ভারত ভ্রমনের কবলে!
পরিকল্পনাটা ছিল এমন - ২৩শে সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে জাপানে পি.এইচ.ডি. শেষে দেশে ফিরে একবার ভারত ভ্রমন করবো। কারণ এর পরপরই আমার স্ত্রী মাস্টার্সে ভর্তি হবে তাই এর আগেই ভারত ভ্রমন করতে হবে। তাছাড়া পরবর্তীতে বাচ্চা কাচ্চা হয়ে গেলে ওদের নিয়ে ইউরোপ/আমেরিকা ভ্রমন করা গেলেও ভারত ভ্রমন করা যাবে না।
যেই ভাবা সেই কাজ। ভারতে ভ্রমনের জন্য ভিসার আবেদন করলাম অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে (১লা অক্টোবর)। পরিকল্পনা ছিল স্থলপথে বাসে ঢাকা-কলকাতা হয়ে ট্রেনে দিল্লি তারপর আগ্রা, জয়পুর, আজমির ঘুরে ঢাকা ফেরৎ। ইতিমধ্যে আবার বুয়েটে মাস্টার্সের সার্কুলার দিয়েছে যেখানে আমার স্ত্রী ভর্তিচ্ছু। সামনে পড়েছে ঈদুল ফিতর আর তার পরে পুজার বন্ধ। লম্বা ছুটি বলে ভ্রমনেচ্ছু ভিসাপ্রার্থীপ্রচুর। আমাদের পক্ষেও দেরীতে গেলে ওর মাস্টার্সের ভর্তির আনুষ্ঠানিকতায় অংশগ্রহন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তাই গেলাম ভিসার আবেদনপত্র জমা দিতে।
আগের সপ্তাহেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া আমার ছোটভাই ভারতে বেড়াতে যাওয়ার জন্য ভিসার আবেদন জমা দিতে গিয়েছিল। লাইনে প্রায় ২০০০ প্রার্থীর পেছনে দাঁড়িয়েছিল। তখন একজন দালাল এসে বলেছিলো যে, ৩০০ টাকা দিলে সামনে ভালো জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেবে। অনন্যোপায় হয়ে ও তাই করে প্রায় ২০০ জনের পেছনে দাঁড়াতে পেরেছিলো। ভিসার আবেদনপত্র জমা দিতে পেরেছিলো, ভিসাও পেয়েছিলো। অবশ্য এজন্য ওকে একবার বাসায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র এবং ফলাফলের ফটোকপি দিতে হয়েছিলো ছাত্রত্ব প্রমাণের জন্য। ভিসার জন্য এমন লম্বা লাইনের কথা শুনে একটু আশাহত হয়েছিলাম। পরবর্তীতে আমার স্ত্রীর পরিচিতা একজন জানালেন যে, মহিলাদের লাইন অনেক ছোট হয় আর সেখানে জমা নেয় তাড়াতাড়ি।
আমার এবং স্ত্রীর ভিসা আবেদনপত্র জমা দিতে সকাল ৭টায় হাজির হলাম ভিসা অফিসের কাছে। পুরুষদের লাইন ভিসা অফিস থেকে বেশ দুরে অবস্থিত গুলশান শুটিং ক্লাবের সামনে চলে এসেছে ইতিমধ্যে, কিন্তু মহিলাদের লাইন অনেক ছোট - ১৩৪ জনের পেছনে দাঁড়ালো। জমা নেয়ার সময়ও মহিলাদের ক্ষেত্রে দ্রুত জমা নিল এবং সকাল ১০:৩০ এর মধ্যে জমা দিয়ে বের হয়ে এলো। অবশ্য টুরিস্ট ভিসার জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার শেষ সার্টিফিকেটের ফটোকপি চাইলো।
পরদিন পেয়ে গেলাম দুটি পাসপোর্ট। স্ত্রীকে ভিসা দিয়েছে আর আমারটিতে ভিসা দেয়নি। পাসপোর্ট তুলতে গিয়েছিলো আমার স্ত্রী - ও কাউন্টারে জিজ্ঞেস করেছিল কেন এই অবস্থা? বলেছিলো যে আমার কাগজপত্রে ওদের মনে সন্দেহ হয়েছে - শিক্ষাগত সার্টিফিকেটের সত্যয়িত ফটোকপি (অনুলিপি) দিতে হবে!! দুজনের কাগজপত্র একই হওয়া সত্ত্বেও একজনকে নিঃসন্দেহে ভিসা দিল আর আরেকজনকে দিল না ... তা-ও টুরিস্ট ভিসার আবেদনে শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট চেয়ে!
