শনিবার, ৭ জুলাই, ২০০৭

উৎকর্ষবাদীতা - যেভাবে দেখি

উৎকর্ষবাদীতা/পারফেকশনিজম হলো কোন একটা কাজ করার সময় ওটাকে বার বার নিখুত করার চেষ্টা এবং মনমত সুন্দর হওয়ার আগ পর্যন্ত সেটার উন্নয়নে কোন বিরতি না দেয়ার একটা দারুন বৈশিষ্ট - যা কিছু মানুষের স্বভাবে থাকে। ব্যাপারটাকে খুতখুতে স্বভাবও বলা যেতে পারে। খুতখুতে স্বভাবটা আমি নিজেও পরিমিত পরিমানের বেশি পছন্দ করি না। বিশেষতঃ কিছু মানুষের এই ব্যাপারটা যখন মানসিক বিকারের পর্যায়ে চলে যায় - তখন তো নয়ই। যেমন ধরুন, কারো কারো পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে বড়ই খুতখুতে স্বভাব। অসুখ বলি তখনই যখন এজন্য তিনি দিনে ৭বার গোছল করবেন, আয়নার সামনে কয়েকঘন্টা ব্যয় করবেন। কোন কোন ব্যক্তি আছেন, মাছ যতই ধোয়া হউক না কেন তাঁদের মন ভরে না - মনে হয় ময়লা তো রয়েই গেছে।

জাপানে এসে আর এদের সাথে কাজ করে বুঝলাম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরা পারফেকশনিস্ট বা উৎকর্ষবাদী মনোভাবের। ধরুন মেকানিকাল ল্যাবরেটরিতে কোন ছাত্র একটা যন্ত্রাংশ বানাবে, সে সেটা নির্দিষ্ট আকার দেয়ার জন্য ঘষার যন্ত্র দিয়ে ঘষতেই থাকবে ঘষতেই থাকবে -- যতক্ষণ না মনমতো হচ্ছে। সময়ের কোন ব্যাপার নাই, সন্ধা ৬টায় ল্যাব বন্ধ হয়, কিন্তু ঐ ব্যাটা দেখা যাবে রাত ১০টা পর্যন্ত ঘষতেছে। যে কোন ল্যাবে, একটা প্রেজেন্টেশন বানাবে, সেটা নিয়ে কি যে আদিখ্যেতা -- অক্ষরের রঙের ব্যাপারে, আকারের ব্যাপারে, ব্যাকগ্রাউন্ডে কোন রং ইত্যাদি। দেশে কাজ করতে গিয়েছি ইউনিভার্সিটি থেকে, সাথে জাপানি প্রফেসর, আরও কয়েকজন ছাত্র। একটা ম্যাটেরিয়াল ময়লা, ব্যাস ... সবাই মিলে বসে গেলাম সবগুলো হাতে ঘষে ঘষে ধোয়ার কাজে - ১ ইঞ্চি আকারে ছোট ছোট করে কাটা ০.৫ ইঞ্চি ব্যাসের প্লাস্টিক পাইপের এক বস্তা টুকরা, ধরুন, একবস্তা ছোট ইটের খোয়ার মত পরিমান -- সবগুলো ধুলাম সবাই মিলে, প্রফেসরও বাদ নাই।

প্রথম প্রথম এসব আদিখ্যেতা মনে হলেও এখন বুঝি, জাপানের উন্নতির মূলকারণগুলোর একটি হয়ত এই উৎকর্ষবাদী মনোভাব। এরা নিজেরা কম্পিউটার বা গাড়ীর আবিষ্কর্তা না; আমেরিকা বা অন্য কোন দেশ থেকে এনেছে টেকনোলজি ---- তারপর সেই অক্লান্ত ঘষাঘষি। জাপানের প্রতিটি শিল্পপন্যের মধ্যেই এই অতিরিক্ত যত্নের ছাপটা চোখে পড়ার মত। যেমন এর ভেতরের কলকব্জা তেমনি এর বাইরের ফিনিশিং। ফলাফল ব্যবসা সফল। এ প্রসঙ্গে ২য় বিশ্বযুদ্ধের উপরে নির্মিত বিভিন্ন সিনেমায় দেখা জার্মানদের কথা মনে পড়ে। ওদের প্রতিটি গাড়ী, অস্ত্রের অতিরিক্ত যত্ন নেয়া হত - তাই সবকিছুই চলতো দারুন।

এখানে একজন উড়িষ্যার বাঙালি দাদাবাবু থাকতেন, পশ্চিমবঙ্গে চাকরি, লেখাপড়ার সুবাদে বাংলা দারুন বলতেন। বলতেন এই এটিচ্যুডের পার্থক্যটা বড়ই চোখে পড়ার মত দেশে আর জাপানে। ওখানে কেনা সবচেয়ে দারুন মটরসাইকেল হিরো হোন্ডা কিনে দুদিন পরে আর ঠিকমত স্টার্ট নেয় না। সার্ভিস সেন্টারে বলে - আরে দাদা ওটা ব্যাপার না, কয়েকদিন বেশি করে কিক দিন, ঠিক হয়ে যাবে; অথচ ঐ একই ঘটনা এখানে ঘটলে কী হতো, সার্ভিস সেন্টারের প্রধান দৌড়ে আসতেন, মাথা ঝুকিয়ে গলায় কাতরতা ঢেলে দিয়ে সুমিমাসেন সুমিমাসেন (দূঃখিত অর্থে) বলে একাকার করতেন। তারপর, ওটার বদলে আরেকটা ভালো দেয়ার চেষ্টা করতেন। সার্ভিস চার্জ নিতেন না, কারণ এটা তাঁদের ত্রুটি। --- দাদাবাবু ঠিকই বলেছিলেন মনে হয়।

আমি নিজেও একটু খুতখুতে স্বভাবের মনে হয়। বিশেষত টাইপ করার সময়ে বানানের প্রতি অতিযত্ন নেবার প্রবণতাটাকে ঐ স্বভাবেরই এক রূপে বহিঃপ্রকাশ বলা যেতে পারে। যখনই টাইপ করি, কোন বানানের ব্যাপারে মনে একটু সন্দেহের উদ্রেক হলেই অভিধান ঘাটার চেষ্টা করি। অবশ্য কখনো কখনো খুব ক্লান্ত থাকলে অবশ্য ... ভুল হচ্ছে, এই ধরণের কোন অনুভুতি/সন্দেহই মনে কাজ করে না - ফলে লেখাটা হয়ে যায় দায়সারা গোছের।

অবশ্য শুরু থেকে এমন উৎকর্ষবাদী ছিলাম না। স্কুলে খাতায় এমনভাবে লেখতাম, যে হাতের লেখা দেখে বাবা বলত, যে তুই তো স্যারকে বাসায় টেনে আনবি, কিংবা, তোর হাতের লেখা পড়ার জন্য স্যার তোকে ডেকে নিয়ে যাবে। নিজের হাতের লেখা সম্পর্কে আমার নিজের ধারণাও ওরকমই ছিল। তবে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করতাম, স্যার ঠিকই পড়ে নম্বর দিত -- স্যারদের যোগ্যতা দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে যেত :D । পরবর্তীতে কোন এক সুন্দর দিনে ঠিক করলাম --- নাহ্ এভাবে অন্যদের কষ্ট দেয়া আর নয়। সুন্দর না হোক, অন্তত বেশির ভাগ মানুষ বুঝতে পারে এমন পাঠযোগ্য করে লিখতে হবে। হ্যাঁ - ঠিকই ধরেছেন --- উৎকর্ষবাদীতা আমাকে দখল করলো বোধহয়।

ধুর ...... ...... ব্যাপার ঠিক তা না; একটু খুলে বলিঃ মূল উৎসাহ (!?) বা আগ্রহটা পেয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়; বন্ধু সৌরভ (বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক), কিংবা পান্থ (ওকলাহোমাতে আছে) বা আবীর (সাউথ ডাকোটাতে আছে) সকলের হাতের লেখার পাশে আমারটা খুলতে ইচ্ছা করতো না। কিন্তু আমার ক্লাসনোট নেয়া ছিল খুব ভাল। কোচিং করার সময়েই পান্থর সাথে পরিচয় - ও ব্যাটা চার রঙের কালিতে নোট নিত। কোন লাইন কালো কালি, কোনটা নীল আবার কোনটা লাল বা সবুজ। দেখাদেখি আমিও শুরু করেছিলাম। যা হোক, ক্লাসনোট নেয়ার সময় কালির ব্যবহার আর বিস্তারিত টুকে রাখার জন্য (স্যার এই সময়ে একটু খুক খুক করে কাশলো ... এই টাইপের ডিটেইলিং ;) ) পরীক্ষার আগে কিছু ক্লাসনোট উদাসীন বন্ধু এসে আমার খাতা ফটোকপি করতো পড়ার সুবিধার জন্য। ওদের বরংবার এসে আমাকে ঘুম থেকে তোলা থেকে বাঁচার জন্যই হাতের লেখাটা একটু উন্নয়ন করতে বাধ্য হলাম শেষে (হল/ছাত্রাবাসে থাকতাম)।

সেই সুন্দর করার ইচ্ছাটা মনে প্রভাব ফেলেছিল নিঃসন্দেহে। কারণ নিজের পাঠযোগ্য লেখায় খাতার ফটোকপি দেখে নিজেই মুগ্ধ হতাম - প্রেরণা পেতাম :D ।

থিসিস করার সময় পার্টনার ছিল পান্থ। ব্যাটাও ওরকম। আমি যখন ছেড়ে দিতাম ও তখন দ্বিগুণ উৎসাহে সৌন্দর্য বর্ধনে বসতো। কাজ ছিল সফটওয়্যার বানানো, যেটা যে কোন কাঠামোর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট হিসাব করে দিতে পারবে। কোডিং করার পর ঐ ব্যাটা আবার বসতো সৌন্দর্য বর্ধনে .... ইনপুট, আউটপুট আর গ্রাফিকাল ফিল্ডের রূপচর্চা। থিসিস লেখার সময়ে, ও ব্যাটার জ্বালায় বিরক্ত হয়ে যেতাম .... কিন্তু দেখা যেতো, ও ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিলে আমি আবার একই ভূমিকা নিতাম। সমমনা না হলে আর বন্ধুত্ব কেন ... ...

নিজের অনেক গুণগান করলাম :D । তবে, এখন আর ১০০% শুদ্ধ করার জন্য চেষ্টা করি না আমি। সবসময়ই চেস্টা করি মোটামুটি ৯৫% বা এর বেশি শুদ্ধ করতে। কারণ ৫০-৭০% উৎকর্ষ বা শুদ্ধভাবে লেখার জন্য এ্যাতদিনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা অর্জিত দক্ষতাই যথেষ্ট। কিন্তু সেই ৭০ থেকে আগে বাড়ার জন্য জ্যামিতিক হারে চেষ্টা/যত্নের পরিমানটা বাড়াতে হয়। এসকল ক্ষেত্রে ১০০% সবসময়ই একটি কাল্পনিক ব্যাপার মনে হয়। তাই থামতে জানতে হবে। জানতে হবে কখন ও কোথায় থামতে হবে .... ...তা না হলে ঘষতে ঘষতেই জীবন পার হয়ে যাবে, অন্য কিছুই আর করা হয়ে উঠবে না।


৭-জুলাই-২০০৭
(লেখাটি সচলায়তন এবং খিচুড়ী ব্লগে প্রকাশিত হল)

কোন মন্তব্য নেই: