বুধবার, ৪ এপ্রিল, ২০১২

হালকা ক্রান্চব্যাংগ GNU/লিনাক্স

যতই দিন যাচ্ছে ততই রিসোর্সের জন্য ক্ষুধার্ত অপারেটিং সিস্টেম তৈরী হচ্ছে। বাণিজ্যিক অপারেটিং সিস্টেম তৈরীকারকগণও নতুন নতুন হার্ডওয়্যার বিক্রয়ের গ্যারান্টি হিসেবে এমন সব অপারেটিং সিস্টেম বানাচ্ছে যা চালাতে নতুন হার্ডওয়্যার কিনতে হবে। কিন্তু বিভিন্ন অফিস ও ক্লাসরুম চলে পুরাতন এবং দূর্বল পিসি দিয়ে - যা রাতারাতি বদলানো সম্ভব নয় আর জরুরীও নয় (কারণ ওগুলো নষ্ট হয়নি, দিব্যি চলছে)। তাই ওগুলোর জন্য চাই হালকা কিন্তু কাজের অপারেটিং সিস্টেম।
- সিস্টেমটা এমন হতে হবে যেন আউট অব দ্যা বক্স কাজ করে। অর্থাৎ ইন্টারনেট থেকে কিছু ডাউনলোড না করেই এটা দিয়ে অন্তত অফিসের কাজ করা যায়, কিছুটা বিনোদনের ব্যবস্থা করা যায় (অর্থাৎ এমপিথ্রি আর মুভি চলবে)।
- বৈধভাবেই বিনামূল্যে হওয়া জরুরী।
- চাইলে আপডেট এবং আরও সফটওয়্যার ইনস্টল করে নেয়া যায়।
- স্টুপিড ফ্রেন্ডলী হওয়া জরুরী না, তবে অনলাইনে সাপোর্ট হলে ভাল হয়।

আমি এজন্য বেছে নিয়েছি জার্মানিতে জন্ম নেয়া নপিক্স (knoppix)। অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম নেয়া পাপিও (puppy GNU/linux) যথেষ্ট ভাল - সত্যি বলতে কি, হার্ডওয়্যারকে পাপির চেয়ে দ্রুত কোথাও চলতে দেখিনি এপর্যন্ত। তবে আমার অফিসের জরুরী কাজ এতে করা যায় না। কারণ এটার লাইভ সিস্টেমে ওপেন অফিস বা লিব্রে অফিসের মত শক্তিশালী অফিস সফটওয়্যার নাই - তবে সিস্টেম এডমিনদের জন্য কিংবা কারো বসে যাওয়া সিস্টেম থেকে তথ্য বের করে আনার জন্য এটার জুড়ি নাই ... আর হ্যাঁ সাধারণ মাল্টিমিডিয়ার ফাইল এর লাইভ সিস্টেম থেকেই চালানো যায় (১২৮ মেগাবাইট সাইজের একটা অপারেটিং সিস্টেমে এর চেয়ে বেশি পাওয়া সম্ভব বলেও মনে হয় না)। নপিক্সের ডেস্কটপও খুব হালকা - এর মধ্যেও বোনাস হিসেবে ফাটাফাটি গ্রাফিকাল ইফেক্ট আছে; মাল্টিমিডিয়া ফাইলও চলে। তবে আমার জন্য আকর্ষনীয় এবং হালকা ডিস্ট্রিবিউশন হিসেবে এর ব্যতিক্রম হল, এতে লিব্রে অফিস দেয়া থাকে। ফলে লাইভ সিস্টেম থেকেই দূর্বল পিসিতেও দরকারী সব কাজ করে ফেলা যায়। ক্লাসরুমের ২৫৬ মেগা মেমরির পিসিতে ইনস্টল দিয়ে রেখেছি - সুন্দর চলছে।

বেশি ভাল ভাল না। নপিক্সকে লাইভ সিস্টেম হিসেবে চালানোর জন্য নকশা করা হয়েছে। তারপরেও সেটা আমি নেটবুকের হার্ডডিস্কে ইনস্টল করে চালাই। দুইটা কারণে মাঝে মাঝে নপিক্স পাল্টাতে ইচ্ছা করে: প্রথমত - এটার আপডেট হয় না তেমন একটা; ফলে বিভিন্ন সফটওয়্যারের সর্বশেষ উন্নততর ভার্সন সবসময় পাওয়া যায় না। এটা ডেবিয়ান ভিত্তিক GNU/লিনাক্স ডিস্ট্রিবিউশন হলেও পুরাপুরি ডেবিয়ান নয়, নিজস্ব কিছু টুইক আছে যার আপডেট পাওয়া যায় না। আর অন্য সমস্যা হল এতে ইউজার তৈরী করা যায় না (এটা হয়তো সত্যি না পুরাপুরি)। ডিফল্ট ভাবে নপিক্স নামেই সবকিছু করে।

তাই ভাবছিলাম, ডেবিয়ানের উপরেই ভিত্তি করে তৈরী হালকা অন্য কিছু পাই কি না যেটাতে ডেবিয়ানের পূর্ণ সাপোর্ট ও আপডেট থাকবে আর হালকা হওয়া সত্বেও আউট অব দ্যা বক্স লিব্রে অফিস থাকবে। (উবুন্টু ডেবিয়ান ভিত্তিক, মিন্ট উবুন্টু তথা ডেবিয়ান ভিত্তিক) এই খোঁজাখুঁজির কাজ মোটেও সহজ না। সবখানে কী কী সফটওয়্যার থাকে সেই তালিকা সরাসরি পাওয়া যায় না। ডাউনলোড করে নিয়ে দেখতে হয়। অনেকদিন ধরেই ক্রান্চব্যাংগ (Crunchbang) লিনাক্সের নাম শুনি/পড়ি একটা ডেবিয়ান ভিত্তিক হালকা কিন্তু দারুন কাজের ডিস্ট্রিবিউশন হিসেবে। মূল ডেবিয়ান উবুন্তু বা মিন্টের চেয়ে একটু কম স্টুপিড ফ্রেন্ডলি হলেও আমার ৫+বছরের GNU/লিনাক্স চালানোর অভিজ্ঞতার সাহসে ডেবিয়ানের এই ডিস্ট্রিবিউশনটা টেস্ট করে দেখবো বলে ভাবলাম ... দেখা যাক নেটবুক থেকে নপিক্স পাল্টানো যায় কি না।


ওদের ওয়েবসাইটে কী লিখেছে?

CrunchBang, ডেবিয়ানের উপরে তৈরী একটি GNU/লিনাক্স ভিত্তিক হালকা ডিস্ট্রিবিউশন, যা দারুন দ্রুতগতির, স্টাইলিশ এবং কাজের। দ্রুতগতির কারণ হল এর মধ্যে ওপেনবক্স উইন্ডো ম্যানেজার দেয়া হয়েছে - যা অত্যন্ত হালকা; এছাড়া এটাকে নিজের মত করে সাজিয়ে (কাস্টমাইজ) করে নেয়া যায়। এটা চালালে পিসির গতি বা কর্মক্ষমতাকে একটুও না কমিয়ে আধুনিক, সব সুযোগসুবিধা সম্পন্ন একটা সিস্টেম পাওয়া যাবে।


মূল সাইট: http://crunchbanglinux.org/
আইকন:

ডাউনলোড: http://crunchbanglinux.org/downloads/ (৬৬২ মেগাবাইট)

দিলাম ডাউনলোড। এই ধরণের বড় বড় ফাইল ডাউনলোডের জন্য প্রথম পছন্দ টরেন্ট। ক্রান্চব্যাঙ্গের টরেন্ট ডাউনলোড দেয়ার পর সিডার হিসেবে কোন দয়াল বান্দাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই ভাবলাম সরাসরি ডাউনলোড দেই। সরাসরি ডাউনলোড করলাম ঝামেলা ছাড়াই। ডাউনলোড করার পর আমার ইউএসবি পেনড্রাইভটাকে এটা দিয়ে বুটেবল করে নিলাম। সেই পেনড্রাইভ থেকে বুট করার সময়ে দেখলাম লাইভ সিস্টেম ছাড়া সরাসরি ইনস্টলার চালু করার অপশন আছে কয়েকটা (গ্রাফিকাল, টেক্সট বেজড ইত্যাদি)। লাইভ বুট করার পর এটার মূল ডেস্কটপ দেখে তো অবাক হওয়া শুরু হল:

ডেস্কটপের ডানদিকে চমৎকার একটা কংকি দেয়া আছে। যেটাতে বিভিন্ন শর্টকাট কী এবং সিস্টেমের বিভিন্ন তথ্য দেখাচ্ছে। আহ্ কংকি দেখলেই কেমন গিক গিক মনে হয় ... ডানদিকের কংকিতে প্রথমে ৮৬ মেগাবাইট র‍্যাম ব্যবহৃত হচ্ছিল বলে দেখাচ্ছিল। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আমার কিউবি গিগাসেটের কানেকশন পেয়ে গেল এবং নোটিফিকেশন জানিয়ে দিল যে আমরা এখন ইন্টারনেটে যুক্ত আছি - এজন্য আমাকে কিছুই করতে হয় নাই!

নিচের স্ক্রিনশটটি নেয়ার সময়ে ব্রাউজার চালিয়ে নিলাম। যথারীতি এটা আইসউয়িজেল - যা আসলে ফায়ারফক্সেরই ডেবিয়ান ব্র্যান্ডিং। হ্যাঁ কোন কিছু করা ছাড়াই বাংলা ঠিক দেখাচ্ছে। স্ক্রিনশট নেয়ার জন্য মেনুতে আইটেম থাকলেও সরাসরি কীবোর্ডের PrtSc বা Print Screen বাটন দিয়ে নেয়া যাবে বলে কংকির সর্বশেষ লাইনে লেখা আছে দেখলাম। তাই ওভাবেই স্ক্রিনশট নিতে বলে কয়েক সেকেন্ড পর স্ক্রিনশট নেয়ার অপশন নিলাম। স্ক্রিনশট নেয়ার সময়ের আগেই আরেকবার প্রিন্টস্ক্রিন বাটন ব্যবহার করাতে সেই মেনুটা আসল - স্ক্রিনের নিচের দিকে ডান দিকে দেখতে পারছেন। এছাড়া ডেস্কটপের যে কোনো জায়গায় মাউস ক্লিক করলে নিচের চিত্রের মতই মূল মেনু খুলে।
তবে আমার জন্য খারাপ খবর হল এতে লিব্রে অফিস নাই। ইনস্টল করার জন্য একটা লিংক আছে অবশ্য (ছবি দ্রষ্টব্য)।

এই মেনুটা ঘাটাঘাটি করে এতে কি আছে তা জানা গেল অনেকটাই। মেনুর নেটওয়র্ক সাবমেনুত অপশনগুলো এখানে দেখালাম। ড্রপবক্স ইনস্টল করার অপশন দেয়া আছে!
এছাড়া ব্রাউজার একটা ছাড়াও গুগল ক্রোম এবং অপেরা ইনস্টল করার জন্য সরাসরি লিংক দেয়া আছে।
আরে রিমোট ডেস্কটপ করার জন্যও প্রোগ্রাম দেয়া আছে দেখছি ... । আমি অবশ্য কখনও এটা ব্যবহার করিনি, তবে যা জানি সেটা হল এটা দিয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমেই একজনের ডেস্কটপে আরেকজন কাজ করতে পারবে। বিশেষ করে সাপোর্ট দেয়ার জন্য এটা অনন্য পদ্ধতি। যেই ভিউয়ারটা দেয়া আছে এটা চালু করলে আপনার পছন্দের কেউ আপনার অনুমতি সাপেক্ষে অন্য জায়গা থেকে আপনার ডেস্কটপ চালাতে পারবে (বিষয়টা অনেকটা ভৌতিক ব্যাপারের মত)। আর পরের VNC সার্ভার (ভার্চুয়াল নেটওয়র্ক কম্পিউটিং) ইনস্টল করলে এইটা থেকে আরেকজনের পিসিতে অনুমতি সাপেক্ষে কাজ করা যাবে।
এবার দেখি মাল্টিমিডিয়া হিসেবে কী আছে .... হুমম, সকলের পরিচিত VLC প্লেয়ার।

গ্রাফিক্স সফটওয়্যার হিসেবে গিম্প সাথেই দেয়া আছে। এই মেনুর স্ক্রিনশটগুলো সেই গিম্প দিয়েই সাইজ করে রেখেছি। আমার ডেস্কটপে গিম্প হার্ডডিস্ক থেকেও এত দ্রুত এর আগে কখনো চলেছে বলে মনে পড়ছে না। তবে আনন্দের চোটে সেই মেনুর স্ক্রিনশট নিতেই ভুলে গিয়েছি!

এবার দেখি অ্যাকসেসরিজ মেনুতে কী আছে ... জিনি টেক্সট এডিটর। আমি যতদুর জানি এটা যেন তেন এডিটর না, এটা একটা দারুন IDE ( ইন্টিগ্রেটেড ডেভলপমেন্ট এনভায়রমেন্ট) - প্রোগ্রামার আর ডেভলপারদের জন্য দারুন একটা জিনিষ। আমি প্রোগ্রামিং তেমন একটা পারি না দেখে এটা চালিয়ে দেখি নাই অবশ্য ...। সরাসরি রুট হিসেবে ফাইল ম্যানেজার খোলার অপশন আছে একটা।
ফাইল ম্যানেজারটা দেখতে ততটা খারাপ না কিন্তু ... আমার যেই ইউ এস বি থেকে বুট করেছিলাম, সেটার ভেতর থেকেই ফাইল খুলে দেখলাম। চমৎকার ছোটো আইকন দেখাচ্ছে ... এমনকি লিব্রে অফিস না থাকা সত্বেও এতে করা ড্রইং ফাইলটার সঠিক প্রিভিউ আইকন দেখাচ্ছে।

ফাইল ম্যানেজারের আরও একটা স্ক্রিনশট দেখা যাক। আমার পিসির একটা হার্ডডিস্কে এর স্ক্রিনশটগুলো রাখা ছিল। একটা ফাইলের উপরে ডান মাউস ক্লিক করাতে বিভিন্ন রকম অপশন এসেছে। আমি অবশ্য Open with GNU Image Manipulation Program ( এটা হল গিম্প/GIMP এর পুরা নাম) দিয়ে এডিট করার অপশনটা ব্যবহার করেছিলাম। নিচের স্ট্যাটাসবারে নির্বাচিত ফাইলটার আরো কিছু তথ্য দেখাচ্ছে।


গিক লোকজন নিশ্চয়ই এতক্ষনে আমার বর্ণনায় অতীষ্ট হয়ে ভাবছেন যে সেটিং আর সিস্টেমে কী কী আছে দেখায় না কেন ... দেখুন সেই মেনু আইটেমগুলো। সেটিংএর মধ্যে আবার কংকি এডিট করার জন্যও অপশন দিয়ে রেখেছে। এছাড়া নিচে আরো অনেকগুলো কাজের এবং অকাজের (যেমন ওয়ালপেপার পরিবর্তন) অপশন দেখা যাচ্ছে।
ওয়ালপেপার পরিবর্তন কোন জরুরী কাজ কি না জানিনা। তবে এটাতে ওয়ালপেপার পরিবর্তনের সিস্টেমটাও বেশ পরিচ্ছন্ন ...। আর সেই প্রোগ্রামের নামটাও কিন্তু বেশ: নাইট্রোজেন!
সিস্টেম মেনুতে সফটওয়্যার ইনস্টল করার জন্য সুপরিচিত সিন্যাপ্টিক প্যাকেজ ম্যানেজার আছে। এছাড়া পার্টিশন এডিটর হিসেবে জিপার্টেড খুবই চমৎকার একটা সফটওয়্যার।
মেনু থেকে এক্সিট চাপলে বন্ধ করার অপশন আসে। সেটার মধ্যেও কয়েকরকম অপশন আছে:

ক্রান্চব্যাংগ GNU/লিনাক্সে আউট অব দ্যা বক্স (অর্থাৎ লাইভ সিস্টেম থেকেই) মাল্টিমিডিয়া সাপোর্ট আছে, তাই এমপিথ্রি আর ভিডিও ফাইল চলবে অনায়েসে। আমি প্রমাণ দেইনি তো কি হয়েছে, উইকিপিডিয়াতে নিশ্চয়ই মিথ্যা কথা লিখবে না (http://en.wikipedia.org/wiki/CrunchBang_Linux)।

এছাড়া এটার মধ্যে অনেকগুলো (২০ কিংবা বেশি) উইন্ডো থিম, আইকন থিম আছে যা থেকে একটা পছন্দ করতে গেলেও অনেক সময় নষ্ট করতে হয়!

আমার মনে হচ্ছে এটাকে হার্ডডিস্কে ইনস্টল করা যেতে পারে। ইনস্টল করে লিব্রে অফিস ছাড়াও আমার আরও কিছু সফটওয়্যার লাগবে, যা সিন্যাপটিক প্যাকেজ ম্যানেজার থেকে অনায়েসে করা যাবে বলে মনে হয়। আমার ধারণা, GNU/লিনাক্সে একেবারে নতুন কেউ হলেও এটার লাইভ সিস্টেম নিয়ে খেলাধুলা করে নিরাশ হবে না। তবে অভিজ্ঞতা ছাড়া এটা ইনস্টল করতে যাওয়া একটু বিপদজনক হতে পারে - এই কথাটা অবশ্য উবুন্টু কিংবা মিন্টের জন্যও প্রযোজ্য।