রবিবার, ১৮ মে, ২০০৮

ছন্দ লেখে কীভাবে?

ছোটবেলাতে ছন্দময় ছড়াগুলো পড়তে দারুন লাগতো। কবিতাগুলোতেও থাকতো ছন্দের ছড়াছড়ি। কিন্তু ইদানিং কঠিন ভাবওয়ালা কবিতাগুলো আর কাছে টানে না। আমর মনে হয়, এরকম সিরিয়াস বিষয়ে মন টানাতে হলে তো কিছু চটুল বিজ্ঞাপনের মত ছন্দের আকর্ষণ থাকতে হবে। না হলে কবিতা হারাবে বেশ কিছু পাঠক।

যা হোক, মাঝে মাঝেই বিভিন্ন জায়গায় ছড়াকারদের যে কোন বিষয়ে মজার মজার ছন্দের উপস্থাপনা দেখে মুগ্ধ হই ... আর ভাবি, এই রকম একটা বিষয়ে এমন ছন্দ আসলো কীভাবে। ইদানিং দেখি প্রজন্ম ফোরাম বা সচলায়তন ব্লগেও ছান্দসিক ছড়াকারের ছড়াছড়ি। দেখে মনে কোনে একটু ইচ্ছা জাগে ... ইশ্ আমিও যদি পারতাম অমন ছন্দ মিলাতে। তারপর হঠাৎ ....দেখি আমার কীবোর্ড থেকেও ছন্দময় লেখা বের হচ্ছে। আমি নিজেই তাজ্জব! যা হোক, ওগুলো কী ছাইপাশ বের হয় তা জানিনা, তবে একদিন প্রজন্ম ফোরামের এডমিন ঘোষনা করল যে ছড়িয়াল ভাইরাসে লোকজন আশংকাজনকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। বুঝলাম ... তাহলে আমার সেই লেখাগুলোও ওনার কাছে ছড়ার মত মনে হয়।

একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম যে, ছন্দ লিখতে বসেই কিছু কথা/শব্দ উল্টাপাল্টা করতে হয়, কিছু প্রতিশব্দ ব্যবহার করতে হয়। তাই ভাবলাম ফর্মূলাটা লিখে ফেলি, ভবিষ্যতে কখনো যদি আবার ছন্দাঘাত করতে ইচ্ছা হয় আর, সে সময় বেরসিকের মত ছন্দের কোষ্ঠকাঠিন্য ঘটে তবে এই ফর্মূলার জোলাপটা খেয়ে নেব। কীভাবে ছন্দ লিখি সেটাই এই লেখায় খুঁজে পেতে চেষ্টা করবো বলে ভাবছি।

অন্ত্যমিল

প্রথম যে জিনিষটা জরুরী সেটা হল অন্ত্যমিল। এবং অন্ত্যমিলগুলোর পার্থক্য সমান হতে হলে ভাল হয়। অর্থাৎ প্রতি লাইনে বা প্রতি দুই/তিন/চার লাইনে। যেমন:

সবাই শুধু মিল খোঁজে ছড়ার এই ভবে
মিল করতেই হবে যে তা কে বলেছে কবে?

মিলের কথা যদি বলো মনে পড়ে যায়,
Meal charge ছিল বেশি Hall-এ থাকার সময়।

প্রথম দিকে শুধু এই ব্যাপারটাই লক্ষ্য রেখে ছড়া লিখতাম (লেখার মকশো করতাম)। কিন্তু ওতে কেমন জানি অপূর্ণতা রয়ে যেত ছন্দের মধ্যে।

ধ্বনিমাত্রা

দারুন ছন্দ হবে যদি প্রতিটা অন্ত্যমিলের মাঝের মোট শব্দাংশের সংখ্যা সমান হয়। ভাষাতত্ত্বে আমি বিশেষ দক্ষ নই। তাই একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা সহজে বোঝার চেষ্টা করি:

