আগে ব্যাপারটাকে খুব অদ্ভুদ লাগতো। এখন মনে হয়, এই ব্যাপারটায় আমাদের সাথে ওদের খুব মিল। আমরাও দেশে বিশেষত রাজধানী থেকে দুরে কোন বিদেশী দেখলে, কৌতুহলি হয়ে উঠি; আর সাহায্য চাইলে তো জান দিয়ে দেই (অবশ্য সুযোগ নিতে চায় এমন লোকও আছে)।

ইদানিং তাই দোকানে বা কোথাও গেলে পারতপক্ষে জাপানীদের কাছে সাহায্য চাওয়া এড়িয়ে চলি। শপিং-এ মাঝে মাঝেই বউ ঝাড়ি দেয়.... এ্যাত খুজছ কেন... কাউকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয় ... । আমি মাথা নাড়ি...... নাহ্ .....

হায়রে বাংলা ভাষা

ভাষাভিত্তিক জাতি আমরা। বাংলা ভাষা বলা হয় এই দেশে তাই এটা বাংলাদেশ। এই দেশের উৎপত্তির অন্যতম একটা ইস্যূ ছিল ভাষা। সেই ভাষাই যখন বিকৃত ভাবে উপস্থাপিত হয় সেটা দেখতে মন খারাপ লাগেই। যেমন অনেক সময় দেয়ালের লিখনে দেখি "জাতিয়" বানান ... মনটা এ্যাত যে খারাপ লাগে। "জাতীয়" বানানটা এমন -- কিন্তু সেই বানানটারই জাত মেরে দিয়েছে .... পরোক্ষ ভাবে এই প্রিয় ভাষা, যার জন্য এত মানুষ আবেগপ্রবণ হয়েছে, প্রাণ দিয়েছে সেই মানুষগুলোর আবেগ, বিবেচণাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ও অবমাননা করা হয় বলেই মনে হয়। জাতিয় বানানটা নিশ্চয়ই আঞ্চলিকতার ধোপে শুদ্ধ হবে না। (কিছুটা এ বিষয়ে কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে আলোচনা হয়েছে প্রজন্ম ফোরামে: http://forum.projanmo.com/t921.html)।

তবে এই লেখাটার উদ্দেশ্য লিখিত ভাষা নয়, বরং কথ্য ভাষা সম্পর্কে।

মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটু প্রাসঙ্গিক কিছু উদাহরণ লিখি। ভারতীয়দের ট ট মার্কা ইংরেজী শুনে ইংরেজী ভাষা-ভাষীগণ মুখ টিপে হাসে। যদিও চমৎকার ইংরেজি বলেন এমন ভারতীয় প্রচুর। কিন্তু মিডিয়াতেও সেইরকম হাস্যকর ইংরেজি আসছে। বিবিসির একটা প্রামান্যতে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টরের ইংরেজি ভাষ্যর নিচে ইংরেজি সাবটাইটেল ছিল ..... !! ইংরেজি থেকে আসা শব্দগুলোর অপভ্রংশকে ওরা ইংরেজি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। ইউটিউবের একটা রেসিপি ব্লগে শুনলাম টম্যাটোকে তেমাটার বলছে!!

একই কথা প্রযোজ্য সাধারণ জাপানিদের ইংলিশ শুনলে। ইংরেজি বেড (বিছানা) ওরা বলবে বেদ্দো!! তাছাড়া ল উচ্চারন করতে পারে না বিধায় ল যুক্ত সকল শব্দই হয়ে যায় র!! মালিহাকে বলে মারিহা!! ব্যাপারটা দারুন কৌতুককর। এটা জাপানিগণও জানে। তাই ওরা সহজে ইংরেজি বলতে চায় না .... জানা থাকা সত্ত্বেও।

যতদুর বুঝি আমেরিকান, ব্রিটিশ, অস্ট্রেলিয়ান, নিউজিল্যান্ডের .... কোন জায়গার কথ্যটাই স্ট্যান্ডার্ড ইংলিশ নয়। ব্যক্তিগত লেভেল যেভাবেই বলা হউক, কিন্তু প্রচার মাধ্যমে স্ট্যান্ডার্ড ভাষা হওয়া উচিৎ বলে মনে করি। দেশে বা বাইরে, প্রায় সকল নামকরা চ্যানেলগুলোর খবরেই ইংরেজি একই রকম -- নিজের উচ্চারন ঠিক করার চেষ্টা করি ওগুলো শুনে।

কিন্তু আমাদের এত আবেগ ঘেরা, আত্মত্যাগের ইতিহাসে সমৃদ্ধ বাংলা ভাষাতেই আমাদের বিকৃতি দেখি প্রচার মাধ্যমে। আঞ্চলিক ভাষাগুলো বাংলা ভাষার একটা অংশ... কোন সমস্যা নাই আমার সেটাতে। আঞ্চলিক ভাষা শুনলে মনে হয় দেশের কথাই শুনছি ..... খারাপ লাগে না কোনক্রমেই। ভাষাটাও পরিবর্তনশীল - কাজেই উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি পাল্টাবেই ---- ৫০ বছর আগের বাংলা আর এখনকার ভাষা তো এক নয়, কাম্যও নয়। কিন্তু তার পরেও কিছু কিছু ব্যাপার মনের মাঝে খচখচ করতে থাকে।

বাংলা রেডিও চ্যানেলগুলোর মধ্যে মাঝে মাঝে এন.এইচ.কে. (জাপানের) থেকে খবর শুনতাম আগে। বিকৃত ভাষা শুনে রাগে গা জ্বলে যায়। ফীড ব্যাক ফর্মে জানিয়েছিও। কিন্তু যেই আর সেই .... .... অসহ্য... তাই ওটা এখন আর শুনিনা।

আরেকটা হল, ইদানিংকার কিছু দেশি চ্যানেল.... ফুর্তি? মেট্রোওয়েভ?... আমি নামগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত নই। এক বা দুইদিন শোনার পরে আর শুনিনা। দেশের কথা/ গান শুনতে গিয়ে মেজাজ খারাপ করার কোন মানে নাই -- এর চেয়ে না শোনা ভাল। শুধু বলব, এদের উপস্থাপকের বাংলা শুনলে মনে হয় সংশপ্তক নাটকের লর্ড ক্লাইভ বাংলা বলছে........ অসহ্য লাগে।

মঙ্গলবার, ২২ মে, ২০০৭

ফিল্ডওয়র্কে গুরুত্বপূর্ণ তুচ্ছ ব্যাপারসমূহ

বেশ কিছু ছোট ছোট বিষয় মাঝে মাঝে বড় মনে হয়। বেশ কিছুদিন আগে চাপাইনবাবগঞ্জ শহরের কাছে চুনাখালি গ্রামে গেলাম কাজ করতে। মূল কাজ নলকূপের পানির নমূনাসংগ্রহ বা স্যাম্পলিং। ওখানকারই একটা ছোট ছেলে স্বত:প্রনোদিত হয়ে প্রচুর সাহায্য করছিল। অবশ্য আমাদের সাথে কৌতুহলীদ্দপক পদার্থ হিসেবে জাপানী ছাত্র ও প্রফেসর ছিলেন, সাথে ছিল অনেক যন্ত্রপাতি - সুতরাং উৎসাহি দর্শকের অভাব ছিল না। যেখানেই যাচ্ছিলাম, মোটামুটি একটা মিছিল সহযোগেই যাচ্ছিলাম। যা হোক, আমাদের গ্রুপের একদল, মানে দুই জন, একজায়গায় বসে ফিল্ডকিটের সাহায্যে পানির আর্সেনিক পরীক্ষা করছিল। আর অপরদল, আমরা ঘুরে ঘুরে পানি সংগ্রহ করে কিছু অংশ পাঠিয়ে দিচ্ছিলাম সেখানে - ঐ ছেলেটি বার বার যাওয়া আসা করে স্যাম্পলগুলি দিয়ে আসছিল। আমরা অন্য সব পরীক্ষা করছিলাম আর চাপকলগুলির জি.পি.এস. অবস্থানও রেকর্ড করছিলাম।