আমার শ্বাশুড়ী শিক্ষকতা করেন। সাম্প্রতিক সময়ে ওনার কয়েকজন সহকর্মীও ভিসার জন্য আবেদন করেছিলেন ... স্ত্রীকে দিয়েছে স্বামীকে দেয়নি - এমন হয়েছে সকলের ক্ষেত্রেই। আমার শ্বশুড়ের পরিচিত অনেক সহকর্মীরও একই অবস্থা। কিছু কাহিনী শুনলাম যে, বাবা-মা, আর বাচ্চার মধ্যে বাচ্চাকে ভিসা দিয়েছে, বাবা-মা কে দেয়নি। চিকিৎসার্থে ভারতগামী রোগীর সহযাত্রীদের ভিসা হয়েছে কিন্তু রোগীর হয়নি। অথচ, ভিসা অফিসের বাইরে কিছু লোক বলছে যে পাসপোর্ট প্রতি ৪০০০ টাকা দিলে ভিসা পাইয়ে দিবে। এসব দেখে মূলা ঝূলানো স্টাইলে ভিসা দেয়ার কারণ অনুমান করা যায়!
যা হোক পরদিন আবার সকাল ৬:৩০শে গিয়ে লাইনে দাঁড়ালো। এত সকালেও প্রায় ৩০০ জন মহিলার পেছনে দাঁড়ালো আমার স্ত্রী। আজকে কিন্তু আগের দিনের মত মহিলাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফর্ম জমা নেয়নি। শেষ পর্যন্ত প্রায় ১২:৩০শে ভিসা জমা দিতে ঢুকে ২:৩০শে জমা দিয়ে বের হয়ে আসলো। সাধারণত দুপুর ১২টা পর্যন্ত ফর্ম জমা নেয়, কিন্তু প্রার্থী বেশি বলে প্রায় দুপুর ১টা পর্যন্ত ফর্ম জমা নিয়েছে । কিন্তু তা পরদিনের খাতে জমা নেয়া দেখিয়েছে। পরদিন বৃহস্পতিবার হওয়ায় ওদিনের জমা পাসপোর্ট ফেরৎ দিবে পরের রবিবার (শুক্র, শনি সাপ্তাহিক বন্ধ)। আমার ছোটভাইয়ের স্ত্রীও লাইনে দাঁড়িয়েছিলো কিছুটা পেছনে। ওর ১০/১২ জন আগে গেট বন্ধ আর জমা নিবে না বলে ঘোষণা আসলো, অথচ তার কিছুক্ষণ আগে কনসুলার এসে বলে গিয়েছিলো যে সমস্ত মহিলাদের জমা নেয়া হবে। বেচারী ৭টায় এসে লাইনে দাঁড়িয়েছিলো। নিরাপত্তারক্ষীগণ টাকা খেয়ে লাইনের সামনে কয়েকজনকে ঢুকিয়েছে .... এরা (নিরাপত্তারক্ষীরা) লাইনের পেছনের দিকে এসে বলে লাইন সোজা করেন ইত্যাদি, আর সামনের দিকে লাইন নেই - সব বিশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে। তাদেরকে যতই বলা হয় সামনের লাইন ঠিক করেন ততই না শোনার ভান করে ... ওখানে অবৈধভাবে লাইনে দাঁড় করাচ্ছে, কাজেই লাইন সোজা হলে তো সমস্যা! এই দিন ছিলো প্রচন্ড গরম। গরমে ডিহাইড্রেশন হয়ে বেচারী কাহিল, রাস্তায় প্রায় পড়ে যাওয়ার দশা।
ইতিপূর্বে অতিকষ্টে রবিবার রাত্রে ছেড়ে যাওয়া ঢাকা-কলকাতা বাসের টিকিট পেয়েছিলাম। তাই রবিবার বিকালে খুব চিন্তায় থাকলাম পাসপোর্ট ফেরৎ পাওয়া নিয়ে। কিন্তু আমার পাসপোর্ট আর পাওয়া গেল না। ওদিকে অফিসের ভেতরে আমার স্ত্রীর তদন্তে বের হল যে, যেগুলো পাসপোর্টে ভিসা দিয়েছে সেগুলোতেও আমার পাসপোর্ট নেই, যেগুলো ভিসা পায়নি সেগুলোতেও নেই। সম্ভবত আমাকে সাক্ষাতকার নিতে ডাকবে। আমার বাসের টিকিটের দেড় হাজার টাকাও গচ্চা গেল।
পরদিন আমাকে ভিসা অফিস থেকে ফোন করে সাক্ষাতকারের স্লিপ সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে বললেন। তারও পরের দিন সাক্ষাতকার দিতে গেলাম। এবার আমার চাকুরীর কাগজপত্র দেখতে চেয়েছেন কর্তৃপক্ষ (!! টুরিস্ট ভিসা চেয়েছিলাম)। সাক্ষাতকারটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক ছিলো আমার জন্য।
বললো, আপনি এর আগে গতবছর ভারতে গিয়েছিলেন ... বললাম হ্যা মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা ছিল, প্রফেশনাল কাজে গিয়েছিলাম। আমার রেফারেন্সের কথা জিজ্ঞেস করল ... জানালাম একজন আমার আপন মামা, আরেকজন একটি এন.জি.ওর প্রধান যার সাথে আমাদের প্রফেশনাল কাজ হয়। আমাকে চাকুরীর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করাতে বললাম যে আমি দুই সপ্তাহ আগে জাপান থেকে ফিরেছি, এই মুহুর্তে বেকার। জাপান যাওয়ার আগের কাগজপত্র দেখতে চাইলো তখন ... বললাম, সেগুলো আমার আছে তবে সাথে নিয়ে আসিনি, তাছাড়া আমার আর ভিসার প্রয়োজন নেই, এমনকি ভিসা দিলেও আমি ভারতে যাবো না, কারণ আমার বাসের টিকিট করা ছিলো আরো দুই দিন আগে; এখন চেষ্টা করলেও টিকিট পাবো না, আর ঈদ/পূজার বন্ধের পরেও আমার যাওয়া সম্ভব নয় কারণ আমার স্ত্রীর মাস্টার্সের ভর্তি সংক্রান্ত কাজগুলি পড়বে সেই সময়ে। জবাবে সাক্ষাতকারগ্রহনকারী বলেন যে এমন করলে আপনি কিন্তু আপনার পাসপোর্ট আর ফেরৎ পাবেন না। আমি লোকটির স্পর্ধা দেখে অবাক হয়ে গেলাম - আমার দেশে বসে আমার পাসপোর্ট আটকে রাখতে চায়!! পরে মনে হল, উল্টা পাল্টা বলে আমাকে ভয় দেখাতে চাচ্ছে যেন আমি অন্যপথে যেতে চাই (বাইরে তো দালালরা দাঁড়িয়ে আছেই)। যা হোক আমি জবাবে বললাম, আমার পাসপোর্ট ফেরত পাওয়ার অধিকার আমার রয়েছে। শুনে ব্যাটা বলে যে, আমার রিপোর্টের উপর নির্ভর করছে আপনার পাসপোর্টের কী হবে, এমন হতে পারে আপনাকে আর কখনো ভারতে ভিসা দেয়া হবে না .... আমি বললাম, আমার অসুবিধা নেই। তখন ঐ লোক আরো বলে, এমন হতে পারে আপনার পাসপোর্ট আমরা ফেরৎ দেবো না, আপনার দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে ফেরৎ পাবেন ... জবাবে আমি বললাম, আমার কোনই অসুবিধা নেই, আপনার যেমন ইচ্ছা রিপোর্ট লিখুন তবে আমার পাসপোর্ট ওভাবে ফেরৎ দিলে আমাকে সঠিক ভাবে সেটা আপনাদের জানাতে হবে। তবে পাসপোর্টটি আগামী ১৭ তারিখের আগে ফেরৎ দেবার দরকার নেই। আজ সন্ধ্যায় আমি কুড়িগ্রাম যাচ্ছি। চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কুড়িগ্রাম কোথায়? ... বললাম দেখুন আমার পাসপোর্টে আমার স্থায়ী ঠিকানা লেখা আছে, ওখানে আমার দাদার বাড়ী। ভারতে যেহেতু যেতে পারছি না, তাই ওখানেই যাবো; আমাকে ভিসা দেয়ার দরকার নেই, শুধু পাসপোর্টটি ফেরৎ দিবেন। সাক্ষাতকার শেষ। আমি জিজ্ঞেস করলাম আমার পাসপোর্টের জন্য কোথায় যোগাযোগ করবো - বললেন যেখানে জমা দিয়েছেন সেখানে। এখানে বলে রাখা ভালো, সাক্ষাতকারটি হয়েছে ভারতীয় দূতাবাসের ভিসা সেকশনে, আর পাসপোর্ট জমা নেয় অন্য একটি ভবনে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার অধীনে।
আমার ছোটভাই অতিকষ্টে বাসের দুটি টিকিট কেটে রেখেছিলো লালমনিরহাট হয়ে বুড়িমারী সীমান্ত পথে ভারত যাওয়ার উদ্দেশ্যে কিন্তু ওরা তো ফর্ম জমা দিতেই পারেনি। তাই ঐ টিকিটে আমি আর আমার স্ত্রী লালমনিরহাট হয়ে কুড়িগ্রাম চলে গেলাম। বেশ আনন্দের সাথে ঈদ করলাম সেখানে।
২২-অক্টোবর গিয়েছিলাম পাসপোর্ট আনতে। দেখি, পাসপোর্ট এসেছে (সাক্ষাতকার গ্রহণকারী ব্যাটা আমাকে ব্লাফ দিয়েছিলো) আবার ভিসাও দিয়েছে ১৫ দিনের। এই ভিসার জন্য গুলশান যাতায়াত আর কলকাতার বাস-টিকিট মিলিয়ে প্রায় তিন হাজার টাকা নষ্ট হয়েছে আমার। অবশ্য ভারত ভ্রমনে গেলে এর ১৫/২০ গুণ বেশি খরচ হত নিঃসন্দেহে ... সেটা থেকে বেঁচে গেলাম (আঙ্গুর ফল টক )।
ভিসার আবেদন করতে যে ভোগান্তি হল সেটা কোন সভ্য দেশে হতো না বলেই মনে হয়। জাপানে থাকা অবস্থায় পাসপোর্ট নবায়ন করিয়েছি বাংলাদেশ এম্বেসী থেকে -- সবই ডাকযোগে। এছাড়াও আমি জাপানে থাকা অবস্থায় সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভারত, নেপাল, ভিয়েতনামের ভিসা পেয়েছি অনায়েসে। এমনকি ভারতের ভিসার জন্য তো কনসুলার অফিসেও যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। ফোনে কনসুলার সাহেবের সাথে কথা বলে ওনার কথামত সব কাগজপত্র ও পাসপোর্ট ডাকযোগে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম আর ওনারাও ভিসা দিয়ে ডাকযোগে ফেরৎ পাঠিয়েছিলো কাগজপত্র। ঢাকা থেকে আমার স্ত্রী সিঙ্গাপুরের ভিসার জন্য আবেদন করেছিলো ইতিপূর্বে - সিঙ্গাপুর এন্বেসী থেকে ১০টি সংস্থাকে (ট্রাভেল এজেন্সী) ভিসা প্রসেসিং ক্ষমতা দিয়েছে। ভিসার জন্য যে কোন সময়ে ওগুলোর কোনটাতে গিয়ে কাগজপত্র এবং প্রসেসিং ফী জমা দিলেই ওরা পরদিন সেগুলো এম্বেসীতে নিয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে সাক্ষাতকার গ্রহনের জন্য ডাকে আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাক্ষাতকার ছাড়াই ভিসা দিয়ে দেয় বলেই শুনেছি। আমার স্ত্রীর ভিসার জন্য সাক্ষাতকার দরকার হয়নি। গত সপ্তাহে দেখলাম ব্রিটিশ এম্বেসী অনলাইনে ভিসা আবেদন করার পদ্ধতি চালু করেছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো কোথায় পড়ে আছে!
1 টি মন্তব্য:
আর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কথা বলে আর লাভ কি..। লোকজনের বেঁচে থাকার মৌলিক উপাদানই দিতে পারছে না..টেকনোলজি!!!!
লেখাটা আরো কয়েক পর্ব করলে ভাল লাগতো। :)
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন