শনিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০০৭

শ্রোতার বিবর্তন

এখন দেশ থেকে দুরে থাকি। দেশের গান টাটকা শুনতে পারি না, আর জানিওনা যে কোন কোন নতুন গায়ক/গায়িকা/ব্যান্ড আসছে, ঝড় তুলছে। ভরসা ইন্টারনেট। তাছাড়া গত ৩ বছরে প্রায় ১২ বার দেশে গিয়েছি গবেষণার স্যাম্পলিং এর কাজে, প্রতিবারই কিছু এম.পি.থ্রী বা ভিডিও সিডি/ডিভিডি নিয়ে এসেছি। আরও এনেছি বেশ কিছু ক্যাসেট - যে গাড়ীটা ব্যবহার করি, ওটা বেশ পুরানো মডেল। শুধু ক্যাসেট প্লেয়ার আছে। এখন অবশ্য সিডি প্লেয়ার থেকে সেখানে গান বাজানোর একটা সিস্টেম করেছি। তাই গানের প্রবল অভাব অনুভব করি না।

বিবর্তন বলতে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন বুঝায়। আমি শ্রোতা হিসেবে আমার পছন্দের বিবর্তনকে ক্রোনোলজিকাল অর্ডারে দিলাম।

আম্মার কাছে গল্প শুনেছি... যখন গ্যাদা বাচ্চা ছিলাম তখন নাকি সেজ চাচা রেডিওতে গান ছেড়ে দিয়ে আমার সামনে এসে লিপসিং করত। আমি হা করে দেখতাম। হয়ত ভাবতাম, আহারে এই লোকটা কত ভাল গান গায় ..... ...

যখন বেশ ছোট ছিলাম: প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম তখন বাসায় গান শুনতো ছোটচাচা। বিভিন্ন রকম হিন্দি গান, নজরুল আর রবীন্দ্র আর অাধুনিক। ওনার গলায় গান শুনে নিজেরও ওভাবে গাইতে ইচ্ছা করত। তখন শুনতাম: আমি চিনি গো চিনি তোমারে....; আমি দুর হতে তোমারে দেখেছি ইত্যাদি গান। ভূপেন হাজারিকা'র গানও ভাল লাগত শুনতে। আবার হেমন্তের ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে... মুখস্থ ছিল।

হাইস্কুলের শেষের দিক ছিল ব্যান্ডের যুগ। ঈদের সালামি দিয়ে শুধু ক্যাসেট কিনতাম ..... চাইম, ফীডব্যাক, উইনিং, ডিফরেন্ট টাচ, অবসকিওর শুনতাম খুব। তারপর হলাম এল.আর.বি'র ভক্ত। সাথে সাথে ইংলিশ রক শুনতাম খুব। তবে সেটার সোর্স ছিল প্রতিদিন দুপুরে রেডিওর ওয়র্ল্ড মিউজিক অনুষ্ঠানটি। দুইটা সিনেমার ট্রেইলার শুনে ওয়র্ল্ড মিউজিক মিস করতাম না বাসায় থাকলে। মূলতঃ সেখান থেকেই বিভিন্ন বিদেশী শিল্পীর গান পছন্দ করা শুরু করলাম।

আব্বার ঝোক ছিল মারেফতি বিষয়ের প্রতি। তাই উনি গিয়ারে থাকলে, ক্যাসেটপ্লেয়ার ফ্রী-পাওয়া যেত না। তখন লালণগীতি এবং অন্যান্য বাউল সংগীত খুব বাজত বাসায়। আবার কখনো ডেকে জোর করে তা শুনানো হত। আশেপাশে শেয়ার করার কাউকে না পেয়ে লালণগীতির মর্মকথা আমাকেই ব্যাখ্যা করে শুনাতো। আমি আব্বার মন রক্ষার্থে সেসব চিরতার পানির মত গিলতাম। অবস্থা এমন দাড়িয়েছিলো যে, মনে লালনগীতি ভীতি ঢুকে গিয়েছিলো। স্কুল থেকে বা খেলা শেষে বাসায় ফেরার সময় দুর থেকে লালন বা বাউল বাজতে শুনলেই, বাসায় ঢোকার সময় বেড়ালের মত নিঃশব্দে ঢুকে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে বাইরে ভেগে যেতাম! বা চুপে চুপে থাকতাম বাসায়।

১৯৯০ সালে এস.এস.সি. পাশ করলাম। এরপর নটরডেম কলেজে ভর্তি হলাম। বাসা মিরপুর ১১তে। প্রতিদিন বাসা টু কলেজ আসা যাওয়া করে আর কলেজের পড়ার চাপে সব সময় আর গান শোনার শক্তি থাকত না। তারপরেও যাওয়া আসার পথে গুলিস্থানের স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে ক্যাসেট কিনেছি মাঝে মাঝে। রেডিওর ওয়র্লড মিউজিকে গান শুনেছিলাম, তাই কিনলাম Def Leppard ব্যান্ডের একটা ক্যাসেট। ভাল কোয়ালিটির ক্যাসেট বলে দাম নিল ৯০ টাকা, যেখানে সাধারণ ক্যাসেটের দাম ছিল ৩৫-৪০ টাকা। গান শুনে তো মুগ্ধ। এরপর একে একে Iron Maiden, Metallica, AC DC কিনলাম। তাছাড়া অন্যান্য পুরানো হেভী মেটাল ব্যান্ডের গানও শুনতাম। পাশাপাশি Rap শুনতেও খারাপ লাগত না তেমন --- তবে সেই ভাল লাগা খুব বেশি স্থায়ী হয়নি; এটা মাঝে মাঝে শুনতে ভালই লাগে।

এরপর বুয়েট লাইফ.... সেখানেও হেভী মেটাল, হার্ড রক। গীটার শেখার চেষ্টা করলাম একবার। ৩ মাস নীলয় দাসের ওখানে ক্লাসও করলাম। তারপর ভাগারাম। ৩য় বর্ষের শেষের দিকে আর ৪র্থ বর্ষে আস্তে আস্তে আবার মান্না দে, কিশোর .. এদের গান শুনা শুরু করলাম। যদিও হেভী মেটাল ভক্তদের ওসব প্যানপ্যানানি ভাল লাগার কথা না, আমার কাহিনীটা একটু অন্যরকম। রূমমেট ও ব্যাচমেট ও ক্লাশমেট আবীর শুনত ঐ গানগুলো। শুনতে শুনতে দেখলাম আমারও ভাল লাগতে শুরু করল। আফটার অল ছোটকালে আমার ছোটচাচাও এই গানগুলো শুনতেন। তাই হয়ত পাশ করার পর প্রেমে পড়তে মন চাইল, চাকরী পেলাম। বিয়ে করলাম।

বিয়ের পর গানের জগতে আরো কিছু যোগ হল। জাগজিৎ সিং-এর গজল; প্রথম দিকে ভাল লাগত না... এখন মন্দ লাগে না। বউয়ের পছন্দে বাপ্পার গান শুনলাম। শুনেই তো হিট ..... আসলে এর আগে টিভিতে দলছুট ব্যান্ডটার পারফর্মেন্স দেখে খুব ভাল লেগেছিল। তাই দলছুটের ভোকালিস্ট দেখে একটা আকর্ষন তো ছিলই। এখন আমি বাপ্পার গানের একজন ভক্ত। তাছাড়া কুমার বিশ্বজিতের গানও এভাবে ভাল লাগায় স্থান করে নিল। রেঁনেঁসা ব্যান্ডটা সবসময়ই ভাল লাগত - বলা হয় নি আগে।

এখন বয়স বাড়ার সাথে সাথে মনের চাহিদা পরিবর্তন হচ্ছে... তাই পছন্দের গানের ব্যাপ্তিও বেড়ে যাচ্ছে। কিছু গান ভাল লাগে মিউজিক কম্পোজিশনের জন্য। কিছু গান ভাল লাগে কথার জন্য। তবে কোন একটা গান ভাল লাগার পেছনে আমার মনে হয় মনের অবস্থাটা সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে। এখানে উল্লেখিত শিল্পী/ব্যান্ড ছাড়াও আরো অনেক গানই আমার পছন্দ; সবগুলো পছন্দ হয়ত লেখাতে আসেনি। এ পর্যন্তই........


বুধবার, ১১ এপ্রিল, ২০০৭

সুইজারল্যান্ডের এক কোনা ভ্রমনের বিশাল অভিজ্ঞতাঃ পর্ব-৩ (যাত্রা হল শুরু)

(....পূর্বের পর্ব হতে চলমান)

কোনরকম ঝুট ঝামেলা ছাড়াই চেক ইন করলাম। আমার ফ্লাইট ছিল বিমানে ঢাকা থেকে মুম্বাই, তারপর ৫ ঘন্টা ট্রানজিট, আর তারপর সুইস এয়ারে মুম্বাই থেকে যুরিখ। ঝামেলা পাকাল ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ। অযথা হয়রানী করল, ঘুষ দাবী করল। এটা আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ .... ভয় পাইছিলাম; ঘুষ দিলাম, সাথে দিলাম একগাদা গালাগালি (মনে মনে অবশ্য)। পরের ছোট্ট ঝামেলা স্টীলের কাটাচামচ .... ঐটা ফেলে দিতে হল বোর্ডিঙের সিকিউরিটি চেকিঙের সময়।

প্লেন টেক অফ করার সময় তো অবস্থা যায় যায় .... ... প্রথমেই দেখাল কিভাবে সীট বেল্ট বাঁধতে হয়, তারপর জরুরী অবস্থায় করণীয় – ভয় লাগা শুরু করল..... এ্যাত কিছু দেখাইতেছে কেন? বিপদ কি আবশ্যম্ভাবী? তারপর টেকঅফের জন্য বাতি নিভায় দিল; আশেপাশের সহযাত্রীরা দেখলাম বিকারহীন; ওনাদের দেখে মনে সাহস নিয়ে বসে থাকলাম। রানওয়ের মাথা থেকে যখন ছিলা মুক্ত তীরের মত ছুটা শুরু করল প্লেনটা তখন যে কিরকম অনুভুতি হয়েছিল বোঝানো মুশকিল ..... প্রথমবার রোলার কোস্টারে চড়ার মত (তখনো একবারও চড়িনি)।

বিমানে কি যে খাওয়াইছিল মনে নাই এখন। তবে যে জিনিসটা অবাক করেছিল সেটা হল সীটের সাইজ .... তেমন একটা আরামদায়ক না ... টিভি বিজ্ঞাপনগুলাতে যেরকম দেখায় তার সাথে মিল নাই একটুও! তাছাড়া আছে গোঁ গোঁ বিরক্তিকর একটা শব্দ। জানালা দিয়ে বাইরে কেমন দেখায় দেখতে খুব ইচ্ছা করছিল কিন্তু আমার সীটটা ছিল মাঝের দিকে.... জানালা থেকে অনেক দুরে।

সময়মত মুম্বাই পৌছালাম। ল্যান্ড করার সময় আরেকবার আতঙ্কিত হলাম। প্লেন থেকে নেমে বোর্ডিং ব্রীজ থেকে করিডোরে পা রাখা মাত্র দেখলাম একজন সুন্দরী এয়ারপোর্ট স্টাফ সুইস এয়ার সুইস এয়ার বলে ডাকছে .... মিরপুর, গুলিস্থান বাসের হেলপার/ কন্ডাকটরদের সাথে এর কোন তুলনা চলে না। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম যে, আমি সুইস এয়ারের যাত্রী। আমাকে বলল ওনাকে ফলো করতে .... আর জিজ্ঞেস করে জানলাম আমিই একমাত্র যাত্রী বিমান থেকে সুইস এয়ারে যাব – আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম এই আশায় যে কোন দেশী সহযাত্রী পাইলে একটু ভাল লাগত এই আশায়। যা হোক ঐ মহিলাকে দেখে অন্ততপক্ষে এটুকু আশ্বস্ত হলাম যে, আমি একেবারে অবহেলিত না । এখন বুঝতেছি যে, এয়ার টিকিট আনার সময় আমার আনকোরা পাসপোর্ট দেখে সুইস এয়ারের ট্রাভেল এজেন্ট “সাহায্য দরকার, প্রথমবার আকাশপথে ভ্রমনকারীঁ” - এ ধরনের একটা অনুরোধ করে রেখেছিলেন।

এয়ারপোর্ট স্টাফের সাথে একটা লম্বা করিডোর দিয়ে হেটে চলছি তো চলছিই..... বামপাশে গ্লাস প্যানেল, প্লেন, রানওয়ে আর অন্যান্য জিনিস দেখা যাচ্ছে, আর ডান পাশে দেয়াল। হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যাথা হয়ে গেল ........... শেষ পর্যন্ত ট্রানজিট লাউঞ্জ নামক একটা জায়গায় এসে পৌছালাম। ওখানের ট্রান্সফার ডেস্কের স্টাফকে গিয়ে এই মহিলা স্টাফ কি জানি বলল; আমার হাতে একটা খাওয়ার কুপন ধরায় দিয়ে বলল রাত ৮টা থেকে ১১টার (?) মধ্যে পাশের রেস্টুরেন্ট থেকে ডিনার করে নিতে আর সময়মত পরবর্তী প্লেনে চড়তে। তারপর এ্যাতবড় লাউঞ্জে যাত্রী হিসেবে আমি একা - আর ট্রান্সফার ডেস্কে একজন কর্মকর্তা ।

৫ ঘন্টা যাত্রাবিরতি ছিল .... .... তার মধ্যে ঐ রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে এসেছি (যতদুর মনে পড়ে, বুফে সিস্টেম ছিল).... ... বাকী সময়টা যে কি বিরক্ত লাগছিল: বলার মত না। যা হোক, নির্দিষ্ট সময়ে পরবর্তী প্লেনে চড়লাম। এবারও সীট মাঝখানের দিকে তবে চলাচলের রাস্তার সাথে (আইল সিট)। আগেরটা ছিল ৩ কি সাড়ে ৩ ঘন্টার যাত্রা.... আর এটা সম্ভবত ৭ ঘন্টার। কি যে বিরক্তিকর। একে তো সীট আটোঁসাটো, গোঁ গোঁ শব্দ (ফ্লাই এমিরেটস-এর বিজ্ঞাপনওয়ালারা যে কি বিরাট মিথ্যূক!) তার উপর গোদের উপর বিষফোঁড়া হিসেবে খারাপ আবহাওয়া, টার্বুলেন্স .... .... মনে হল ঢাকা-উত্তরবঙ্গের বাসও এত ঝাকায় না (সীটও এর চেয়ে আরামের)-- শালার প্লেন ভ্রমন! আধো অন্ধকারে দেখলাম কেউ কেউ এর মধ্যে ঘুমাচ্ছে ... .... আমি মাঝে মাঝে হাটছি, একটা বন্ধ এক্সিট দরজার সামনে দাড়িয়ে, মাঝখানের জানালার মত জায়গা দিয়ে বাইরেটা দেখছি মাঝে মাঝে। আকাশের উপরটা অদ্ভুদ রকম মায়াবী। প্লেনের নীচে বিরাট একটা মেঘের সমুদ্র, উপরে চাঁদ, চারিদিকে জোৎস্না।

আরো কিছু পরে ঝাকুনি থেমে গেল, কিন্তু বিরক্তিকর শব্দটা থামল না। সামনের একটা স্ক্রীনে প্লেনের যাত্রাপথের মানচিত্র, আর তার মাঝে আমাদের অবস্থান জানান দিচ্ছে। একসময় খেয়াল করলাম ইরানের উপর দিয়ে যাচ্ছি, নীচে পাহাড়। কৌতুহলি হয়ে গেলাম সেই জানালায় (এক্সিট ডোর)। আবার বিমোহিত হলাম: পরিষ্কার আকাশের নীচে চাঁদের আলোয় প্লাবিত প্রান্তর.... ... ধুসর লালচে (রাতে কেন যে লালচে দেখাচ্ছিল কে জানে) ন্যাড়া পাহাড়ী অঞ্চল দেখা যাচ্ছে। ধারনা ছিল পাহাড় হলে তো জঙ্গল থাকবে; কিন্তু এটা ন্যাড়া দেখাচ্ছে কেন? মনের মধ্যে যুক্তি হাতড়াচ্ছিলাম... .... একেই তো রাত, আসল রঙ যে সবুজ না তা নিশ্চিত করে বোঝা সম্ভব না, তার উপর প্লেন উড়ছে প্রায় ১০ কি.মি. উচ্চতায় ... হতে পারে এটা কি আফগানিস্থান বা তার আশেপাশে; কারণ, র‌্যাম্বো সিনেমার একটা পর্বে আফগানিস্থানের রূক্ষ প্রান্তর আর ন্যাড়া পাহাড় দেখাইছিল... আর ইরান তো আফগানিস্থানের পাশেই; কাজেই ন্যাড়া হওয়া অসম্ভব নয় --- কতক্ষন দাড়িয়ে দেখেছি জানি না, কিন্তু পাহাড়ী অঞ্চল আর শেষ হল না। ... ... প্লেন কি এ্যাত আস্তে চলে... তাই হবে হয়ত, আকাশের মাঝে ছোট ছোট প্লেন তো আস্তেই যেতে দেখি!! আবার এসে বসলাম... ... একসময় মনে হয় তন্দ্রা মত এসেছিল।


(.... চলবে)

মঙ্গলবার, ১০ এপ্রিল, ২০০৭

সুইজারল্যান্ডের এক কোনা ভ্রমনের বিশাল অভিজ্ঞতাঃ পর্ব-২ (প্রস্তুতি)

(....পূর্বের পর্ব হতে চলমান)

আবেদনপত্রে একটা জায়গা ছিল যে, তুমি কেন নিজেকে এই প্রশিক্ষনের একজন উপযুক্ত প্রার্থী বলে মনে কর। ঐ জায়গাটায় ডঃ ফিরোজ আহমেদ স্যারের একটা প্রবন্ধের ভুমিকার শেষ প্যারাটা একটু ইনায় বিনায় মেরে দিলাম। অনলাইনে অ্যাপ্লাই করার সময় আব্বা পাশে বসে ছিলেন। ফর্মটা পুরণকরে পাঠায় দেয়ার ১০ মিনিটের মধ্যে অর্টোমেটিক রিপ্লাই আসল যে আমার আবেদন পেয়েছেন। তা দেখে আব্বা তো অবাক .... এ্যাত তাড়াতাড়ি চিঠি (!) পাইল! .... .... নাহ. ইন্টারনেট, কম্পিউটার তো দারুন কাজের জিনিস; ইন্টারনেট লাইন নি্য়ে খুব ভালো করছিস --- এই ছিল ওনার বক্তব্য। এক বছর আগে চাকরী থেকে রিটায়ার করা আব্বার কথাবার্তা অবশ্য সবসময়ই এরকম .... .... এর আগে প্রিন্টার কেনার আগে অনেক গজগজ করেছিলেন – শুধু শুধু পয়সা নষ্ট বলে ... কিন্তু দেখা গেল ওইটা আসার পর ওনার চিঠি লেখা বেড়ে গেল..... আমাকে বা শাহেদকে (আমার ছোটভাই) দিয়ে বাংলা টাইপ করিয়ে, প্রিন্ট নিয়ে তারপর আবার খামের উপর ও ঠিকানা প্রিন্ট করায় তারপর চিঠি পাঠানো হত। এরকম ছাপার অক্ষরে চিঠি পেয়ে ঐ প্রাপকগণ নিশ্চয়ই খুব অবাক হতেন।

এই ফাকে বলে রাখি আব্বা ১৯৬৮ সালে সরকারি মেধাবৃত্তি নিয়ে ২ বছর কানাডায় বিজনেস এ্যাডমিনিসট্রেশনের উপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা করেছিলেন .... আর ঘুরেছিলেন অনেকগুলা দেশ। ফলে উনি বিদেশ ভ্রমনের পূর্বশর্ত বা প্রাসঙ্গিক কাজ সম্পর্কে জানতেন কিন্তু সবসময় উনার চিন্তা ভাবনাগুলো ৩০ বছর পুরাতন পরিপ্রেক্ষিতে হত। আর খালি ঝাড়ি দিতেন ... এখন ও আবেদন করিস নাই! এখন ও পাসপোর্ট হয়নি ... ... এখনো ভিসার জন্য যাসনি ....এয়ার টিকিট হয়নি... ইত্যাদি ইত্যাদি । পরে আম্মার কাছে শুনেছি যে, আব্বা নাকি উনাকে দূঃখ করে বলেছিলেন যে... শামীমটা বোধহয় যেতে পারবে না.... ওর কাজ কাম যে ঢিলা!!

যা হউক, সব কাজ সুন্দরমত এগোলেও এক জায়গায় ঝামেলা বাধলো। ঐ ১৫দিন ভ্রমনের ও থাকা খাওয়ার সমস্ত খরচ বহন করবে ওখানকার কর্তৃপক্ষ আমাকে শুধু ৫০০ ডলার দিতে হবে। আমার হিসেবে সমস্ত খরচের তুলনায় ঐ টাকা কিছুই না ... বরং একেই তো বিদেশ ভ্রমণ হবে তার উপর এইটা একটা শর্ট একাডেমিক ট্রেনিং জন্য ভবিষ্যতে আমার CV সমৃদ্ধ করবে। কাজেই খুশিমনেই টাকাটা বিনিয়োগ(!) করতে রাজি হলাম। কিন্তু ব্যাংক থেকে টাকা পাঠাতে গিয়ে শুনি, সরকারী নিয়ম অনুযায়ী ২০০ ডলারের বেশি পাঠানো যায় না .... পাঠাতে হলে আরো কি কি জানি আগডুম বাগডুম করা লাগবে। আমি তাও রাজি কিন্তু ওতে যা সময় লাগবে তাতে আমরা টাকা পাঠানোর শেষ সময় পার হয়ে যাবে।

মাথায় বুদ্ধি খেলল.... সুইজারল্যান্ডে ডঃ স্টেফান কে মেইল করলাম ..... খুলে বললাম সমস্যার কথা; তারপর অনুরোধ করলাম, উনি কি আমার হয়ে ৫০০ ডলার দিয়ে দিতে পারবে কি না .... আমি সুইজারল্যান্ডে এসে ওনাকে ক্যাশ ডলার দি্য়ে দিব। উনি সানন্দে রাজি হলেন আর বল্লেন যে, ফেরৎ যাওয়ার আগে যুরিখ-এ ২ দিন থেকে যেতে .... উনি আমাকে ওনার ল্যাব দেখাবেন। এতো মেঘ না চাইতেই জল – আমিও একপায়ে খাড়া। অবশ্য এ জন্য পরে আমাকে এয়ার টিকিট পিছাতে হয়েছিল..... কিছু ফী এর বিনিময়ে।

যা হোক, নতুন অফিসে জয়েন করার একমাসও হয়নি তখন, তাও ছুটি পেলাম – এক্সট্রা অর্ডিনারি লিভ (মানেটা জানতাম না তখন!)। এর মাঝে ভ্রমনের সময়ের ভিতরে মাস্টার্সের একটা পরীক্ষার ডেট পড়ছিল. ... তাও ত্যাগ করলাম বিদেশ ভ্রমনের লোভে। সমস্ত নিয়মকানুন মেনে যাত্রার দিন এয়ারপোর্টে হাজির হলাম।

(...চলবে)

সোমবার, ৯ এপ্রিল, ২০০৭

সুইজারল্যান্ডের এক কোনা ভ্রমনের বিশাল অভিজ্ঞতাঃ পর্ব-১ (পূর্ব কথা)

২০০১ সালের আগস্ট মাসে আমি সুইজারল্যান্ড গিয়েছিলাম। তবে, ঐ ঘটনার সুচনা ঐ বছরেই বেশ আগে। তখন আমি বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাবে রিসার্চ এসিসট্যান্ট হিসেবে চাকরী করছিলাম। পাশাপাশি একই বিষয়ে মাস্টার্স করতেছিলাম পার্ট টাইম ছাত্র হিসেবে।

একদিন সকালে ল্যাবে গিয়ে দেখি ল্যাবের পাশের খোলা স্পেসে একজন বিদেশী লোক দাড়িয়ে আছে। আমাকে দেখা মাত্র সে কি জানি বলা শুরু করল; খেয়াল করে বুঝলাম উনি ইংরেজিতেই বলছেন কিন্তু উচ্চারনটা একটু ভিন্ন রকম। একসময় আমার বাসায় এক বন্ধু আসতো টোফেল পরীক্ষার জন্য লিসনিং প্র্যাকটিস করতে, কারণ ওর বাসার টেপ রেকর্ডার নষ্ট ছিলো। প্র্যাকটিসটা যে আমারও খুব ভাল হয়েছিল তা আমি সেই সময়েই বুঝেছিলাম, কারণ তারপর থেকে আমি ফরিদা পারভিনের লালন গীতির কথা বুঝতে পারতাম।

কাজেই আত্মবিশ্বাসে ভর করে বুঝার চেষ্টা করলাম যে উনি কি বলতেছেন। যতটুকু বুঝেছিলাম উনি বলতেছিলেন যে উনি খুব খুশি কারণ ওনার হারিয়ে যাওয়া লাগেজটা পাওয়া গেছে, আজ সকালে এয়ারপোর্ট গিয়ে নিয়ে এসেছেন। উনি এমন ভঙ্গিতে বলছেন যে আমি ওনার কতদিনের চেনা। ভাবলাম উনার চাইনিজ সিন্ড্রোম হইছে - সব বাঙালি একই রকম লাগছে ওনার কাছে; আমাকে অন্য কেউ বলে ভুল করছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম উনি কার কাছে এসেছেন এবং পৌছায় দিলাম। উনি সুইস ফেডেরাল ইনস্টিটিউটের একজন সিনিয়র রিসার্চার, নাম স্টিফেন হুগ, এসেছিলেন আমারই আন্ডারগ্রাজুয়েট সময়ের স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজার স্যারের কাছে। যা হউক, পরবর্তীতে ওই ভদ্রলোককে ফিল্ড ওয়র্কে সাহায্য করেছিলাম বেশ কয়েকদিন। দেড় দিন পর থেকে ওনার কথা পুরোপুরি বুঝতে পারতাম।

বুয়েটের ঐ প্রজেক্টটা শেষের পথে ছিল। তাই চাকরীর চেষ্টা হিসাবে বেশ কিছুদিন আগে SWMC নামে একটা প্রতিষ্ঠানে CV জমা দিয়ে রাখছিলাম। হঠাৎ করেই ওখান থেকে একদিন ইন্টরভিউয়ের জন্য ডাকল, আর আমি সহ ৬ জনের চাকরী হল। কিন্তু তখনো আমার মাস্টার্স শেষ হয়নি তাই ক্লাশ করার জন্য বুয়েটে যেতে হত নিয়মিত।

এর কিছুদিন পরে একদিন বদরুজ্জামান স্যার (বর্তমানে প্রফেসর) আমাকে ডেকে একটা প্রিন্টেড ইমেইল দিয়ে বলল যে, এখানে অ্যাপ্লাই কর, কাউকে কিচ্ছু বলার দরকার নাই, আমি রিকমেন্ড করে দেব। আর স্টেফানও তোমাকে রেকমেন্ড করবে, কাজেই হয়ে যাবে। ওটা ছিল সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিতব্য একটা সামার ক্যাম্পের জন্য, ওখানে মূলতঃ পোস্ট গ্রাজুয়েট ছাত্রদেরকে টেকসই উন্নয়নের (Sustainable development) উপর ২ সপ্তাহ প্রশিক্ষন দেবে। বাসায় এসে অনলাইনে আবেদন করলাম।

(.....চলবে)