যা হোক, দু-দিনের কাজ শেষে প্রফেসর বললেন যে ছেলেটিকে কিছু টাকা দিবেন। যথারীতি ছেলেটাকে গাড়ীতে তুলে সবার আড়ালে টাকা দেয়া হল - যেন সে টাকা নিচ্ছে এটা লোকজন দেখলে সে লজ্জা না পায়। ক্ষুদ্র যে ব্যাপারটি আমি খেয়াল করলাম, সেটা হল টাকাটা যতদুর সম্ভব ছোট নোটে দিলাম (১০-২০ টাকার নোট): কারণ ঐ ছেলেটা টাকা পেয়েছে এটা অনেকেরই গাত্রদাহের কারণ হতে পারে। অপরদিকে, যখন ও কোন দোকানে কিছু কিনতে যাবে, বড় নোট দিলে অবধারিতভাবেই প্রশ্ন এসে যেতে পারে, এ্যাত টাকা সে কই পেল। তারপর কথাটা ছড়িয়ে যাবে, যেটা অনেকক্ষেত্রেই ছেলেটির ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই ছোট নোট -- ব্যাপারটা অতি তুচ্ছ হলেও আমার কাছে জরুরী মনে হয়েছিল। আবার, যেই ব্যক্তি আমাদের সাহায্য করেন, তাঁকে টাকা দেয়ার সময় বলতাম চলেন একটু পানি খাওয়ান, আপনার কূয়ার পানি আমার খুব ভালো লাগে -- বলে বাসার ভেতরে গিয়ে, সবার থেকে আড়ালে টাকা দেয়া হত।

আরেকটি ব্যাপার। আমাদের ফিল্ড ট্যূরগুলির একটা বৈশিষ্ট হল, প্রায় প্রতিটি জায়গাতেই একটা স্থায়ী রেফারেন্স মানুষ থাকেন। কারণ আমরা মূলত আর্সেনিক দূরীকরণের যন্ত্র স্থাপনের পর সেগুলো মনিটরিং বা মেইনটেনেন্সের কাজেই যেতাম। এর আগে যতবারই কোথাও ফিল্ডট্যুরে যাওয়া হত, দুপুরের খাবার দোকান থেকে আনিয়ে নেয়া হত। তারপর সেইসকল গুরুপাক আর পচা তেলের খাবার খেত সবাই ... অবশ্য তেল এড়ানোর জন্য রুটি, ডিমভাজি বা সিঙ্গারাও খাওয়া হত। ঠিক করলাম যে, যেখানে যাচ্ছি, সেখানেই খাওয়ার আয়োজন করতে হবে। যেইখানে যাই, ওখানেরই একজনের বাসায় খাই, বিনিময়ে হোটেলে খেলে যেমন টাকা খরচ হত সেটা দিয়ে দেই। অনেকগুলো সুবিধা তাতে, প্রথমত: দোকানে কি পাওয়া গেল না গেল তা নিয়ে চিন্তার কারণ নাই; রান্নার উপাদানের মান নিয়ন্ত্রত; টাকাটার প্রবাহ কার্যক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকল; ঘনিষ্ঠতা বাড়ল; ওখানে সাময়িক হলেও একটা কর্মসংস্থান হল। অফিসের মোটামুটি সকলেই ব্যাপারটা সমর্থন করল ... .. কিন্তু আগে থেকে কেউই এই নিয়ে নিজ থেকে কিছু বলেনি। অভিজ্ঞ সমাজ-বিজ্ঞানীদের (সোশাল সায়েন্স থেকে পাশ করে রিসার্চার হিসেবে সহকর্মী) সাথে আমার ফিল্ডে চাকরী করার পূর্ব অভিজ্ঞতাই কি এই ধরনের সামাজিক সমাধান খুঁজে বের করার জন্য দায়ী ? -- হতে পারে.. ... অভিজ্ঞতা তাই এ্যাত মূল্যবান।

শুক্রবার, ১৮ মে, ২০০৭

এক্সাইটিং সময়!

ইদানিং ভীষন একটা এক্সাইটিং সময় পার করছি। এক্সাইটিংই বলা যায়। কারণ আমার থিসিস ডিফেন্স করার প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ চলছে। এপ্রিল মাসের শুরু থেকেই থিসিস আউটলাইন আর শিরোনাম নিয়ে একবার পরীক্ষকদের সামনে প্রেজেন্ট করতে হল। ওনারা আমার এ পর্যন্ত হওয়া সমস্ত প্রকাশনাগুলোর গুণগত মান পরীক্ষা করলেন। কোথায় প্রকাশিত হয়েছে তা পুঙখানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে রায় দিলেন .. হ্যাঁ এই ছাত্র ডিগ্রী আবেদন করতে পারে। এসকল শেষ করতে করতে মে মাস চলে আসল। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে জাপানে পরপর ৪ দিনের বিভিন্ন ছুটি থাকে; তার সাথে সপ্তাহান্তের দুদিন যোগ করে মোটামুটি টানা এক সপ্তাহ ছুটি পাওয়া যায়। এজন্য এ সময়টাকে গোল্ডেন উইক বলা হয়, সারাবছরে এত বড় ছুটি আর নেই। তাই সকলেই এই সময়ে বিভিন্ন রকম বেড়ানোর পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত করে। সমস্ত বেড়ানোর জায়গাগুলোতেও ব্যবসা হয় রমরমা। প্লেনের ও অন্যান্য যানবাহনের ভাড়াও সিজন হিসেবে বেশি থাকে। যাই হোক, এবছর আমারও কয়েকটা জায়গায় বেড়ানোর পরিকল্পনা ছিল। তাছাড়া জাপানে এটা আমার সম্ভবত শেষ বছর, বউও ফেরৎ চলে যাবে কয়েকদিন পরেই - ওর ভাইয়ের বিয়েতে অংশগ্রহন করে আমার আসার অপেক্ষা করবে বলে। কিন্তু ছুটি শুরুর ঠিক আগের দিন সন্ধ্যায় আমাকে জানানো হল যে থিসিসের একটা খসড়া জমা দিতে হবে। তাও আবার ঠিক চার দিন পরে, যেদিন বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে ঠিক সেদিন। পূর্ব পরিকল্পিত বেড়ানো কাট-ছাট করতে হল, কিন্তু পুরোপুরি বাদ দেয়া গেল না। দিনে বেড়িয়ে রাতে কাজ। রাত জেগে জেগে মোটামুটি দাঁড় করালাম থিসিসের ড্রাফট। কি যে লিখেছি নিজেই ঠিকমত জানিনা .... শুধু কোনরকমে জমা দেয়ার মত একটা কিছু প্রস্তুত করা।

ইতিমধ্যে চারজন পরীক্ষক ওটা দেখে উন্নয়নকল্পে বিভিন্ন রকম পরামর্শ দিয়েছেন। ওগুলো সমন্বয় করে তারপর আবার জমা দেয়ার মাঝখানে তিন সপ্তাহ সময়। এর মাঝেই ডিগ্রীর জন্য আবেদনপত্র জমা দিতে হল। সে আরেক ঝক্কি। সমস্ত ফরমগুলো জাপানিতে। ওগুলোর সফটকপি থেকে জাপানিগুলো কপি করে ইন্টারনেটের ট্রানস্লেশন সাইট থেকে কিছুটা ইংরেজি করে করে অর্থ বুঝার চেষ্টায় গেল দুই দিন। যা হোক আমার প্রফেসরের আন্তরিক সহায়তায় ওগুলো পূরণ করা গেল.... বেশিরভাগ কাজ প্রফেসরই করে দিলেন। এখন থিসিসটার পরবর্তী পর্যায়ের উন্নয়নমূলক কাজ করছি। এর পরে এটা চুড়ান্ত রূপে আসার আগে আরোও দুইবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পরামর্শ-উন্নয়ন হবে। আমন্ত্রিত এক্সামিনারগণ দেখবেন। তারপরে ফাইনাল ডিফেন্স।

আরো একটা ডিগ্রীর ছোঁয়া অনুভব করছি... তাই এ্যাত খাটুনির পরেও এক্সাইটেড লাগে। আশা করছি, এর ফলে ভবিষ্যত কর্মক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা পাব .... দেখা যাক।