ধ্বনির কথা যদি তুমি একটু বুঝতে চাও,
ধ্বনিতত্ত্বের জোলাপটা মাথায় পুরে নাও।

প্রথম লাইনে: ধ্ব-নির্ ক-থা য-দি তু-মি এক্-টু বুঝ্-তে চাও = মোট ১৩টা ভিন্নরকম শব্দাংশ রয়েছে।
দ্বিতীয় লাইনে: ধ্ব-নি-তত্-ত্বের জো-লাপ্-টা মা-থায়্ পু-রে নাও = মোট ১২টা ভিন্নরকম শব্দাংশ রয়েছে।

এখানে শব্দাংশের সংখ্যা বাড়িয়ে ছন্দ ভাল মেলার জন্য আমি দ্বিতীয় লাইনে একটা শব্দ পাল্টিয়ে দেব। জোলাপ এর বদলে ফর্মুলা লিখব। জো-লাপ্ = ২টি শব্দাংশ; আর, ফর্-মু-লা = ৩টি শব্দাংশ। দেখি কেমন শোনায় ...

ধ্বনির কথা যদি তুমি একটু বুঝতে চাও,
ধ্বনিতত্ত্বের ফর্মুলাটা মাথায় পুরে নাও।

উপরের হিসাবটা সম্ভবত পুরাপুরি ঠিক নয়। কারণ শব্দাংশ কোনটা একটু বড় কোনটা একটু ছোট আছে। কাজেই আরও ভাল হয় যদি শব্দাংশকে উচ্চারণে প্রয়োজনীয় সময় অনুযায়ী একটা মাণ দেয়া যায়।

সুতরাং অন্ত্যমিল মেলানোয় লাইন সংখ্যার চেয়ে শব্দাংশের সংখ্যা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সঠিক ভাব ফুটানোর জন্য লাইনের মাঝে বা শেষে যতিচিহ্ন ব্যবহার করতে হয়। ওগুলোতে দেয়া বিরতিটুকুও এভাবে হিসাবের মধ্যে ঢুকিয়ে তারপর সেই অনুযায়ী লিখলে ছড়াটা পড়ার সময় দারুন ছান্দসিক মনে হবে।

উচ্চারণের মাত্রা

অন্ততপক্ষে অন্ত্যমিলের শব্দটির ক্ষেত্রে উচ্চারণের মাত্রা একরকম হলে ভাল শোনায়।বল = খেলার বল হলে উচ্চারণটা হল বল্ এর মত .. অর্থাৎ ল-টার উপরে জোর কম, ব-টাই বেশি শোনা যায়। কিন্তু যদি, বল = কথা বলো এর মত হলে উচ্চারণে ল-টা বেশি প্রাধান্য পায় এবং কানে বাজে।

অন্ত্যমিল দেয়ার সময় শ্রুতিমাধুর্যের জন্য এই উচ্চারণের মিল/অমিলের ব্যাপারটাই খেয়াল করা জরুরী বলে মনে হয়। ঝড়-এর সাথে বড় অন্ত্যমিল করতে চাইলে এই ধরণের গ্যাঞ্জাম লাগবে ... যেমন:

ইদানিং মাঝে মাঝে রাতে আসে ঝড়
ভিজতে নাই মানা হয়েছি যে বড়।

কারণ ঝড়-এ 'ঝ'-টা উচ্চারণের কেন্দ্রে, 'ড়' টা কম উচ্চারিত। অপরদিকে 'বড়' তে 'ড়'-টাই উচ্চারণে প্রাধান্য পায়। তাই অন্ত্যমিলটা ভাল হয় না। কিন্তু যদি এমন হয়,

ইদানিং মাঝে মাঝে রাতে আসে ঝড়
ভিজতে করে মানা বিয়ে করার পর।

যা বলতে চাচ্ছি বুঝাতে পারলাম কি? নিজের জোলাপ হিসেবে কাজ চলবে মনে হয় .... ...


(প্রজন্ম ফোরামে প্রকাশিত)

কোন মন্তব্য নেই: